Skip to main content
 

        কয়েকদিন আগে ‘সাদা চাটু’ নামে একটা লেখা লিখেছিলাম। একজন বিপন্ন মাতাল রিকশাওয়ালার বয়ানে একটা ছোট্টো গল্প। তাতে খারাপ ভাষা ছিল। যে ভাষায় লক্ষ্মীর পাঁচালী থেকে স্বর্ণযুগ ছুঁয়ে আজ অবধি প্রথম সারির বাংলা সাহিত্য লেখা হয় সে ভাষায় নয়। আমার টাইমলাইনে যে কোনো কারণেই হোক কেউ সেরকম কিছু বলেননি। কিন্তু একটা বিশেষ গ্রুপে সুমন যখন লেখাটা দিল তখন নিন্দা-কটুক্তির ঝড় উঠল। আমার রুচি নাকি খুব নিম্নমানের, অশালীনতা ছড়াচ্ছি সাহিত্যের নামে, অ্যাডমিন কি করে এই পোস্ট সমর্থন করেন, আমি নাকি সমরেশ বসু হওয়ার চেষ্টা করছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি সুমনকে বললাম, লেখাটা তুলে নিতে। তার প্রধান কারণের এক, উক্ত গ্রুপের অ্যাডমিনের নীরবতা, আর তার থেকেও বড় কারণ তখন কাঠুয়ার ঘটনায় আমি মানসিক আর আত্মিকভাবে বিধ্বস্ত। তর্কে জড়ানোর প্রবৃত্তি হল না। 
        সেই লেখাটা লেখার কতগুলো কারণ ছিল। এক, আমি তখন হারুকি মুরাকামি আর মার্কেজে ডুবে। দুই, তখন কাশ্মীর আর উত্তরপ্রদেশের ঘটনাটা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। আর তিন, আমার সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তরের অশিক্ষিত, অসংস্কৃত, অমার্জিত মানুষদের সাথে কথা বলার অভ্যাস। একটা বড় আঘাত অনেক কিছু পাল্টে দেয়, তুচ্ছ করে দেয়। অনেক লজ্জা, ভয়, আড়ষ্ঠতা - বিপন্নতার মুখে ফেলে দেওয়া চকলেটের খোসার মত উড়ে যায়। আর যদি বিশ্বাস করি সাহিত্য সমাজের দর্পণ তবে কেন সেই রিকশাওয়ালার ভাষায় লেখা যাবে না সেটার যুক্তিও আমি পাইনি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার চারপাশে যারা পাঠক তারা অনেকেই যৌনতার সাথে শুদ্ধতার সমীকরণে বাস করে। আমাদের দেশে ঘুষ নেওয়ার থেকে বড় প্রতিবাদ মন্দিরে চটি পরে ঢোকাতে হয়। আমাদের দেশে কণ্ডোমের অ্যাড কখন দেখানো হবে সেই নিয়ে আলোচনা হয়। আমাদের দেশে পঁচিশে বৈশাখ বৈধব্যের শুচিতায় আসে। আমাদের দেশে বয়স্করাও “বড়োদের” কথা, সিনেমায় লজ্জা পায়। অথচ কি করে কি করে যেন এই অত্যন্ত শুচিতার মধ্যেও মিথ্যা, অনাস্থা, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা ঘেয়ো কুকুরের মত মন্দিরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। এখন থেকে আমি একজন মাতাল, বিপন্ন রিকশাওয়ালার গল্প লিখব আমার বয়ানে। এমন শুচিতায় যেন একটা শিশু মন্দিরে ধর্ষিতা হয়েছে খবরটা শুনতে শুনতে পাশের চ্যানেলে সিরিয়ালে ডুবে যেতে কারোর কোনো অসুবিধা না হয়। এটাই তো কাজ। সত্যকথনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল দেশের সংস্কারের শুদ্ধতাটা বজায় রাখা। “সঙ্গে রমণী থাকে, না করে রমণ” – এমন আদর্শতেই তো পৌঁছাতে চাই আমরা। আর না হোক এমন একটা ভাবমূর্তি পাশবালিশ করেই তো রোজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাই। ধর্ষক তো ব্যতিক্রমী গর্ভে জন্মায়। পুরুষতন্ত্রের যে ভিত শতাব্দীব্যাপী দাঁড়িয়ে আছে সে কোনো পুরুষের জোরে নয়, সে নারীর অসামান্য আত্ম-সম্মোহন ক্ষমতার জোরেই। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের ধর্মীয় গুরুদের অসম্ভব নারী-বিদ্বেষী তথা নারীত্বের অবমাননাকর শিক্ষার ভার তারাই কি অসামান্য নিষ্ঠার সাথে বহন করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। প্রতিবাদ করলে বলা হচ্ছে – নাস্তিক, ভণ্ড। যেদিন সেটা ভাঙবে সেদিন অধিকার আর ভিক্ষা করতে হবে না পুরুষের দরজায় দরজায় গিয়ে, সে অধিকার এমনিই তার পদতলে এসে পড়বে।
 
        এত কথা বললাম, দুটো বইতে আসব বলে। এক, 'Memories of my melancholy whores', আর দুই, 'Of love and other Demons'– এই বইদুটো নিয়ে বলব বলে।
        দ্বিতীয় গল্পটা একটা বাচ্চা মেয়েকে কুকুরে কামড়ানো নিয়ে। যখন রেবিসকে শয়তানের একটা রূপ বলে বিশ্বাস করা হত। আর প্রথমটায় একজন নিঃসঙ্গ নব্বই বছরের মানুষকে নিয়ে তার সাথে একটা চোদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ের সম্পর্ক।
দ্বিতীয়ট গল্পটায় বাচ্চা মেয়েটা সমাজ আর ধর্মীয় নানা কুসংস্কারের শিকার হয়ে চার্চের একটা কারাগারে মৃত্যুবরণ করে। তার সেই বিপন্ন জীবনের মধ্যেও প্রেম আসে একজন ছত্রিশ বছরের ধর্মযাজকের শরীর আর মন নিয়ে। কিন্তু করুন পরিণতিতে দুটো জীবনই শেষ হয়ে যায়।
        আর প্রথম গল্পের পরিণতি হল, সে মানুষটা নব্বই বছর বয়সে তার প্রেমকে খুঁজে পায়। প্রথম যেন সে চায় একটা শরীরের সাথে না, প্রেমের সাথে সঙ্গম হোক মৃত্যুর পূর্বে একবার হলেও। এবং এই শেষোক্ত কথাটাও তাকে স্মরণ করায় এক বৃদ্ধা বেশ্যা, যে এককালে তার নিয়মিত শয্যাসঙ্গিনী হত। শত শত শয্যাসঙ্গিনীর কাউকেই মানুষটা বিনা পয়সায় ফেরায়নি। এমনকি যে মূর্খ ভালোবাসার মোহে পড়ে তার পয়সাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে গেছে তাকেও সে করুণার চোখেই দেখেছে। শরীরটাই শেষ কথা বলেছে তার জীবনে এতদিন। এই নব্বইতম জন্মদিনের আগে অবধিও। সব ধারণা বদলে দিল ওই কিশোরী।
        মার্কেজের লেখা নিয়ে বলার মত জ্ঞান বা শব্দভাণ্ডার আমার নেই। মার্কেজকে পড়া যেন একটা অত্যন্ত নিখুঁত কাজ করা প্রাসাদে আসা কিম্বা একটা ফুলের সৌন্দর্য বা মাধুর্য যেন কি যাদুশক্তিতে লক্ষগুণ বড় হয়ে তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সৌন্দর্যের মাধুরী উজাড় করে দিচ্ছে – তা আস্বাদন করা। মার্কেজ মানুষের বিপন্নতা, নিঃসঙ্গতা আর প্রেমকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে, কাদার তাল থেকে কুম্ভকার যেমন মাটির পাত্র বানায়, তেমনই অভূতপূর্ব সব জীবন বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন। সে মাটিতে আমার জীবনের মাটিও মিশছে। কি সহানুভূতিতে একটার পর একটা চরিত্রের কাছে আনেন মার্কেজ তার পাঠককে। খুব নির্মম সত্য কথা হঠাৎ করে অনায়াসেই বলে ফেলেন। বলেই গল্পের স্রোতে ঢুকে পড়েন।
        আমাদের সাহিত্যে এমন লেখা কি পাঠক চান না বলেই জন্মায় না? আমাদের চরিত্রদের কি অন্যান্য দেশের চাইতে বেশি কৈফিয়েৎ দিতে হয় সমাজরক্ষকদের কাছে? তথা গোরক্ষকদের কাছে? আমাদের চরিত্রেরা অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অসঙ্গতির শিকার হয়েছেন – এমন গল্প, উপন্যাস অবশ্যই আছে। খুব উঁচুদরের অবশ্যই। কিন্তু বিশ্বের দরবারে কেন পৌঁছায় না? মুরাকামির ভৌগলিক অবস্থান, কি তার জাপানী ভাষা কি আমাদের ভৌগলিক অবস্থান তথা ভাষার চাইতে বিশ্বের দরবারে পৌঁছাতে অনেক বেশি সাবলীল? জাপানের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান কি বিশ্বের আপামর সাহিত্য পাঠকের পরিবেশের সাথে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ আমাদের থেকে? তবে আমাদের অসুবিধাটা কোথায়? অবশ্য ওনারা কি লিখছেন শুধুমাত্র বাংলা ভাষার পাঠকের পক্ষে জানাও খুব একটা সোজা কাজ নয়। কারণ বিশ্বের তাবড় তাবড় শ্রেষ্ঠ সাহিত্যগুলো এখনও বাংলায় ক'টা অনূদিত? ব্রিটনিকা, দ্য গার্জিয়েন, গুডরিডস ইত্যাদি প্রখ্যাত ওয়েবসাইটের শ্রেষ্ঠ বইয়ের তালিকায় চোখ বুলালেই বোঝা যাবে যে আমরা শুধু ওই তালিকায় নেই-ই তাই নয়, ওই সাহিত্যগুলোকে যথাযোগ্য মানের সাথে নিজের ভাষায় নিজের আঙিনায় আনতেও পারিনি। অর্থাৎ শুধু সৃষ্টির দীনতাই নয়, গ্রহণের দীনতাও স্পষ্ট। শুধু উদাহরণ হিসাবে বলি, 'ব্রাদার্স কারামাজোভ' জাপানী ভাষাতেই বার সাতেক অনুবাদ হয়েছে। আজ ইংরাজি ভাষার যে জয়জয়কার চারদিকে তার পিছনে অনুবাদের অবদান কি সাংঘাতিক। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে যে এতগুলো ভারতীয় ভাষা ঢুকছে সে তো এই অনুবাদের তাগিদেই। ফলে শব্দসংখ্যা বাড়ছে। আমার অত্যন্ত গুণী বন্ধু রিটন আমায় সুনীলবাবু আর বেলাল মশায়ের একটা সাক্ষাৎকারে ট্যাগ করে ধন্য করেছেন। সেখানে সুনীলবাবু বলছেন, কিছুটা আক্ষেপের সুরেই, 'আজকাল অনেকেই লেখেন কিন্তু পড়াশোনা তেমন করেন না।‘ এটা বিপদের চিহ্ন। ভাবপ্রবণতা মানে প্রেম, অযৌন মানে শুদ্ধ, নিজের ব্যক্তিগত জীবন অভিজ্ঞতা অকপটে লিখলেই সৎ-সাহসী সাহিত্য, যত রাজ্যের নৈরাশ্যবাদ-অন্ধকার লেপটানো কথা লিখলেই বাস্তববাদী, অগভীর যৌনাচারের বর্ণনাই আধুনিকীকরণ – এগুলো খুব গোলমেলে। তবে উপায়? উপায় বাজারের ব্যাগ নিয়ে শুধু পাড়ার দোকান আর পাড়ার বাজার নয়, একবার বিশ্বের বাজারেও ঘুরে আসা। যে তালিকাগুলোর কথা বললাম, সেখানে শুধু ইংরাজী লেখক-লেখিকারা থাকলে ভ্রু কুঁচকাতাম। সেখানে শুরুতেই আছে রাশিয়া, তারপর ফ্রেঞ্চ, তার জার্মান, স্প্যানিশ, জাপানী...
        অনেক কথা বলে ফেললাম। হয়ত বা অনেককে রাগিয়েও ফেললাম। আসলে এত ইংরাজিতে বই পড়তে ভালো লাগে না বুঝলেন তো। তাই অনুবাদের দিকে তাকাই কিন্তু মেলে কই? ও একটা কথা বলে শেষ করি, 'Memories my melancholy whores' কিন্তু অরুন্ধতী ভট্টাচার্য্য চমৎকার অনুবাদ করেছেন। দাম একশো টাকা। প্রকাশক উর্বী। নাম – আমার বিষণ্ন বেশ্যারা।

Category