নিস্তারবাবু নাস্তিক মানুষ। কিন্তু মনে প্রাণে বাঙালি। শ্যামাসংগীত শুনলে, কীর্তন শুনলে চোখে জল আসে। মহালয়ায় বীরেন্দ্রবাবুর গলা শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু এদিকে তিনি ডাকসাইটে নাস্তিক মানুষ। বিজ্ঞান সভাটভা করেন। তো এই দুর্গাপুজোর সময় মহা ফ্যাসাদে পড়েন। চাঁদাও দিতে হয়। পাড়া-সমাজের তাগিদে প্যাণ্ডেলেও বসতে হয়। এখন কি করেন?
নিস্তারবাবু এ দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রায় ষাট বছর বেঁচে। নিস্তারবাবুর স্ত্রী আবার ভীষণ ধার্মিক। ষোলোকলাদেবী হেন কোনো দেবদেবী নেই যা মানেন না, বা এমন কোনো অবতার নেই যাঁকে তিনি স্বীকার করেন না। সে আব্রাহাম থেকে বারের ঠাকুর সব। কিন্তু সেই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে কোনো কোন্দল নেই। বেশ শান্তির সংসার। দ্বন্দ্ব শুধু নিস্তারবাবুর মনে।
ষষ্ঠীর দিন সকালে নিস্তারবাবু বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, এমন সময় ষোলোকলাদেবী এসে বললেন, এই নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি রেখে গেলুম, নতুন গেঞ্জি-জাঙিয়াও…. পরে নিওখন স্নান করে।
এইবার? নিস্তারবাবু ব্যাজার মুখে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। পাশেই খাটা রাখা নীল পাঞ্জাবির থেকে নতুন জামার গন্ধ আসছে। ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। মা বাপির কথা মনে পড়ছে। মনটা হঠাৎ মেঘলা দুপুরের মত ভারি হয়ে উঠল। ইচ্ছা করছে বাথরুমে গিয়ে একটু কাঁদেন, কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো আর ওঠা যাবে না। পাশের বাড়ির তিন্নি, ক্লাস থ্রিতে পড়ে, হোয়াটসঅ্যাপ করেছে এখনি আসছে নতুন জামা পরে দেখাতে। সেল্ফি তুলবে সে দাদু দিদার সঙ্গে। অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
কিছুক্ষণ পর পর দুবার এসে তাগাদা দিয়ে গেলেন ষোলোকলাদেবী। কিন্তু মেয়েটা….
নতুন জামাটা কোলে নিলেন। শুঁকলেন। নতুন জুতো কিনতে ইচ্ছা করছে। লজ্জাও লাগছে। কিন্তু ইচ্ছাও তো করছে। কি করেন? বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সেল্ফে রোজ পরা জুটোটা রাখা। জুতোটা এমন কিছু পুরোনো হয়নি, এই ফেব্রুয়ারিতেই তো কেনা। এবার? কিন্তু নতুন জুতোর গন্ধ পেতে ইচ্ছা করছে যে।
তিন্নি এলো। লাল একটা ফ্রক পরে। হাতে স্মার্টফোন। এসেই বলল, চলো… দিদা… ও দিদা… এদিকে এসো….
ষোলকলাদেবী দুটো লাড্ডু নিয়ে ঢুকলেন ঘরে। ছবি তোলা হল। নিস্তারবাবুর মন এদিকে উসখুস করছে নতুন জুতোর জন্য। তিনি তিন্নিকে বললেন, এ বাবা, তোর নতুন জুতো কই?
তিন্নি বলল, আরে ক’দিন আগেই কিনলাম তো… তাই মা-বাপি বলছে এখন না… আবার নতুন ক্লাসে…
নিস্তারবাবু বললেন, ধুস.. চ… কিনে আনি গে….
তিন্নি বলল, দাঁড়াও মাকে বলে আসি..
তিন্নির মা এসে কবার আপত্তি করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
ষোলোকলাদেবীকেও নিয়ে নিস্তারবাবু চললেন টোটো করে জুতোর দোকান। রাস্তায় যত ঠাকুর পড়ে তিন্নি আর ষোলোকলাদেবী মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। নিস্তারবাবুর লজ্জা লাগে। বেমানান লাগে নিজেকে। তিন্নি দু’বার বকাও দিল। ঠাকুর রাগ করবেন শাসালোও। তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে হাতদুটো জড়ো করিয়ে নিস্তারবাবুর মাথায় ঠেকাতে ঠেকাতে বলল, তবে লালজুতোই ভালো।
দোকানে বেশ ভিড়। তবু তিনজনে ঠেসেঠুসে বসার জায়গা করে নেওয়া গেল। লালজুতো পছন্দ করতে আর তিন্নির কত সময় লাগবে, পাঁচ মিনিটেই হয়ে গেল। এবার তো উঠতে হবে। নিস্তারবাবুর ভীষণ লজ্জা লাগছে এবার। কি ছেলেমানুষী হয়ে গেল। কিন্তু উঠতে তো হবেই। বাচ্চা তো নন। উঠতে যাবেন… হঠাৎ দেখেন পাশে ষোলোকলাদেবী নেই। এত ভিড়ে কোথায় গেল?
তিন্নি বলল, দিদা কই দাদু?
নিস্তারবাবু কিছু বলতে যাবেন এমন সময় চেনা গলায় ডাক এলো… এদিকে একবার দেখে যাও তো…
কাঁচের মধ্যে সার দেওয়া চামড়ার চটি। ছেলেদের। ষোলোকলাদেবী বললেন, দেখো তো….
লজ্জায় কান গরম। ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বললেন না। বরং জোর করে ষোলোকলাদেবীর সকালে হাঁটতে যাওয়ার জন্যও একটা জুতো কিনে দোকান থেকে বেরোলেন। নিজেরটা তো কেনা হলই।
টোটোতে মুখোমুখি বসে দু’জন। তিন্নি দাদুর মোবাইল ঘাঁটছে।
কি কথা বলবেন? হঠাৎ কি হল, বললেন, এই সব পুজোটুজো মনের কুসংস্কার। আসলে জগতটা একটা বিজ্ঞানে চলছে….
তিন্নি বলল, আহা দাদু… দিদুনকে কেন বকছ?
ষোলোকলাদেবী বললেন, বকছে না সোনা… দাদু পড়া বলছে। আজ দাদুর পরীক্ষা ছিল। ধরা পড়ে গেছে।
তিন্নি মোবাইলটা থেকে চোখ তুলে বলল, কি ধরা পড়ে গেছে গো….
ষোলোকলাদেবী বললেন, পরে বলব।
বাড়ি এসে জুতোটা প্যাকেট থেকে বার করে প্রাণভরে শুঁকলেন। ষোলোকলা স্নানে গেছে। এখন আধঘন্টা। মায়ের কথা, বাপির কথা, দাদার কথা, দাদু-দিদা, ঠাকুর্দা, ঠাকুমা সবার কথা মনে পড়ল। পুজোয় সবার কথা মনে পড়ে। কেউ নেই এই মাটিতে। এইবার কান্না পাচ্ছে। কষ্টের কান্না ঠিক না। আবার আনন্দের কান্নাও নয়। আশ্বাসের কান্না। যেন কাঁদলে তারা শুনবে। তারা সবাই আছে। আছে, আছে, সব আছে। আছেকে বিশ্বাস করাই তো আস্তিক। ভালোবাসায় সব বাঁধা আছে। হঠাৎ "মা" বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। খাটে রাখা নতুন পাঞ্জাবি মানে মা। নতুন পায়জামা মানে মা। জুতোটাও মা।
পিঠে হাত।
ষোলোকলা দাঁড়িয়ে। পিছনে তিন্নি। দুজনের চোখেই জল। তিন্নি কোলে উঠে বসল। বলল, আমি তোমায় নতুন জুতোটা দেখাতে এসেছিলাম… তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে… মায়ের জন্য? এই তো আমি…
ষোলোকলা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বাচ্চাই থেকে গেলে…
ধরা গলা ষোলোকলার। নিস্তারবাবু ষোলোকলাদেবীর হাতটা বুকের উপর ধরে বললেন, সব আছে জানো… এখানে…
ষোলোকলাদেবীর চোখ থেকে বড় বড় দু’ফোঁটা জল পড়ল, তিনি মাথা নাড়লেন শুধু। মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে নাড়া মানে তো "হ্যাঁ"। নিস্তারবাবুরও চোখ উপচে জল। তিন্নি মুছিয়ে বলল, কাঁদছ কেন, এই তো আমি।
নিস্তারবাবু ষোলোকলাদেবীকে বললেন, তুমি স্নানে গিয়েছিলে না….
ষোলোকলাদেবী বললেন, শ্যাম্পুর পাতা নিতে বেরিয়েছিলাম….
নিস্তারবাবু অস্ফুটে বললেন, ভাগ্যিস….