রাণাঘাট থেকে শিয়ালদা, আর শিয়ালদা থেকে রাণাঘাট। চল্লিশটা বছর কেটে গেল। প্রতিদিন অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠতেন। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। তাতে একটা ছাতা। একটা প্লাস্টিকের কৌটো। তার মধ্যে চারটে রুটি তরকারি। আরেকটা ছোটো কৌটো, তাতে শুকনো মুড়ি, আর দুটো ব্রিটানিয়া বিস্কুট। অবশ্য এই মুড়ি বিস্কুটটা সঙ্গে যেতে শুরু করল শেষ পনেরো বছর। যখন ডায়েবিটিস, যখন হাইপ্রেশার। শিয়ালদায় এসে একটা ফাঁকা বসার জায়গা খুঁজে মুড়ি আর বিস্কুট চিবাতে চিবাতে লোক দেখতেন। ওই যে বললাম রোজ অন্য অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠতেন, কারণ ওই এক, নেশা, নতুন নতুন লোকের সঙ্গে পরিচয় হওয়া। ওই ছিল তার বেড়াতে যাওয়া।
একবার পুরী গেছেন। বেড়াতে। নিজে গিয়েছিলেন। আরেকবার মালদায়। বিয়েতে। নিয়ে গিয়েছিল।
সারা জীবন অনেক অনেক মানুষ দেখলেন। ট্রেনের জানলায় বসে রোদ-বৃষ্টি দেখলেন। শীতের কুয়াশা দেখলেন। হাস্পাতালে শেষ কদিন শুয়ে শুয়ে মনে করলেন, ট্রেনে পাঁচটা মৃত্যুও দেখেছেন। হঠাৎ। স্ট্রোক।
প্লাস্টিকের সরু প্যাকেটে মোড়া বাদাম ভালোবাসতেন। দিন যত এগোলো, দাম বাড়ল, বাদামের পরিমাণ যেন কমল, স্বাদও যেন কমল। শুধু নুনের স্বাদটা এক থাকল। বাজার থেকে মাছ কিনে এনে, পেট চিরতে গেলে যদি ডিম বেরিয়ে পড়ে যেমন আনন্দ হয়, তেমনই যেদিন বাদামের প্যাকেটের তলানিতে অনেক নুন জমে থেকেছে, সেদিন এক পরম আনন্দ হয়েছে, আজীবন। কখনও কখনও নুনটা সঙ্গে এনেছেন প্যাকেটটা জামার পকেটে মুড়ে, বাড়িতে এসে আলুসিদ্ধ মাখাতে মাখিয়েছেন যত্ন করে। আহা কি স্বাদ!
দুঃখ আছে। একটা খেদ। ক্ষোভ বলা যায়। মেয়েটার ছেলে হল। বয়েস যখন তিন, মেয়েটাকে নিয়ে, নাতিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন চিড়িয়াখানা দেখাতে। সেদিন ট্রেনে হল কি গোলমাল। অবরোধ না কি যেন! এত ভিড়, এত ভিড়। মেয়েকে নিয়ে, নাতিকে নিয়ে হিমসিম খেতে খেতে খুঁজছিলেন চেনা মুখ, পেয়েওছিলেন কয়েকজন, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। বাচ্চাটার কান্নায় বিরক্ত হয়েছে কেউ কেউ। উফ, আফ আওয়াজ করেছেন। সেদিন কিছুক্ষণের জন্যে মনে হয়েছিল এই ট্রেন, এই রাস্তা আমার নয়। সব পর।
কিন্তু এই তো সব নয়। একবার শ্যামনগর ছাড়ানোর পর শরীরটা কেমন লাগতে শুরু করল। গরমকাল ছিল যদিও, তবু ঘাম হচ্ছে অন্যরকম একটা, জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে, হাত পা কাঁপছে। যেন হিসি হয়ে যাবে প্যান্টে মনে হচ্ছে। পড়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ কেউ বলল, দাদা কারোর কাছে লজেন্স বা কিছু আছে, সুগার ফল করছে।
কে একজন মাথাটা সোজা করে ধরে মুখের মধ্যে লজেন্স গুঁজে দিল। শক্ত চিনির ডেলা কামড়ে ধরলেন প্রাণপণ। মারা যেতে চান না, একদম না। অনেকবার চাইতেন আগে, যখন ছিল যৌবন, যখন স্বপ্নগুলোকে রোজ সকালে উঠে দেখতেন মরে পড়ে আছে সারাঘর, যেন কেউ সেঁকো বিষ খাইয়েছে ওদের।
সেদিন প্রাণ বাঁচিয়েছিল ট্রেন।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে শেষ কয়েক মুহূর্তে একবার মনে হয়েছিল বাদামের প্যাকেটের তলানিতে নুনের কথা। কিন্তু কে এনে দেবে? ততক্ষণে শুনতে পাচ্ছেন শিয়ালদা স্টেশানে অ্যানাউন্সমেন্ট, রাণাঘাট লোকাল ছেড়ে যাবে কত নাম্বার প্ল্যাটফর্ম থেকে যেন। প্ল্যাটফর্মটা খুঁজে পাচ্ছেন না, সব অন্ধকার হয়ে আসছে। সব চেনা মুখ হাঁ হাঁ করে ছুটে যাচ্ছে। কোনদিকে? কত নাম্বার প্ল্যাটফর্ম? সব অন্ধকার। অবশ হয়ে যাচ্ছে শরীর। গলা থেকে পেট অবধি সব শুকিয়ে যাচ্ছে। কেউ একটু চিনি দিক। কেউ দিক….
ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। আওয়াজ পাচ্ছেন। তিনি ট্রেনের বাইরে, না ভিতরে? ওটা কি নদী? চূর্ণী তো? ওই তো মা, ওই তো বাবা। ওপারে দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে। চূর্ণী নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে লোকাল ট্রেনটা। উনি ঝাঁপ দিলেন নদীতে। আসছি মা আসছি। আসছি বাবা আসছি। আমার জন্য জানলার ধারে একটা সিট রেখো। আমি আসছি।