ভাঙা গা। নীল গোপাল। মাটির গোপাল। রঙ চটেছে। ভাব চটেনি। নিত্যরাধা গঙ্গার ধারে বসে। রোজ বসে। একটা ছোটো পেতলের বাটিতে চন্দন। আর তুলসীপাতা। যে চায়, দেয়।
সেবা মানে সুখ দেওয়া। নিত্যরাধা এই সকালটায় বসে সুখী করতে চায় সবাইকে। সবাইকে?
অতীত জীবনটা একটা আলোছায়া রাস্তার মত। সুখী করতে চেয়েছে নিজেকে। পারেনি। অন্যকে দুঃখ দিতে চেয়েছে। কখনও পেরেছে। কখনও পারেনি। সুখ দিতে চেয়েছে। কখনও পেরেছে, আবার পারেনিও।
নিত্যরাধা সুখী করে এই গঙ্গাকে। মাটিকে। অশ্বত্থগাছকে। মহাদেবকে। সুখ মানে গোপাল। যে একাই সুখী। মাটির সোঁদা গন্ধের মত। প্রথম বৃষ্টি না এলে বোঝা যায় না। ভালো না বাসলে সুখ সুবাস দেয় না। তবে ভালোবাসা কী? অন্যকে সুখী করার যে সুখ।
জবা বলল, তোমার কী সব কথা দিদি…. সুখী করতে করতে হাড়মাস এক হয়ে গেল….. সংসারে আমাকে নিয়ে শুধু অভিযোগের ভিড়। এসো একদিন আমার বাড়ি। জিজ্ঞাসা করো, হ্যাঁ গো, নয়নের মা কেমন? দেখবে। সে আমার সোয়ামি থেকে ছেলের বউ অবধি… অভিযোগ আর অভিযোগ…. নাতিটাও বলবে আর দু'দিন পর….
জবার চোখে জল। সে জলে গঙ্গার ছবি। সব ছোটো ছবিতে বড় ছবি লুকিয়ে ভাসে। চোখে পড়ে না। অভিমানে।
নিত্যরাধা বলল, সুখী করতে চেয়ে তুই সুখী হয়েছিস কি? ঈশ্বর ওটুকুই দেখেন।
জবা জলের বালতিটায় হাতটা রেখে বলল, সুখী ছিলাম যদ্দিন গতর খেটে রোজগার করতে পারতাম। আট বাড়িতে কাজ করেছি দিদি…. কিন্তু এই বাতে আমায় শেষ করে দিল।
নিত্যরাধা চুপ করে থাকল। যার কাউকে সুখী করার ক্ষমতা নেই, সে কী করবে তবে? এইভাবে পড়ে পড়ে মার খাবে?
জবা উঠে গেল। বেলা বাড়ল। নিত্যরাধা শিব মন্দিরে গোপাল নিয়ে এসে বসল। বাইরে রাক্ষুসে রোদ্দুর। তার ভাঙা গোপালকে দেওয়ালের একদিকে রেখে চোখটা বন্ধ করল।
মা তাকে তেল মাখাচ্ছে। মা রান্না করছে। মা বড়ি দিচ্ছে। মা কোমর ভেঙে শুয়ে আছে। নিত্যরাধা বিয়ের পর দেখা করতে গেছে। মা থুতনিতে হাত দিয়ে বলল, খাবার পাস ঠিক মত?
খাওয়া হয় না। মা সব জানতে পারে। কিন্তু তার স্বামী মানুষটা ভালো। ভালো মানুষ হলেই যে কপাল ভালো হবে তাই কি হয়?
মা বলল, মনকে অভিমানী করিস না… সন্তুষ্ট মনে গোবিন্দের গা জুড়ায়। ওই সেবা। মনে রাখবি।
নিত্যরাধা চোখ খুলল। জবা এসেছে। হাতে একটা বাটি ধরা। সে চোখ খুলতেই বলল, ঘুমিয়ে পড়েছিলে? আমিও আর ডাকিনি। বিউলির ডালের বড়া ভাজছিল বউ। বললাম, দে চারটে, ও মাগীকে দিয়ে আসি, এই আশ্রমের খিচুড়ি খেয়ে খেয়ে তো জিভের তারটা কেটে গেছে। তা বউ কী বলল জানো…. বলল, মা, একদিন মাসিকে ডাকো না.... শনিবার তো আমাদের বাড়ি নিরামিষই হয়। সামনের মাসে আসতে বলো, তোমার ছেলের মাইনেটা হোক….
জবার মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। নিত্যরাধার মায়ের মুখটা জবার মুখে ফুটে উঠল। এ মানুষ একটু আগে বলছিল তার নাকি কাউকে সুখী করার আনন্দ নেই… নিজের ভিতরে ডোবে না কেউ… বাইরের উথালপাতাল দেখে ভাবে ভিতরটা বুঝি বা কাঙাল…
জবা চলে গেল। বড়াগুলো নিয়ে আশ্রমের মধ্যে এলো নিত্যরাধা। এখানে থাকে না সে, দু'বেলা প্রসাদ পায়। বদলে বাসনকোসন মেজে দেয়।
নিমগাছের তলায় বসে নিত্যরাধা খাচ্ছে। ভাঙা গোপালের গায়ের নীলরঙের উপর গাছের ছায়া এসে পড়েছে। দুলছে। মনটা খুশীতে ভরে উঠল। এমনিই। সুখ জীবন্ত। এমনিই তো। ধরতে নেই। অন্যের কোঁচড়ের দিকে ঠেলে দিতে হয়।
নিত্যরাধা একটা বড়া ছুঁড়ে দিল সামনে। কাকটা অনেকক্ষণ ধরে চাইছিল। গোবিন্দের কাক হতে বাধা হয় না। গোবিন্দ সব হতে পারে। সবাইকে সুখী করে সুখী হয় সে। অভিমানে অন্ধ চোখ, দেখেও দেখে না।
(ছবি Samiran দার ভালোবাসায় পাওয়া। সমীরণদা, যার চোখে এ ছবি ধরা দেয়। প্রণাম জানবেন দাদা।)