প্রভাব কার বেশি? শক্তির, না নীতির? এর কোনো স্পষ্ট উত্তর নেই। নীতি আলোচনার। কূটনীতি, উদারনীতি ইত্যাদি। কিন্তু সেই নীতিকে বাস্তবে আনবে কে? শক্তি। কোন শক্তি? প্রশাসনিক শক্তি। তবে নীতি কার উপর নির্ভর করছে? প্রশাসকের উপর।
তালিবানের শক্তি আছে। ক্ষমতা আছে। হেলিকপ্টারে সারা বিশ্বের সামনে মানুষ ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা আছে। এ ক্ষমতা জন্মানোর বর্বরতা আছে। সে বর্বরতার সমর্থনে ভাষ্য আছে। সে ভাষ্যে একমত হওয়ার বহু মানুষ আছে। সংগঠন আছে। সে সংগঠনের শক্তি আছে। ক্ষমতা আছে। নিষ্ঠা আছে। আত্মত্যাগের ব্রত আছে। লড়াই আছে। সব আছে। কি নেই?
মনুষ্যত্ব নেই। মনুষ্যত্বের প্রভাব জনজীবনে কতটুকু? মানুষ কতক্ষণ মানুষ? মানুষের নীতির দরকার কি? মানুষের নীতির দরকার কারণ খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদি জিনিস সীমিত। মানুষকে ভাগ করে নিতে হবে। আমি একা সবটা নেব বললে চলবে না। মানুষ বহুযুগ আগে বুঝেছিল এ কথাটা। বাড়িতে যদি একটা বাথরুম থাকে, সীমিত জল থাকে, তবে স্নানের জন্য একটা নিয়ম বানাতে হয়। সেই নিয়মে সবাই অন্তত প্রাথমিক দরকারটুকু মিটিয়ে নিতে পারে। সব ক্ষেত্রেই এই নিয়ম। লাইন করে দাঁড়ানো। অপেক্ষা করতে শেখা। ধৈর্য ধরতে শেখা। এ সবেরই মূল কারণ একটাই যাতে সবাই অন্তত সুযোগটা পায়।
এর সমর্থনে কোনো তথাকথিত ধর্মগ্রন্থ ইত্যাদি সোচ্চার কোনোদিন হয়নি। কারণ আজ অবধি কোনো ধর্মগ্রন্থ মেয়েদের সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে গণ্য করেনি। তবে এই নীতির উৎসের সমর্থনে মানুষের বিবেকে নিশ্চয়ই কোথাও একটা সমর্থন নিশ্চয়ই ছিল, নইলে রাজার যুগ থেকে আজকের গণতন্ত্রে এসে আমরা পৌঁছাতাম না।
তবে গণতন্ত্রের বোধ আমাদের জন্মেছে আমাদের মৌলিক অধিকারবোধ থেকে। মানুষের মৌলিক অধিকার কি? একটাই - স্বাধীনতা। মানুষ অধীনতার সীমাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাকে বীরত্ব বলেছে। তার যে কোনো অভিযান আদতে তার প্রকৃতিদত্ত সীমাকে অতিক্রম করার উদ্যম। সে হিমালয়জয় হোক কি ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার। গিনিজ বুক মানুষের সেই সব অতিক্রমণের সাক্ষ্যবহন করছে। মানুষ নিজের দায়িত্বেই তা গুছিয়ে সংগ্রহ করে রাখছে আগামী প্রজন্মদের জন্য।
তবে এই স্বাধীনতা যদি মৌলিক অধিকার বলি তবে স্বাধীনতাকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টাও আমাদের আদিম প্রবৃত্তি। অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে নিজের ক্ষমতা দেখানোর রাস্তা খুব কম মানুষ খুঁজে পায়। ভালোবাসা, অনুকম্পা, সহমর্মিতা যতবার ছাপা হয়, উচ্চারিত হয়, তার একাংশও অনুভূত হয় না। সাধারণ মানুষ ভদ্র হয় আইনের ভয়ে। দেখা যায় নির্ভীক মানুষের অসামাজিক হওয়ার প্রবণতাই যেন বেশি। অত্যন্ত সাহসী ও অসীম নীতিপরায়ণ মানুষদের আমরা মহাপুরুষ বলি। এবং এ অবশ্যই স্বীকার্য যে মহাপুরুষ দলে দলে, পাড়ায় পাড়ায় জন্মায় না।
তবে উপায়? চিরকাল মানুষের যা শেষ সম্বল। আইন। একটা দেশ উগ্র ধর্মান্ধতার নামে যা খুশী করে যাবে আর সারা বিশ্ব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে তা তো হয় না। আইন বিবেক নির্ভর নয়। আইন শাস্ত্রনির্ভর নয়। আইন কেবলই আইন নির্ভর। যার মূল বাণীটা হল সমদর্শিতা।
একজন সমদর্শি ঈশ্বর মানুষ খুঁজেছে। পায়নি। অবশেষে মানুষ একটা সমদর্শি আইন খুঁজেছে। বানাবার চেষ্টা করেছে। গোটা পৃথিবীকে সেই সমদর্শিতার সূত্রে বাঁধতে চাইছে। কিন্তু হচ্ছে না। বারবার ভেঙে যাচ্ছে। মানুষ জাস্টিস চাইছে। জাস্টিস বলতে জন রল বলছেন সমস্ত আনফেয়ার ব্যবহার থেকে ত্রাণের পথ খোঁজা। কি ভীষণ কথা। কি ভীষণ স্বপ্ন। তবু এতটা রাস্তা হেঁটে তো এইটুকুই অবশিষ্ট আছে আর মানুষের হাতে। জাস্টিস। মানুষ যেদিন বুঝল তার সব চাইতে বড় শত্রু কোনো মহামারী না, প্রকৃতি না, দেবতারা না, অসুর না - তার সব চাইতে বড় শত্রু মানুষই, তখন সে এই বোধে এসে ত্রাণ খুঁজতে চাইল - যার নাম দিল সে জাস্টিস।
মানুষের আদালতে সে জাস্টিস না পেলে সে মহাকালের দরবারে আবেদন করল। ইতিহাস ঘেঁটে দেখল মহাকাল সমদর্শী। সে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। সে একের জোরকে, একের ঔদ্ধত্যকে চিরকাল মেনে নেয় না। সেই সমদর্শিতার লিপি মানুষ নিজের চিত্তেও বারবার দেখে। মিল খুঁজে পায়। সে ভীষণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, মানুষ বিচার না করলেও মহাকাল সে বিচার করবে।
কিন্তু সে তো শেষ কথা। তার আগে? তার আগে কি কিছুই হবে না? এত এত তাবড়-তাবড় শক্তি শুধু নীরব সাক্ষী থেকে যাবে? দেখা যাক ভবিষ্যৎ কি বলে?