Skip to main content

ব্যথায় না বাজলে, ব্যথা বোঝা যায় না।

গোঁসাই স্টেশানের একদম প্রান্তে বসে। অন্ধকারে। রাত হয়েছে। ফাঁকা স্টেশান। গ্রামের স্টেশান। স্টেশানের নামের উপর পাশের বটগাছের ছায়া দুলছে। আকাশ ভর্তি জুঁইফুলের মত মালা, তারার মালা। গোঁসাইয়ের পাশে বসলে এক সুগন্ধ আসে। শান্তির সুবাস। ভালোবাসার সুগন্ধ।

একতারাটা পাশে রাখা। ওই তারেতেই গোঁসাইয়ের প্রাণের সুর বাঁধা। গোঁসাইয়ের আঙুলের টানে তারে টান পড়ে। একতারা বেজে ওঠে। গোঁসাইয়ের গলায় পদাবলী জেগে ওঠে।

গোঁসাই বলল, দেখো, সুখ বড় বেদরদী। ব্যথা দরদী। কেমন ব্যথা বলো তো ক্ষ্যাপা…. যে ব্যথায় অবগাহন করা যায় সেইরকম ব্যথা। যে ব্যথায় পায়ের পাতা ডোবে, কি হাঁটু, কোমর ডোবে সে ব্যথা নয়। যে ব্যথায় ডুব দিয়ে তল পাওয়া যায় না, সেই ব্যথা। সে ব্যথা মানুষকে দরদী করে। তাই রাধা বলেছিল কৃষ্ণ তোদের মুখের কথা, কৃষ্ণ আমার অন্তরের ব্যথা। আমার ব্যথাই আমার গোবিন্দ। গানে শুনেছ না?... “পরাণে লাগলে ব্যথা ভাবি বুঝি আমায় ছুঁলে, বধূ আমার”..... দুঃখ মানুষকে মানুষ বানায়। দুঃখকে যদি আড়ালে রাখলে জগতের কেন্দ্র থেকে গেল আড়ালে।

কিন্তু এ দুঃখ বিলাসিতা নয়?

গোঁসাই হাসল। বলল, খিদে যখন খাবারের পছন্দ অপছন্দে ঘোরায় তখন সে খিদে বিলাসিতা…. কিন্তু খিদে যখন পোড়ায় তখন সে বিলাসিতা কি ক্ষ্যাপা?

বললাম, মানুষ দুঃখ থেকে বাঁচবে বলেই তো এত দৌড়াদৌড়ি করে… এত ব্রত-অনুষ্ঠান-উপবাস করে। তুমি বলছ সেই দুঃখই মানুষকে মানুষ করে?

গোঁসাই একতারাটা হাতে নিল। টোকা দিল। টুং করে বেজে উঠল। বলল, মানুষকে ঘোরায় অহং…. ছোটো আমি… কাঁচা আমি…. যে মানুষকে বোঝায় কলাটা মুলোটা ঠাকুরের থানে দিলে সব অভাব-দুঃখ-রোগব্যধি থেকে মুক্তি পাবে…. ছোটো বুঝের ছোটো কথা… ছোটো যুক্তি….. তাই কি হয় ক্ষ্যাপা….

তবে গোঁসাই মানুষ ঈশ্বরের কাছে যাবে না…. শরণাগত হবে না? কি আশায় যাবে তবে?

গোঁসাই বলল, দুঃখ থেকে ত্রাণ পেতে না ক্ষ্যাপা… দুর্গতি থেকে ত্রাণ পেতে….. সংসারে সব দুর্গতির মূল বেদরদী হওয়া…. দুঃখ ছাড়া তোমায় দরদী বানাবে কে গো? হাট করে দরজা খুলে দাও… জগত আসুক সব দুঃখ নিয়ে…. কেড়ে নিয়ে যাক সব…. দরদে জাগো… দরদে পোড়ো….

বললাম, গানটা শোনাও গোঁসাই….

 

আর কতকাল থাকব ব’সে দুয়ার খুলে, বধূ আমার!

তোমার বিশ্বকাজে আমারে কি রইলে ভুলে, বধূ আমার।

বাহিরে উষ্ণ বায়ে মালা যে যায় শুকায়ে,

নয়নের জল, বুঝি তাও, বধূ মোর, যায় ফুরায়ে।

শুধু ডোরখানি হায় কোন পরাণে তোমার গলায় দিব তুলে, বধূ আমার।

হৃদয়ের শব্দ শুনে চমকি’ভাবি মনে,

ঐ বুঝি এল বধূ ধীরে মৃদুল চরণে;

পরাণে লাগলে ব্যথা ভাবি বুঝি আমায় ছুঁলে, বধূ আমার।

বিরহে দিন কাটিল, কত যে কথা ছিল,

কত যে মনের আশা মন-মাঝে রহিল;

কী ল’য়ে থাকব বলো তুমি যদি রইলে ভুলে, বধূ আমার।।

 

ট্রেন চলে গেল। গোঁসাইকে নিয়ে চলে গেল। ফাঁকা স্টেশানে বসে আমি। আমি কোনদিকে যাব গোঁসাই। আমার প্রাণে একতারা কবে বাজবে গোঁসাই? আমার প্রাণে সে হাজার তারের কোলাহল। সুর নেই। কোলাহল আছে।

একজন এসে বসল পাশে। মদের গন্ধে ম ম করে উঠল। বলল, বিড়ি আছে?

গা গুলিয়ে উঠল গন্ধে। ভাবলাম উঠে যাই।

বললাম, নেই।

সে বলল, ঘেন্না হচ্ছে?

তার গলায় ভেসে এলো গোঁসাইয়ের গলার সুর….. ঘেন্না করো ক্ষ্যাপা? ঘেন্না? সহ্য না হয় উঠে এসো… ঘেন্না কোরো না…. সে অধিকার নেই…. সে প্রশ্রয় আছে… সে হাওয়ায় ভেসো না ক্ষ্যাপা…. হাল ধরো….

কে বলল?

গোঁসাই বলল, দরদ বলল…... ব্যথা কই তোমার ক্ষ্যাপা? শুধুই সুখ জমাও…. সে তো শুধুই ফাঁকি! এত অভাবে বাঁচবে কি করে ক্ষ্যাপা?