Skip to main content

বারাকপুর স্টেশানে নামতে গিয়ে পাঞ্জাবির পকেটটা ছিঁড়ে গেল। একটা লোকনাথ বাবার ছবি, লটারির টিকিট, ট্রেনের টিকিট স্টেশানের কোথায় যে পড়ল বোঝার আগেই ধাক্কাধাক্কিতে বিশ্বনাথ স্টেশানের দরজার কাছে, টিটি নেই। ভীষণ জোর বৃষ্টি পড়ছে, সন্ধ্যে হতে ঘন্টাখানেক দেরি, তাও মেঘের জন্য অন্ধকার বড্ড আগে আগে হয়ে গেছে যেন। ছাতাটা কাঁধের কাপড়ের ব্যাগ থেকে বার করল বিশ্বনাথ। অটোর লাইনে দাঁড়াতে হবে। গায়ে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, টাকের সামনের দিকে একটা জরুল, মাথার পিছনের দিকে সাদাপাকা চুল, বয়েস বাহান্ন, যদিও দেখে মনে হয় ষাটের ঘরে বয়েস।

      অটোতে বসে ভিজে ছাতাটা কাপড়ের ব্যাগের মধ্যে ভরে পায়ের কাছে ব্যাগটা নামিয়ে রাখল। অটোতে মাঝখানে বসেছে, তার একদিকে স্কুলের এক ছাত্রী, ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ে মনে হয়, ডানদিকে এক মহিলা, মধ্যবয়েসী, গা থেকে পেঁয়াজের গন্ধ আসছে, দেখে মনে হচ্ছে সব্জী-টব্জি বিক্রি করে হয়ত। সামনে দুটো কমবয়েসী ছেলে। অটো ধোবিঘাট অবধি যাবে। প্রচণ্ড বৃষ্টি দু'দিন ধরেই চলছে, তাই অটো কম, আর বেশিদূর যাবেও না তা আগেই বলে দিয়েছে।
      ধোবিঘাটে সবাই নেমে গেল। বিশ্বনাথ নামল না। বলল, "আগে চলুন।"
      অটোওয়ালা মুখটা বিকৃত করে বলল, "কেন দাদা আগেই তো বলেছি, যাব না আর, নামুন, নয়ত স্টেশানে চলুন আবার।"
      বিশ্বনাথ বসে রইল। মুখে কোনো বিকার নেই। ডানদিকে প্লাস্টিক টানা বৃষ্টির ছাঁটের জন্য, বাঁদিকটা খোলা। লোক নেই রাস্তায় বেশি। অটোওয়ালা ঘুরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারছে বিশ্বনাথ, তবুও তার মুখে কোনো বিকার নেই।
অটোওয়ালা বলল, "মাল খেয়েছেন? কেন বাওয়াল করছেন? এখন অফিস টাইম, অনেকগুলো ট্রিপ, নামুন না দাদা প্লিজ।"

      "না।"
      চুপ করে বসে আছে বিশ্বনাথ। একজন বয়স্ক মানুষ এসে জিজ্ঞাসা করল, "গাড়ি ঘোরাও, স্টেশানে যাবে তো?"
      অটোওয়ালা এবার যেন তার বিহ্বলভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারল, বলল, "আরে দেখুন না ইনি নামছেন না তো, কি করে নিয়ে যাই বলুন?"
      আগত প্যাসেঞ্জার বিরক্তির মুখ নিয়ে মধুর স্বরে বললেন, "ও মশাই! কি ছেলেমানুষী করছেন? নামুন না, আমার যে স্টেশানে যেতেই হবে, ইয়ে চেপে গেছে জোরে, মানে বড় বাইরে, প্লিজ নামুন না... স্টেশানে না গেলে সারতে পারছি না..."
"না", বিশ্বনাথ চোখটা বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসল।
      ইতিমধ্যে আরো দু'জন এসে গেছে। অটো নেই এই একটা ছাড়া। তারাও পীড়াপীড়ি শুরু করেছে, "ও দাদা নামুন না", "ও কাকা নামুন না", "ও মশাই নামুন না..."; কেউ বলছে, "ভিজে গেলুম যে..."; কেউ বলছে, "ও দাদা কি হয়েছে আমায় বলবেন?"... একজন বলল, "দাদা ভাড়া দেওয়ার টাকা নেই?"... প্রথমজন কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, "ও দাদা আমার যে এখানেই হয়ে যাবে এবার... কি করেন..."

      বিশ্বনাথ চোখ বুজেই বলল, "আর দু'মিনিট।" কিন্তু ততক্ষণে উত্তেজনা চরমে পৌঁছিয়েছে। কেউ শুনল না। বিশ্বনাথকে টেনে নামাল সবাই। বিশ্বনাথ প্রতিবাদ করল না। লোকগুলো ঝাঁপিয়ে অটোতে উঠেই বলল, "ঘোরাও..."
      অটোটা ঘুরতে না ঘুরতেই একটা প্রচণ্ড স্পিডে আসা ৮৫ রুটের বাস ধাক্কা মারল। অটোটা ছিটকে রাস্তার একধারে গিয়ে দুমড়ে মুচড়ে পড়ল। বিশ্বনাথ এগিয়ে গেল, ধীর পায়ে, "স্পট ডেড", অস্ফুটে বলল, "আর দু'মিনিট অপেক্ষা করলেন না আপনারা!"

      বিশ্বনাথ হাঁটতে শুরু করল। কেন এরকম হয়? জানে না। কিন্তু একটা কিছু হয়। বুঝতে পারে। শরীর খারাপ লাগে। মাথাটা ঝিনঝিন করে। কবে শুরু হল? মনে নেই। তবে মেয়েটা মারা যাওয়ার পর থেকেই মনে হয়। সেই প্রথম...

      মেয়েটা কলেজে পড়ে। বিশ্বনাথের কাপড়ের ব্যবসা। বড়বাজারে যেতে হয় প্রায়ই। সেদিন মেয়েটার জ্বর। সামান্য সর্দিকাশির জ্বর। বিশ্বনাথ খেতে বসেছে, বেরোবে, বড়বাজারে, হঠাৎ মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে তার গলার ভাত আটকে গেল। মেয়েটাকে বলল, "আজ বাড়ি থাকিস না। কলেজে যাস। বিশ্বনাথ বিপত্নীক।" শুভ্রা বলল, "পারব না বাপী, আজ কোনো ক্লাস নেই সেরকম, আর মাথাটাও ব্যথা প্রচণ্ড।"
      বিশ্বনাথ ভাবল, তবে কি তার মনের ভুল? হঠাৎ করে পিছনে তাকাল, কই ভুল নয়তো? ওই তো একটা মাকড়সা একটা আরশোলাকে ধরে খাচ্ছে। এই তো দেখেছিল, তবে? কি হচ্ছে তার?
      বিশ্বনাথ অন্যমনস্ক হয়ে বলল, "আচ্ছা।"

      সারাটা দিন বাজারে অন্যমনস্ক কাটল। বাজারের মিত্তিরদা বললেন, "আপনার কি কিছু হয়েছে?" মিত্তিরদার থেকেই বরাবর শাড়ি তোলে বিশ্বনাথ। বিশ্বনাথ বলল, "মেয়েটার জ্বর।" বলেই দোকান থেকে উঠে গিয়ে বাইরে এসে কল করল,
      "হ্যলো?"
      "হ্যাঁ রে, জ্বরটা ছেড়েছে?"
      "হ্যাঁগো বাপি, তুমি ভেবো না, আমি ঠিক আছি।"
      "তুই তাহলে আজকে টিউশানটায় যাবি না?"
      "না বাপি, ইচ্ছা করছে না।"
      "আচ্ছা, আমি আসছি দেখি তাড়াতাড়ি।"

      মাথার মধ্যে অস্পষ্ট কথাবার্তা, ফিসফাস।হঠাৎ কি হল, দৌড়ে সামনের গলিটা থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের বড়দোকানে ঢুকল, বলল, "তাড়াতাড়ি আপনাদের গোডাউনে যান তো..."
      বিশ্বনাথকে সবাই চেনে এখানে মোটামুটি। এই দোকানের মালিক একজন মারোয়াড়ী, সে চমকে উঠে বলল, "কেন বলুন তো..."
      বিশ্বনাথকে উত্তর করতে হল না, আগুন লেগেছে শর্টসার্কিট হয়ে।
      বিশ্বনাথ একটা কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে এগোল। সময় মত ট্রেন পেল। অন্তত পাঁচবার মেয়েটার সাথে কথা হয়েছে। বারাকপুর স্টেশানে নামল। অটোর লাইন ছিল না। দুটো বাজে। কিন্তু ছাড়তে দেরি করছে কেন এত? আসলে এই সময় প্যাসেঞ্জার কম হয়। রিজার্ভ করে নিল অটোটা। অটো ছাড়ল। রাস্তায় জ্যাম। অসহ্য লাগছে, দৌড়ে যাবে কিনা ভাবছে। চোখটা বন্ধ করে শরীরটাকে শক্ত করে সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। জীবনটা কেমন ঘেঁটে যাচ্ছে। এক এক সময় মনে হয় একাকীত্বের জন্য হচ্ছে কি এইসব? কিন্তু ভালোবাসা পাড়ার গলির মত চেনা শব্দ এখন। সব বাঁকগুলো চেনা। সমস্যাটা কেউ নেই তা নয়, সমস্যাটা হল কারোর দরকার নেই মনে হয় জীবনে। যৌবনের দিনগুলো মনে পড়ে, "তোমায় ছাড়া বাঁচব না".. বলেছিল। এখন কাউকে বলতে ইচ্ছা করে না।
      "দাদা, এসে গেছে"
      যত বাড়ির দিকে এগোচ্ছে তত বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। গলার কাছে দম আটকে আছে। মেয়েটা ফোন ধরছে না কেন? যা জ্বর স্নানে তো যাবে না। তবে? বাড়ির কাছে যেতেই চমকে উঠল, রান্নাঘরের জানলা দিয়ে দাউদাউ করে আগুন বেরোচ্ছে।
      মেয়েটাকে চেনাই যাচ্ছিল না। সিলিণ্ডার ফেটে গিয়েছিল।

      অনেকটা হেঁটে এসেছে বিশ্বনাথ। একটা চায়ের দোকানে বসেছে। এখানেই বিকালে পাঁউরুটি-ঘুঘনি খেয়ে বাড়ী যায়। তারপর আর কিছু খায় না। রাতে মুড়ি বা বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়ে। যে চা দিতে আসে সেই বাচ্চাটাকে দেখেই বিশ্বনাথ বলে ফেলল, "আজ রাতে বাড়ি ফিরিস না, দোকানেই থাকিস।"
      এরপর কি হয়েছিল জানার জন্য বিশ্বনাথ আর ছিল না। বিশ্বনাথ সেদিন রাতেই আত্মহত্যা করে। পরে জানা যায় ছেলেটার বাড়িতে সেদিন কিছুই হয়নি। এটা মাঝেমাঝেই হয়। তেমন কিছু হয় না। বিশ্বনাথ অপমানিত বোধ করে। যেন হেরে গেছে। জীবন তো লটারি। তার ক্ষমতাটা হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে? তবে অটোটা? কাকতালীয়?
      আসলে বিশ্বনাথ শেষের দিকে বুঝে উঠতে পারছিল না কোনটা সে দেখছে আর কোনটা তাকে দেখানো হচ্ছে। যেমন তার মাঝরাতে মনে হয়েছিল মেয়েটা একটা দড়ি নিয়ে এসে তাকে বলছে, "বাবা এসো।"