শ্যামশ্রীর এতটা উঠতে অনেক ধকল হয়েছে। তিনতলায় পুজো হচ্ছে। অমাবস্যার পুজো। মায়ের পুজো। এ বাড়ি থেকে চারটে বাড়ি গেলেই মোড়ের একতলা সবুজ বাড়িটা শ্যামশ্রীদের। আজ থেকে প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে স্বামীর হাত ধরে ঢুকেছিল। শাশুড়ি, শ্বশুর, দুই ননদ। আজ কেউ নেই। ছেলে বাইরে। নাতি আছে। সাড়ে চার বছরের। ভিডিও কলে সব কাছে। শুধু ওইটুকু স্ক্রীণ আর ওইটুকু সময়ের মধ্যে, এই যা!
শ্যামশ্রীকে কেউ ডাকলেই শ্যামশ্রী যায়। ক'টা মানুষের মুখ তো দেখা যায়।
হাঁটুটা টাটাচ্ছে। একটা চেয়ারে বসে সবাইকে দেখছে শ্যামশ্রী। চশমাটা ঘামে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বারবার। আঁচলে মুছে আবার চোখে দিচ্ছে। আবার ঝাপসা।
========
"ঠাম্মি খেয়ে যেও কিন্তু।"
মধুমিতা। এ বাড়ির বড় নাতনি। কলেজে পড়ে। কি সুন্দর যে গড়ন মেয়েটার!
না রে মা… রাতে ওসব খেলে আমার শরীর খারাপ করবে, তুই দুটো বাতাসা দিয়ে যাস… ব্যস… আমি আছি ব্যস্ত হোস না….
কোথাতেই বা যাবে? বাড়ি গেলে তো সেই সিরিয়াল। মধুমিতা "আচ্ছা ঠাম্মি" বলে চলে গেল।
শ্যামশ্রী বসে বসে পুজোর সাজানো দেখছে। আলপনাটা বড় তাড়াহুড়ো করে দেওয়া। শ্যামশ্রী দারুণ আলপনা দিতে পারত। শাশুড়ি শিখিয়েছিল। এখন তো মাটিতে বসতেই পারে না।
"মাসিমা শরীর ভালো?"
হ্যাঁ বাবা…. তোমরা ভালো?
"এই চলে যাচ্ছে। বাবু তো এ বছর আসতে পারবে না… আমাদের ফেসবুকে কথা হয়…."
বাবু আসবে না। শ্যামশ্রী জানে। পাড়ার আরো অনেকেই জানে। ওর কাজের চাপ। কিন্তু ছেলেটা ফোন করে নিয়মিত। টাকা একদিনও দেরি করে ঢোকে না। ওখানে বসে বসে হেলথ চেকআপের সময় বলে দেয়। আগে তো কতবার করে যেতে বলত। শ্যামশ্রী যেতে চায় না। কারণ কিছু আছে হয় তো। সে সব খুঁড়ে দেখতে এই বয়সে আর ইচ্ছা করে না। সংসারে বেশি কিছু খুঁড়ে দেখতে নেই। এই মাকেই খুঁড়লে খড় বিচুলি বাঁশ মাটি বেরিয়ে পড়বে। তখন?
======
আঁচলে দুটো বাতাসা বেঁধে সিঁড়ি দিয়ে নামছে শ্যামশ্রী। শাড়িটা জলকাচ করে নিলে হবে।
ধীরে ধীরে নেমে খানিক দাঁড়ালো। হাঁপ ধরে গেছে। আবার হাঁটতে শুরু করল। দুটো কুকুর সঙ্গে যাচ্ছে। চেনে শ্যামশ্রীকে ওরা। শ্যামশ্রীও চেনে। এদের মা দিদাকেও চেনে।
দরজাটা খুলে ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে দিল। আলো জ্বালাই ছিল। বসার ঘরে এসে ফ্যানের সুইচ অন করে খাটে বসল। সামনের তাকে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ির ছবি। শ্যামশ্রী আঁচল থেকে বাতাসা দুটো বার করে একটা নিজে মুখে দিয়ে আরেকটা সামনের তাকে রাখল। বলল, খেয়ে নাও। আমি ভাতটা গরম করতে দিই।
শ্যামশ্রী ভাত গরম করতে বসিয়ে, টয়লেটে গেল। বাইরে এসে ভাতটা নামিয়ে, খাবার টেবিলে রেখে ঘরে এসে দেখে বাতাসাটা নেই। শ্যামশ্রীর ঠোঁটের কোণায় হাসি খেলে গেল।
একটু দাঁড়িয়ে থেকে খাটে এসে চুপ করে বসল। চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠল। আঁচলে চোখটা মুছে, ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করল।
রমা?
হ্যাঁ ঠাকুমা
বলছি, কাল আসার সময় ওই ইঁদুর আটকানোর আঠা কাগজগুলো আনিস মা….
ঘর অন্ধকার। মশারিটা দুলছে হাওয়ায়। শ্যামশ্রী চোখটা খুলে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। বাতাসাটা ভাঙা দাঁতের মধ্যে আটকিয়ে। হালকা জিভ ঠেকালেই মিষ্টি লাগছে। স্মৃতির মত। শ্যামশ্রী ঘুমিয়ে পড়ল। সবাইকে নিয়ে। অন্য জগতে।