সকাল থেকেই শরীরটা বেশ ঠিকঠাক। মাথাটা ধরে নেই। কোনো দুশ্চিন্তা, মন খারাপ, বিভ্রান্তি নেই। পেটটা হালকা। গাঁটের ব্যথাটাও টের পাওয়া যাচ্ছে না।
সামনে স্কুলের দেওয়ালে সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে। শীতের ছুটি চলছে স্কুলে। পাশে শিরীষগাছটা অল্প অল্প হাওয়ায় দুলছে। মনটা বেশ প্রসন্ন। ছাদে বসে, হালকা শীত শীত করছে। মাফলারটা গলার আরেকটু কাছে জড়িয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন সমর বোস। রেলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। বিপত্নীক। নিঃসন্তান। দু'টো চায়ের শূন্য কাপ পাশের টেবিলে রাখা। যে পাখিটা ক্রমাগত ডেকে চলেছে, তার নাম কাক। সমর বোস কাকের দিকে তাকিয়ে। কতদিন হল ওর আয়ু? আর কতদিন বাঁচবে? কেউ জানে না। ডেকেই চলেছে। সঙ্গীকে খুঁজছে না ওদিকের বাড়িতে বাসন মাজার আওয়াজ আসছে তাই ডাকছে? আহ্লাদের ডাক না বিরহের?
আজ রবিবার। তিনটে খবরের কাগজ ভাঁজ না খোলা অবস্থায় পড়ে আছে পায়ের কাছে। কি নিরীহ দেখাচ্ছে। ভাঁজ খুললেই মানুষের নৃশংসতা, লোভের তাণ্ডব। এখন প্রায়ই শুধু শব্দজব্দ করে রেখে দেন কাগজগুলো। কাজের মেয়েটা মাঝেমাঝে বাড়ির জন্য নিয়ে যায়, বলে, "ও দাদু, তুমি পড়োনি একটুও, এতো এক্কেরে নতুন গো!"
জীবনের আর কতগুলো ভাঁজ খোলা বাকি? সমর বোসের জীবন বাকি অন্যের থেকে আলাদা। একাকীত্বে আলাদা। কোনো আগামী প্রজন্ম রেখে যাচ্ছে না সমর বোস। খেদ নেই। কাকটা উড়ে গেছে। সঙ্গিনীর দিকে না এঁটোর দিকে?
প্রতিটা জীবন আলাদা। কয়েকটা ভাঁজে। তৃপ্তি যখন নতুন এসেছে সংসারে তখন নতুন উত্তেজনা। নতুন স্বপ্নরা। পুরোনো হতে কতদিন লাগল? সুখও অভ্যাস হয়ে গেলে আর সুখ থাকে না, দুঃখের মত। অভ্যাসের একটা বশ্যতা থাকে। সেই বশ্যতা নিয়েই জীবন। নতুন ভাঁজ সামনে এলে বুক ধড়ফড়, 'আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে'।
আর নতুন ভাঁজ নেই। এখন একটাই অপেক্ষা - কম কষ্টের মৃত্যু। তবে আজ সকালে মৃত্যুর কথা ভাবতে ভালো লাগছে না। আজ সকালটা অনেক পরিষ্কার। মাথাটা মানস সরোবর। রোজ কেন থাকে না? চিন্তারা প্রতিদিন কেন শৃঙ্গজয়ের অভিযানে বেরোয়? জীবনে শৃঙ্গের তো অভাব নেই। থাকলই না হয় অধরা, বেশিরভাগই তো অধরাই।
এত কিসের চ্যালেঞ্জ জীবন তোমার? জীবন, তোমার বাড়িতে পুকুর নেই? গোলা-ভরা ধান? তুমি পুকুরে চিৎ-সাঁতার কেটে ভাসতে পারো না? তুমি পুকুরপাড়ে বসে জলে পা ডুবিয়ে অনির্দিষ্ট দৃশ্যে চোখ মেলে কেন থাকতে পারো না? তোমার পুকুরের উপর নারকেল গাছের ছায়া নেই? তোমার গ্রীষ্মের দুপুরে সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন টাটিয়ে ওঠে না? এত কেন 'চাই চাই' তোমার জীবন? তোমার ধানকাটা ক্ষেত নেই? সূর্যাস্তের সময় হাত-পা মেলে শুয়ে থাকতে পারো না পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে? এত কেন ক্ষোভ তোমার জীবন?
ফোনটা বেজে উঠল।
"দাদু? আমি রমিতা বলছি, আজ আসতে পারছি না গো, পিকনিক আছে। তুমি আজ হোম ডেলিভারি বলে দিও না গো।"
"আচ্ছা রে, ভালোভাবে কাটা দিনটা আজ"।
সমর বোস ফোন রেখে ছাদের ধারে এসে দাঁড়ালেন। আজ হোম ডেলিভারিও নয়। আজ বাইরে যাবেন। অল্প অল্প মনের মধ্যে উত্তেজনা জমছে। অকারণে বেরোলাম কবে? কদ্দিন হল?
সমর বোস রাস্তায় নামলেন। দিক নেই। না থাক। যাওয়ার ইচ্ছেটাই আসল। জীবন হাঁটো, আমার সাথে হাঁটো, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলো। কখনও আমি শ্রোতা, তুমি বক্তা। কখনও তুমি বক্তা, আমি শ্রোতা।
সৌরভ ভট্টাচার্য
29 December 2019