ভালোবাসা মানুষকে অভদ্র করে।
কথাটা শুনেই নিশ্চয়ই আঁতকে ওঠার মতই। আসলে সব ব্যক্ত সত্যই আংশিক সত্য। সম্পূর্ণ সত্য মানুষের বোধের কাছে অধরা, সে নিরাকার।
তবে এ অতিশয়োক্তি কেন? ভালোবাসা কেন মানুষকে অভদ্র করবে?
করে তো। ভালোবাসার চাইতে বাঁচতে বেশি দরকার ভদ্রতা। পোশাকি ভদ্রতা না, খাঁটি ভদ্রতা। কিন্তু ওই যে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এক আলাদীনের প্রদীপ তত্ত্ব…. প্রেম প্রেম তত্ত্ব… প্যাম প্যাম…. সে প্রদীপ নাকি যত ঘষা যায় তত সুখ। আলাদীন ভরে ভরে সুখ দিয়ে যায়।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? ভালোবাসা কি দানবের জন্মও দেয় না? মাথার মধ্যে রীতিমতো গোটা একটা দানবকে জন্ম দেয় বলেই যেনা এই সব নৃশংস ঘটনাগুলো আজকাল প্রায়ই রোজ পড়তে হচ্ছে।
ভালোবাসা বড় উসুলে ডিক্টেটর। যদি নিয়মমাফিক নিজের উসুল পাওয়া গেল, তবে তার মত ভালো আর কেউ নেই, আর যদি এট্টুসখানি বিগড়ালো। বাপ রে বাপ! কি অপমান, কি বাজে কথা, কি শাপশাপান্ত, কি বিষাক্ত সব আচরণ। সেই যে কথায় আছে না, "ভিখ চাইনে, কুকুর ঠেকা।" তখন সেই দশা হয়।
ভালোবাসা চাইনে বাপ আমার, মা আমার, ভদ্র হও ভদ্রে…. ওহে মানবসন্তান ভদ্র হও। প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখো, তুমি যে গোত্রের ভালোবাসার কথা বলছ সে ভালোবাসা অণুজীব হতে স্তন্যপায়ী অবধি সবার জীবনে আছে। সোজা কথায় পশুপাখি ইত্যাদি। তারাও কামড়াকামড়ি মারামারি হানাহানি করে - সব এই প্রেমের কারণ। ওহে মনুষ্য, তোমায় প্রেমিক হতে হবে না, তুমি ভদ্র হও। ব্যস, খাঁটি ভদ্র হও। আর কিছু চাই না। দেখো সুখে-দু:খে-রোগে-স্বাস্থ্যে জীবন কেটেই যাবে। সুন্দর চলে যাবে। ভদ্রতা এলেই সুন্দর আসবে। ওই সত্য, শিব সুন্দর তত্ত্ব।
তবে যে এত প্রেমের বাণী! আহা, বাণীগত প্রেম আর উষ্ণ আবেগগত প্রেমের মধ্যে যে ফারাক অনেক। বাণীগত প্রেম কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার মত। আর উষ্ণ আবেগগত প্রেম তিস্তার স্রোতের মত। বিপদ আছে। আমার বাপু তিস্তাও চাই না, ও কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াও চাই না। ম্যালে বসে এক পেয়ালা চা পেলেই জীবন চলে যায়। কুয়াশা আসুক, ঝড়বৃষ্টি আসুক, মনোরম রৌদ্রজ্বল দিন আসুক - কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু ওসব ঝকমারি বড় জ্বালার।
বাণীর যে "স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল" (স্বামীজী), তাকেও প্রণাম করে দূরে রেখে বলি, বাবা তুমি মাথায় থাকো। আর, "মরণেরে করে চিরজীবন নির্ভর" (রবীন্দ্রনাথ), তাকেও বলি, ওহে তোমাকেও আমার দূর থেকে প্রণাম। ওসব মরণের কথা শুনলে আমার ভয় লাগে। যে কথায় কথায় আমার জন্য জীবন দেবে বলে, সে যে কোন কথায় আমার গলায় ছুরি ধরবে, কে জানে বাপু। আমায় ভদ্রতা দাও। আমার আশেপাশে ভদ্র মানুষ দাও। ব্যস, যদি এইটুকু থাকে, সব থাকে তবে। আর দাও, যত অভদ্রতামি, ইতরামি সহ্য করার ভদ্রতা। কঠিন হই অবস্থা বিশেষে, কিন্তু নিষ্ঠুর না হই। কিন্তু ভালোবাসা ওকালতি করে বলে, নিষ্ঠুর হওয়াই যায়, সেকি কম করেছে? আমি কিছু কম করেছি? কিন্তু ভদ্রতা বলে, কেন বাপু, চাট্টি কঠিনকথা বলো, আপত্তি নেই, কিন্তু নিষ্ঠুর হওয়ার তো কোনো যুক্তি দেখি না।
তবে এইসবই হল বাস্তব কথা। কিন্তু জীবন কি আর শুধু বাস্তবে হাঁটে? তার তো নানা অ্যাডভেঞ্চার চাই। অগত্যা, "প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে"। সে প্রেমে আমি ঝিনুক, আমার মধ্যে সুখের মুক্তোরস, এসো, তোমায় ঘিরে ঘিরে আমার মুক্তো বানাই। যদি না আসো, এসো অ্যাসিড ছুঁড়ি, এসো প্রকাশ্য রাস্তায় কোপাই, এসো তোমায় বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে ধর্ষণ করি। আর যদি মুক্তোর আকার-আকৃতি আমার মনের মত না হয়? তবে এসো কুকারে সিদ্ধ হবে, এসো আদাড়েবাদাড়ে কুচি কুচি হয়ে পড়ে থাকবে। আমার ভালোবাসা আমায় অধিকার দেয় পাগল হওয়ার। "হয় তো তোমারই জন্য/ হয়েছি প্রেমে যে বন্য" (সুধীন দাশগুপ্ত)। দরকার কি বাপু! থাকুক অমন প্রেম আমার মাথায়। বন্য না হই, ভদ্র হই।
কিন্তু ওই প্রেম না জন্মালে, জীবন যে ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে…
হুম, তার সম্ভাবনা নেই যে তা নয়। আছে। ওই যে শুরুতেই বললাম, সব প্রকাশিত সত্যই হল আংশিক সত্য।
তবে উপায়? আছে। মোটামুটি একটা আছে। প্রেম আর ভদ্রতার একটা হাইব্রিড মোড। ভালোবাসার ব্ল্যাক ফেজ আর হোয়াইট ফেজ, দুটোতেই যেন ভদ্রতার সীমারেখা কেউ না ছাড়ায়। ছাড়ালেই ফ্ল্যাগ রেইজ করতে হবে। উসুলে ভালোবাসার পায়ে ভদ্রতার শেকল দিতে হবে। নইলে সমস্যা বাড়বে। প্রেমিক / প্রেমিকা লালপিঁপড়ে হলে রাতদিন কাউকে না জানিয়ে কাটবে, ছারপোকার মত নি:শব্দে রক্ত চুষবে, মানে জীবনের সব শান্তি-সুখ-সম্মান চুষবে। আর যদি প্রেমিক / প্রেমিকা ডাকসাইটে হন তবে তো কেটে সিদ্ধ করে থেকে ফ্রীজে জমিয়ে যা তা ইত্যাদি করতেই পারে।
ভদ্র হও ভদ্রে, ওহে মানব সন্তান ভদ্র হও। ভালোবাসো, ক্ষতি নাই। কিন্তু নিজের ধর্ম, দেশ, সংস্কৃতি ইত্যাদি ভালোবাসা যদি অন্যকে খতম করে উদযাপন করতে হয়, তবে থাক বাপু। আর সে ভালোবাসার উসুলে আঘাত এলে যদি খুনখারাপি অবধি যেতে হয়, সেও থাক বাপু। তার চাইতে ভদ্রতাই থাক। খাঁটি ভদ্রতা।
উপনিষদের শান্তিপাঠে আছে…
আমরা যেন শোভনীয়, ভদ্র যা কিছু শ্রবণ করি, আমরা যেন শোভনীয়, ভদ্র যা কিছু দর্শন করি… আমাদের আয়ু যেন দৃঢ় সবল শরীরে ভদ্রতার স্তবেই অতিবাহিত হয়। শান্তি, শান্তি, শান্তি।