সৌরভ ভট্টাচার্য
23 January 2018
ভবাকান্তবাবু
==========
ভবাকান্ত দুপুরে ভাত আর অল্প একটু ডাল তরকারি খেলেন। বাইরের বারান্দাটায় এখন রোদ। খেয়ে উঠে বসবেন। খাওয়ার থেকে রোদে বসার তাড়া বেশি।
গায়ে একটা শাল। শালটার বয়েস পঁচিশ। তার বয়েস একাশি। চেয়ারে বসলেন। মুখটা রোদের বাইরে রেখে চোখ বুজে শুলেন। মাইকের গান আসছে "চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে জো দিলকো"। সামনের ক্লাবে চলছে। উপরে পতাকা, নীচে নেতাজি। চারদিকে চারটে দড়ি। তাতে ছোটো ছোটো পতাকা। যাননি এবার দেখতে, তবু জানেন। নেতাজির জিলিপি খেতেও মন চায়নি। অম্বল হয়। কম দামী তেলে ভাজা।
সামনের ফ্ল্যাটের লোকটা ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ালো। হাতে স্মার্টফোন। অফিস ছুটি তো আজ। হাতে খবরের কাগজ লোকটার। ভবাকান্ত খবরের কাগজ পড়েন না। আগে পড়তেন। তারিখ দেখতে না পেলে কোনদিনের কাগজ আলাদা করতে পারেন না। তারিখ বড্ড ছোটো করে লেখা থাকে। চোখে দেখেন না।
ঝিমুনিটা উঠছে পায়ের থেকে উপরের দিকে। এই সময়টা স্বপ্ন দেখেন ভবাকান্তবাবু। এই সময়ের স্বপ্নগুলো তার কথা শোনে। তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মত। তিনি একটা প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন। সামনের ফ্ল্যাটটার তলায় যে দীঘিটা মাথা নীচু করে পড়ে আছে, সেটা মাথা তুলে এক ঝাঁকি দিয়েছে। ফ্ল্যাটটা উড়ে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। দীঘির জল টলটল করছে আবার আগের মত। সারি সারি পরিযায়ী পাখি। কয়েকটা গত বছরও এসেছিল। ভবাকান্তবাবু চিনতে পারেন। এখনও পারছেন।
মাইকে গান চেঞ্জ হল। 'দিল দিয়া হ্যায়...'..পুরুষ কণ্ঠ। ভবাকান্তবাবুর চোখ বন্ধ। চোখ খুললেই স্বপ্নরা উড়ে যায়। ভবাকান্তবাবু স্বপ্ন দেখছেন আবার। ইচ্ছা স্বপ্ন। ছেলেটা যেন নিউজিল্যাণ্ড গেল না। যেন তার পাশের ঘরে। তার গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। সে বলছে আজ বিকালেই চোখের ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে যাবে। সামনের সপ্তাহে চোখ কাটবে।
পায়ে কি লাগল? চোখ খুললেন ভবাকান্ত। কুকুরের বাচ্চাটা, পা চাটছে। যাঃ...যাঃ...
চলে গেল। ভবাকান্তবাবুর সারাগায়ে তুলোর মত আদুরে রোদ। এরা এখন নিউজিল্যাণ্ডের রোদ। প্রচণ্ড তীব্র ছোঁয়া। বাবুর মত।
একটার পর একটা পতাকায় ঢেকে যাচ্ছে মাটি। ধানের রঙ, মাটির রঙ সব রঙ পতাকায় মাখামাখি। বীজগুলোর গলা চিপে ধরেছে লোহার কল। বড় বড় মেশিন। বীজগুলো চিঁ চিঁ চীৎকার করতে করতে মরে যাচ্ছে। লাথি মারছে চারাগাছগুলোর উপরে বুট পরা কিছু লোহার পা। কুকুরের মত মরছে গাছ। চারাগাছগুলো।
আকাশ থেকে নামছে কালো ঝুলের মত জাল। মানুষগুলো আটকে পড়ে ছটফট করছে এখানে ওখানে। ছাড়াতে গেলে আটকে যাচ্ছে আরো। তার ছেলের হাতে পায়ে আটকে মিহি কালো সূতোর জাল। নাক চোখ টিপে ধরছে ধীরে ধীরে। একটা বাচ্চা ছেলে জালে আটকে কাঁদছে। তার আধার কার্ডের নাম্বারটা কাকে খুঁটে খেয়ে গেছে। ছেলেটার গায়ে আতরের গন্ধ। কিসের আতর শুঁকে দেখছে কারা যেন। তাদের হাতে প্রাচীন হরফে লেখা বই। সেই বইয়ের পাতায়, আটকে অজস্র মানু্ষের কাটা হাত পা।
ভবাকান্তবাবু ঘামছেন। ঘুম ভাঙল। বাড়ির লোক বলল রোদ লেগে। প্রতিবেশী বলল প্রেসার বেড়ে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, মন্ত্রীরা এসে পৌঁছিয়েছেন। মাল্যদান হবে। নেতাজীর ছবির কাঁচে মন্ত্রীর দাঁতের প্রতিচ্ছবি। সেই হাসি দেখে জব্বর পাগলা হেসে কুটিপাটি। বলছে জব্বর হাসিখান। আমার বাড়ির জন্য টাকা ছ্যাংছান হলোনি, সেই টাগাতে মন্ত্রীবাবুর মোতার জায়গা হয়ে গেল। আমার শোয়ার জায়গা হল না।
জব্বরকে চ্যাংদোলা করে বের করে নিয়ে গেল। মাইকে গান হচ্ছে - ভারত আমার ভারতবর্ষ। ভবাকান্তবাবু শেষ চেয়ারটায় বসে ঘুমোচ্ছেন। ভাষণ দিচ্ছেন মন্ত্রী।
ভবাকান্তবাবু আবার স্বপ্ন দেখছেন। অনিচ্ছা স্বপ্ন। হাতের উপর একটা মাকড়সা বসে। মাকড়সার রঙ বদলাচ্ছে গিরগিটির মত। তার চারদিকে সেই জালটা। জালের ভিতর একটা নদী। নদীটা পাগল হয়ে গেছে। নদীটা সমুদ্র খুঁজে পাচ্ছে না। নদীটার পিছনে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে একটা শকুন।
==========
ভবাকান্ত দুপুরে ভাত আর অল্প একটু ডাল তরকারি খেলেন। বাইরের বারান্দাটায় এখন রোদ। খেয়ে উঠে বসবেন। খাওয়ার থেকে রোদে বসার তাড়া বেশি।
গায়ে একটা শাল। শালটার বয়েস পঁচিশ। তার বয়েস একাশি। চেয়ারে বসলেন। মুখটা রোদের বাইরে রেখে চোখ বুজে শুলেন। মাইকের গান আসছে "চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে জো দিলকো"। সামনের ক্লাবে চলছে। উপরে পতাকা, নীচে নেতাজি। চারদিকে চারটে দড়ি। তাতে ছোটো ছোটো পতাকা। যাননি এবার দেখতে, তবু জানেন। নেতাজির জিলিপি খেতেও মন চায়নি। অম্বল হয়। কম দামী তেলে ভাজা।
সামনের ফ্ল্যাটের লোকটা ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ালো। হাতে স্মার্টফোন। অফিস ছুটি তো আজ। হাতে খবরের কাগজ লোকটার। ভবাকান্ত খবরের কাগজ পড়েন না। আগে পড়তেন। তারিখ দেখতে না পেলে কোনদিনের কাগজ আলাদা করতে পারেন না। তারিখ বড্ড ছোটো করে লেখা থাকে। চোখে দেখেন না।
ঝিমুনিটা উঠছে পায়ের থেকে উপরের দিকে। এই সময়টা স্বপ্ন দেখেন ভবাকান্তবাবু। এই সময়ের স্বপ্নগুলো তার কথা শোনে। তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মত। তিনি একটা প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন। সামনের ফ্ল্যাটটার তলায় যে দীঘিটা মাথা নীচু করে পড়ে আছে, সেটা মাথা তুলে এক ঝাঁকি দিয়েছে। ফ্ল্যাটটা উড়ে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। দীঘির জল টলটল করছে আবার আগের মত। সারি সারি পরিযায়ী পাখি। কয়েকটা গত বছরও এসেছিল। ভবাকান্তবাবু চিনতে পারেন। এখনও পারছেন।
মাইকে গান চেঞ্জ হল। 'দিল দিয়া হ্যায়...'..পুরুষ কণ্ঠ। ভবাকান্তবাবুর চোখ বন্ধ। চোখ খুললেই স্বপ্নরা উড়ে যায়। ভবাকান্তবাবু স্বপ্ন দেখছেন আবার। ইচ্ছা স্বপ্ন। ছেলেটা যেন নিউজিল্যাণ্ড গেল না। যেন তার পাশের ঘরে। তার গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। সে বলছে আজ বিকালেই চোখের ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে যাবে। সামনের সপ্তাহে চোখ কাটবে।
পায়ে কি লাগল? চোখ খুললেন ভবাকান্ত। কুকুরের বাচ্চাটা, পা চাটছে। যাঃ...যাঃ...
চলে গেল। ভবাকান্তবাবুর সারাগায়ে তুলোর মত আদুরে রোদ। এরা এখন নিউজিল্যাণ্ডের রোদ। প্রচণ্ড তীব্র ছোঁয়া। বাবুর মত।
একটার পর একটা পতাকায় ঢেকে যাচ্ছে মাটি। ধানের রঙ, মাটির রঙ সব রঙ পতাকায় মাখামাখি। বীজগুলোর গলা চিপে ধরেছে লোহার কল। বড় বড় মেশিন। বীজগুলো চিঁ চিঁ চীৎকার করতে করতে মরে যাচ্ছে। লাথি মারছে চারাগাছগুলোর উপরে বুট পরা কিছু লোহার পা। কুকুরের মত মরছে গাছ। চারাগাছগুলো।
আকাশ থেকে নামছে কালো ঝুলের মত জাল। মানুষগুলো আটকে পড়ে ছটফট করছে এখানে ওখানে। ছাড়াতে গেলে আটকে যাচ্ছে আরো। তার ছেলের হাতে পায়ে আটকে মিহি কালো সূতোর জাল। নাক চোখ টিপে ধরছে ধীরে ধীরে। একটা বাচ্চা ছেলে জালে আটকে কাঁদছে। তার আধার কার্ডের নাম্বারটা কাকে খুঁটে খেয়ে গেছে। ছেলেটার গায়ে আতরের গন্ধ। কিসের আতর শুঁকে দেখছে কারা যেন। তাদের হাতে প্রাচীন হরফে লেখা বই। সেই বইয়ের পাতায়, আটকে অজস্র মানু্ষের কাটা হাত পা।
ভবাকান্তবাবু ঘামছেন। ঘুম ভাঙল। বাড়ির লোক বলল রোদ লেগে। প্রতিবেশী বলল প্রেসার বেড়ে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, মন্ত্রীরা এসে পৌঁছিয়েছেন। মাল্যদান হবে। নেতাজীর ছবির কাঁচে মন্ত্রীর দাঁতের প্রতিচ্ছবি। সেই হাসি দেখে জব্বর পাগলা হেসে কুটিপাটি। বলছে জব্বর হাসিখান। আমার বাড়ির জন্য টাকা ছ্যাংছান হলোনি, সেই টাগাতে মন্ত্রীবাবুর মোতার জায়গা হয়ে গেল। আমার শোয়ার জায়গা হল না।
জব্বরকে চ্যাংদোলা করে বের করে নিয়ে গেল। মাইকে গান হচ্ছে - ভারত আমার ভারতবর্ষ। ভবাকান্তবাবু শেষ চেয়ারটায় বসে ঘুমোচ্ছেন। ভাষণ দিচ্ছেন মন্ত্রী।
ভবাকান্তবাবু আবার স্বপ্ন দেখছেন। অনিচ্ছা স্বপ্ন। হাতের উপর একটা মাকড়সা বসে। মাকড়সার রঙ বদলাচ্ছে গিরগিটির মত। তার চারদিকে সেই জালটা। জালের ভিতর একটা নদী। নদীটা পাগল হয়ে গেছে। নদীটা সমুদ্র খুঁজে পাচ্ছে না। নদীটার পিছনে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে একটা শকুন।
উঠুন...ও দাদা...উঠুন...বাড়ি যাবেন তো....
ভবাকান্ত চোখ মেলে দেখলেন তার ছেলে। জিন্সের জ্যাকেট পরে। মুখটা বদলে গেছে অনেক। তবু চিনেছেন ভবাকান্ত। খামচে ধরলেন ছেলেটার কলার। সবাই রে রে করে তেড়ে এলো... আরে ওই পাগলা বুড়োটা আবার এসেছে.. কেন যে তোরা খেয়াল রাখিস না....
ভবাকান্ত হো হো করে হাসছে... নেতাজির ছবির মালায় কয়েকটা মৌমাছি। তেড়ে আসছে। ভবাকান্তবাবু কলার ছেড়ে দৌড়াচ্ছেন... চীৎকার করে বলছেন.. ভাগ.. ভাগ... ভাগ...
ভবাকান্ত চোখ মেলে দেখলেন তার ছেলে। জিন্সের জ্যাকেট পরে। মুখটা বদলে গেছে অনেক। তবু চিনেছেন ভবাকান্ত। খামচে ধরলেন ছেলেটার কলার। সবাই রে রে করে তেড়ে এলো... আরে ওই পাগলা বুড়োটা আবার এসেছে.. কেন যে তোরা খেয়াল রাখিস না....
ভবাকান্ত হো হো করে হাসছে... নেতাজির ছবির মালায় কয়েকটা মৌমাছি। তেড়ে আসছে। ভবাকান্তবাবু কলার ছেড়ে দৌড়াচ্ছেন... চীৎকার করে বলছেন.. ভাগ.. ভাগ... ভাগ...