অভিমান মানে কি? নিজেকে বঞ্চিত ভাবার সুখ। সে ভালো নয়। যদি ভালোবাসো তবে সুখের কথা দূরে থাক। দুঃখকে এক একবার দেখে যেও বিছানায়, জামাকাপড়ে, পর্দায়, বাসনে, আসবাবে; সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায়, মধ্যরাতে।
মন, এ রহস্য এই মাটিতেই জন্মায়। যাকে তুমি হৃদয় বলো, সে এক অবাধ্য জমাট বাঁধা রক্ত জমা ব্যথা। এই মাটিরই ব্যথা। মাটিতে কান পাতো। শোনো। তুমি প্রথম তো নও। তোমার আগেও শুনেছে অনেকে। ডুবেছে।
কে বলেছে ভালোবাসা ঘর দেয়? পায়ের তলার মাটি কেড়ে নেয় ভালোবাসা। সারা আকাশকে শূন্য করে দেয়। তবু বেঁচে যাবে, যদি নিজেকে শূন্য হতে দাও। কিন্তু অভিমান? সে বিষ। শূন্য পাত্রে বিষ জমিও না। শূন্য পাত্রে শূন্যতার মান থাকুক। তার মর্যাদা রাখো। কিন্তু অভিমান নয়। সে শুধু যন্ত্রণাকে বিষাক্ত করে তোলে। ক্ষুদ্র তোলে। হীন করে তোলে।
অশান্ত হও। শান্ত হও। অকম্পিত থাকো। অস্থির হও। সব হও। কিন্তু অভিমানী হয়ো না। অভিমানের সুখ বিষাক্ত সুখ। নিজের মুখের উপর সবটুকু আলো ফেলে চারদিক অন্ধকার করে বসে থেকো না। সময় নষ্ট হবে। জীবন মানে সময়। জীবন নষ্ট হবে।
বিজ্ঞানী খুঁজছে সমস্ত সৃষ্টির মৌলিক পদার্থটি কি? সাধক খুঁজছে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল সত্যটি কি? কেউ পায়নি। প্রেমিক পেয়েছে। সে বলেছে, শূন্যতা। ভালোবাসা তাকে শূন্য করেছে। নিঃস্ব করেছে। লোভকে অর্থহীন করেছে। ক্রোধকে নির্বিষ করেছে। কামকে উদ্দেশ্যহীন করেছে। ভালোবাসা যদি সাধন হল, তবে আর সাধনের কি দরকার? ভালোবাসা নিজেই সাধ্য, সাধক, সাধেয়।
যদি বলো এমনভাবে মানুষকে ভালোবাসা যায় নাকি?
তাজমহলের পাথরগুলোও তো সাধারণ পাথরই ছিল। কিন্তু পাথরকে কি তাজমহল বলবে? না তাজমহলকে বলবে পাথর?
যদি সে কষ্ট দেয়? প্রবঞ্চনা করে? ঠকিয়ে যায়?
তবে বলব, ভালোবাসাকে ভালোবাসার পাত্রের চাইতে বড় করে নাও। ক্রমে তা-ই হয়। পাত্র যদি ক্ষুদ্র হয় তাতেও কিছু আসে যায় না, যদি ভালোবাসা নির্মোহ হয়। মুক্তো কি করে তৈরি হয় জানো তো? এক ক্ষুদ্র ধুলোকণা ঝিনুকের বুকে বিঁধে মুক্তোর উপাদানকে জাগিয়ে তোলে। ঝিনুক বলে না, তুমি তো সোনা নও, তুমি তো নিতান্ত ধুলোকণা, তোমায় কেন দেব আমার এই মহার্ঘ্য মুক্তোরস? ঝিনুক বলে না। কারণ ঝিনুক বলতে জানে না। ঝিনুককে কেটে চিরে ফেললেও সে মুক্তোই দিতে জানে। অথবা শূন্যতা।
এ এক রাস্তা। আরেক রাস্তা হল নিজেকে সব কিছু থেকে সরিয়ে নেওয়া। সেও হয়। তবে দেখো রুক্ষ হয়ে যেও না। সব বিষয়ে সংশয়ী হয়ে যেও না। সব কিছুর শেষে কোনো নঞর্থক সিদ্ধান্ত টেনে জীবনটা অন্ধকার গুহায় টেনে নামিও না। কাশীতে এক সিঁড়ির তলায়, অন্ধকার ঘরের মধ্যে একবার এক মানুষকে দেখেছিলাম। সে তার পূর্বাশ্রমের কথা বলবে না। অতীত জীবনের উপর এমন ক্ষোভ, ভয়, বিতৃষ্ণা তার। কি নোংরা অপরিষ্কার ঘর তার। কি রুক্ষ মেজাজ। আমি ভাবছিলাম এই অন্ধকার ঘরে, এই রুক্ষতাকে নিয়ে সে কোন ঈশ্বরকে পাবে? নিজের সব কোমল অনুভূতিকে চাপা দিয়ে, নিজেকে রুক্ষ শুষ্ক করে মানুষ কাকে পায়? এক নিস্তরঙ্গ জীবনই কি মানুষের সাধ্য? কি অস্বস্তি লেগেছিল। যে মানুষের খোলা আকাশের নীচে দাঁড়ানোর শক্তি নেই, জীবনের নানা উত্থান-পতনের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি নেই, সে কোন জগত স্রষ্টার কৃপার দিকে তাকিয়ে কালাতিপাত করছে? আমার ভয় লেগেছিল। এ কি আদৌ জীবন?
তবে ভালোবাসার থেকে রোম্যাণ্টিসিজম এর ভূতটাও সরিয়ে দাও। সে এক কালচার। সত্য নয়। বানানো। ভালোবাসার একটাই পরিভাষা জেনো চিরকালের অতৃপ্ত তৃষ্ণা। যাকে ভালোবাসো সে তোমার সামনে এলে নিত্য নিজেকে আবিষ্কার করবে তোমার চোখে। তুমিও নিজেকে আবিষ্কার করবে তার উপস্থিতিতে, তার অনুপস্থিতিতে, রোজ, প্রতি মুহূর্তে।
ভালোবাসা ব্যর্থ হয় না। কামনা ব্যর্থ হয়। স্বপ্ন বিফল হয়। ভালোবাসা যে মুহূর্তে জন্মায় সেই মুহূর্ত থেকেই সে সার্থক। যদি তাকে ঘিরে জন্মানো আগাছাগুলোকে দূরে রাখতে পারো। সব চাইতে বড় আগাছা হল অভিমান। যা দিয়ে শুরু করেছিলাম। নিজেকে বঞ্চিত ভাবার সুখ। ছেড়ে দাও। ক্রমে নিজেকে প্রকাশ করো। সুখে, দুঃখে, আনন্দে, বিষাদে। সব সার্থক হোক ভালোবাসায়। ভালোবাসা দিয়ে গড়া শূন্যতায়। সে শূন্যতায় জন্ম নিক শুদ্ধ জীবন। যে জীবনে ক্ষোভ নেই, লোভ নেই, ক্রোধ নেই। আছে অখণ্ড সার্থকতা। ত্যাগে। ভোগে নয়।
(ছবিটা Smrity Sil Biswas এর তোলা)