Skip to main content
 
 
 
-----
 
সবচাইতে বড় ঘূর্ণী সংসারে নিজের মনের ঘূর্ণী। নিজেকে ঘিরে ঘুরেই চলে, ঘুরেই চলে। তার থেকে নিজেকে বাঁচাই কি করে? উপায় আছে, উপায় আছে। চরৈবেতি চরৈবেতি। যাই তো বটে, কিন্তু কোথায়, কি ভাবে যাই? সংসারের কর্মচক্রে পুরোপুরি একটা দাঁড়ি টানি এমন সামর্থ্য বা বৈরাগ্য কোনোটাই নেই। অতএব, টানলুম কমা। ক্ষণিক বিরতি। মাছ যেমন জলের উপর মাঝে মাঝে উঠে আসে, ঠিক তেমনই।
ট্রেন মুঘলসরাই পৌঁছালো নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা আগেই। সকাল ছ’টা। স্টেশানে নেমেই বুঝলাম বেশ একচোট বৃষ্টি হয়েছে সারারাত। ভেজা বাতাস বইছে, আকাশের চারদিকে কালো ছোপ ছোপ মেঘ। সূর্যের মুখ ঢাকা।
অটোতে চড়লাম। গন্তব্য কাশী ওরফে বেণারস। রাস্তায় খানাখন্দে জল জমা, দু'পাশে চাষের ক্ষেতগুলো জলমগ্ন। চালক বললেন, বহুবছর পর নাকি এমনধারা বৃষ্টি হল। তারপর যা বললেন তাতে মনটা দমে গেল। বললেন, বেণারসে গঙ্গা বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। নৌকা চালানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি আপাতত। গঙ্গা আরতিও নাকি হয়নি দু'দিন হল। মন বলল, যাহ্, তবে কি হবে! আমি বললাম, হুম। বেণারসে ঢুকতে ঢুকতে দেখলাম বেশ প্রহরার ব্যবস্থা চারদিকে। বললাম, এত প্রহরা কেন? উত্তর এলো, "আগলা সোমবার সাওনকে অন্তিম সোমবার হ্যায় না, ইসলিয়ে..."
বাঙালী মন, গ্যালারীতে বসে অ্যাডভেঞ্চার দেখতে অভ্যস্ত। আগেই চাই সুখের নিরাপত্তা। মন দুলে উঠল সংশয়ে, তবে তো লক্ষাধিক লোকের আগমন, হায় হায় এতো বিষম বিপাকে পড়া গেল দেখছি। ‘মনে বাসি ভয়’।
হোটেলে ঢোকার আগেই টের পেলাম লোক কাকে বলে। গেরুয়া, কমলা, লাল ইত্যাদি নানান রঙের পোশাক পরা আবালবৃদ্ধবনিতা। হাতে জলের পাত্র, মুখে 'ব্যোম শঙ্কর!' খালি পা, চলায় বেগের থেকে আবেগ বেশি। ভীতু মন সরে দাঁড়ালো একপাশে। আরেক মন ভিতর থেকে বলল, আসছি দাঁড়াও।
 
 
 
 
 
 
----
গঙ্গার জল দেখে স্তম্ভিত হলাম। ঘাটের পাশে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলো কোনোরকমে গলা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে। গঙ্গার সেকি ভয়ংকর রূপ! জলের গতিও প্রবল। মনে হল এইরূপে গঙ্গাকে পাওয়াই বা কম কি? সবাই কি সবসময় শান্তশিষ্ট থাকে? না থাকতে আছে? যে মানুষগুলো সাত চড়ে রা কাটে না, সেই ভালোমানুষদের মনে যে পাঁকের দহ দেখেছি! তার চাইতে থাক এই উগ্ররূপ। ধাক্কা লাগুক ধোকা তো লাগবে না।
মন্দিরের রাস্তায় এসে পড়লাম। থিকথিক করছে লোক। কেউ গঙ্গার দিকে ছুটছে জল আনতে। কেউ মন্দিরের দরজার সামনে বিরাট লাইনে অপেক্ষমাণ, কেউ অকারণেই যেন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ কিসের উদ্দীপনা? কিসের এত উত্তেজনা? এ কি শুধুই হুজুগ? এত মানুষের এত কিসের আশা? কিসের বিশ্বাস? ওই যে বৃদ্ধ মানুষটা, হাতে গঙ্গাজলের পাত্র, ছেঁড়া একটা ধুতি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে, ওর ক্লান্ত লাগে না ভগবানকে ডাকতে ডাকতে? কি চায়? সুখ তো! খানিক স্বচ্ছলতা! পেয়েছে? পায়নি তো? ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও পায়নি। তবু এতো শান্ত কেন? নাকি মানুষের আর ভগবানের - দু'জনেরই বিশ্বাসঘাতকতার সাথে যুঝে যুঝে ও ক্লান্ত এখন। শুধুমাত্র অভ্যাসের বশেই এসে দাঁড়িয়েছে। ডাকতে আসেনি হয় তো সে, এই মহাবিশ্বে নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্বটুকুর জানান দিতে এসেছে বিশ্বনাথের দরবারে। জানি না। এর উত্তর কোনোদিন পাবো বলেও আর আশা রাখি না। হেঁটে চললাম এ গলি সে গলি দিয়ে। মন্দিরে ঢোকার অবস্থা নেই। প্রবল ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকার মত ইচ্ছাও আমার নেই। মন্দিরের দরজার বাইরে দেখলাম একটা বড় স্ক্রীণে লাইভ দেখাচ্ছে মহাদেবের ভক্তিস্নান। মনে হল একবার বলি, বেইমানি কোরো না যেন, এরা অজ্ঞ সহজ বিশ্বাসীর দল। আমার মত ধূর্ত, প্যাঁচালো মন নয় কিন্তু এদের। এরা অনেক আশা নিয়ে অনেক ভরসায় এসে দাঁড়িয়ে। সাথে সাথেই মনে হল, আচ্ছা এরা কেন ভাবে, বিশ্বের যিনি নাথ, তিনি একটা পাথরের পিণ্ডে স্নানের জন্য লালায়িত হয়ে এ বিশ্বসংসার তৈরি করে বসে আছেন। যেন তিনি সবার তেল মাখানো প্রশস্তিতে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে ভুগতে কিছুটা মেগালোম্যানিয়াক হয়ে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই করে বসেন। আর তাই তাঁকে তুষ্ট না করতে পারলেই, পাড়ার মস্তান দাদাদের মত একটু কড়কে দেন। এ ভ্রম তবে কার? আমার, না ইতিহাসপ্রণালীবদ্ধ সংসারের? কবীরের বাড়ির পথ ধরলাম।
 
কবীর মঠের সেই সাধু
 
 
----
যাকে খুঁজি, তাকে চিনি না বলে খুঁজে পাই না? না, সে ধরা দেয় না বলে খুঁজে পাই না? কবীর মঠে এসে বুঝলাম দুই-ই সত্য। যে সাধুকে দু'বছর আগে দেখে মন মজেছিল সে কই? এ সাধুও না, সে সাধুও না। শেষে দেখি যে সাধুর হাত ধরে সেই কাঙ্খিত সাধু খুঁজে ফিরছি, সেই সে। দাড়ি পেকেছে। সেদিন ছিল শীতকাল, মাথা ঢাকা ছিল টুপিতে, মাফলারে। অগত্যা ঠকেই যেতাম, যদি না সে নিজে চিনে নিত আমাকে।
কথা শুরু হল। শতবছরের সময়ের চাদর সরিয়ে কবীর বসলেন সাধুর কণ্ঠে। সাধু বললেন, তাঁকে ডাকো। খুঁজবে কোথায়? সে তো তোমার মধ্যেই তোমার ‘তুমির’ আড়ালে। ‘এক সাধে তো সব সাধে, সব সাধে সব যায়’। বললেন, 'এক'কে ধরো। মন যাতে রঙ খুঁজে পায় সে রঙীন মনের গুরুকে ধরো। কি সে রঙ? প্রেমের রঙ।
আমার সামনেই রাখা রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ পূর্ণাঙ্গ মূর্তি। রবীন্দ্রনাথের কবীর অনুরাগ বিশ্ববিদিত। শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালার ‘কি চাই’ প্রবন্ধটার কথা মনে এলো। কি চাই? প্রেম। শান্তি না। বলছেন, যখনই প্রেমের অভাব আসে তখন শান্তির খোঁজ। যেন আসল বস্তুটাকে ফাঁকি দিয়ে চাওয়া।
সাধু বলে চললেন, 'এ শ্রাবণ মাসে এত ভক্তের মেলা। সারা বছর কোথায় থাকে এরা? শ্রাবণে শিব, আশ্বিনে দূর্গা, মাঘে সরস্বতী।'
সত্যিই তো। যার প্রেম হয়েছে সে আর শ্রাবণে কেন আসবে শুধু। তার তো সারাটা বছরই শ্রাবণ মাস! তার প্রেম তো রবীন্দ্রনাথের উক্ত প্রবন্ধের ভাষায়, "শান্তিতে অশান্তিতে বোনা।"
সাধু বললেন, 'একের সাথে প্রেম। শুধু প্রয়োজনে যে আসে সে তো প্রেমিক নয়, সে যাচক, সে ভিক্ষুক। তবে সে জীবনের সার্থকতা কোথায়?'
এ উদাহরণ আমাদের এ আটপৌরে সংসারে প্রচুর। এখানে মুখের থেকে মুখোশের সংখ্যা বেশি। বাক্য যত না মনের ভাব প্রকাশের তাগিদে জন্মায়, তার চেয়ে বেশি জন্মায় মনের ভাব গোপনের তাগিদে। যে ভালোবাসার ভাণ করে তার দূরে থাকার ভয়, কারণ সে জানে মায়ার জাল দূরের থেকে বোনা যায় না। তাই সে বারে বারে প্রশ্ন করে, পরীক্ষা করে, মান-অভিমানের নাটক করে অপর পক্ষের মনের গতি বোঝার চেষ্টা করে, কারণ তার নিজের মনের গতি যে খুব একটা সোজা না সে তো বুঝতেই পারে।
এই চালাকির জগৎ এসে ঢোকে সাধন মহলেও। বৃন্দাবন দাস বলছেন 'চৈতন্যমঙ্গল' কাব্যে – ‘সেই কর্ম ভক্তিহীন – পরহিংসা যায়’। সাধু বললেন, 'হিংসা ছাড়ো। যে কর্মে আছো মন আনো সেই কর্মে। শুধু মনে রেখো আরেকটা কাজ বাকি আছে, প্রেম করা। সেই অদেখা, অচেনা, অজানা নাথের প্রেমে মগ্ন হওয়া। “যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে/ভালোবাসে আড়াল থেকে/ আমার মন মজেছে সেই গভীরের গোপন ভালোবাসায়”
 
সেই রাজস্থানী মহিলা
8
 
---
শুনলাম আজ গঙ্গা আরতি হবে। ঘাটে গিয়ে দেখি, সার দিয়ে নৌকাগুলোকে পাটাতনের মত করে বাঁধা। এই নৌকা ডিঙ্গিয়ে সেই নৌকা। এইভাবে একটা একটা নৌকা ভরে গেল। প্রচুর লোক। শ'খানেকের কাছাকাছি নৌকা। বেশ উঁচুতে আরতির জোগাড় হচ্ছে। গঙ্গার জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। মাইকে কি সব ঘোষণা হচ্ছে। কানে যাচ্ছে, মনে যাচ্ছে না। চোখের সাথে মন আটকে চোখে। এক রাজস্থানী বয়স্কা মহিলা। তাদের সেই নির্দিষ্ট পোশাকে, ভাববিহ্বল, বিস্ময় দৃষ্টিতে চারদিক ফিরে ফিরে দেখছেন। কোনো প্রশ্ন নেই, কারোর উপর যেন কোনো অভিযোগ নেই। যা আছে তা হল অপার বিস্ময় আর শ্রদ্ধা। তার জোড়হাত জোড় হয়েই আছে। পাশে এত কথা, এত চীৎকার, এত আধুনিক আধুনিকারা, বিদেশী পুরুষ মহিলারা – সব ওর কাছে দেখবার মত। একটা শিশুর কৌতুহল আর সরল বিস্ময় মাখানো ওই লক্ষ অভিজ্ঞতার বলিরেখা কাটা মুখটাতে, পড়ন্ত বিকালের আলোতে যে মায়া তৈরি করেছিল, তা বর্ণনা করা দুষ্কর।
আরতি শুরু হল। আশেপাশে বহুমানুষের হাততালি ভজনের ছন্দে ছন্দে। মন আবার প্রশ্ন করল, কেন? আকাশে একটা একটা করে তারা ফুটেছে। মেঘ কেটেছে খানিক। আমার মন বলল, যদি কোনো মানব বোমা থাকে? কিম্বা, কোনো ফেলে রাখা ব্যাগে, কোনো এক অত্যন্ত মেধাবী মানুষের বানানো, কোনো এক সুচতুর মানুষের রাখা, মানুষকে মারার অত্যন্ত নির্ভুল আধুনিক অস্ত্র? আমার চারদিকের এই দেশি-বিদেশি হাজার হাজার মানুষের নিশ্চিহ্ন হতে বিন্দুমাত্র সময় লাগবে না। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ হবে, শোকজ্ঞাপন হবে। কোনো একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বী দল সগর্বে দায় স্বীকার করবে। বিশ্বের তাবড় তাবড় নেতারা ঘটনাটার ‘তীব্র নিন্দা’ করবেন। ক'দিনের জন্য খুব তল্লাশি চলবে। তারপর? আবার সবাই ভুলে যাবে। আবার নতুন দল এসে আরতি দেখবে। চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে। এর কি সত্যিই কোনো সুরাহা আছে? তাই থাকে? যে সমস্যা তৈরি হয় তার সমাধান থাকে, যে সমস্যা তৈরি করা হয়, তার সমাধান কে করবে?
আরতি শেষে যখন একটা নৌকা ডিঙ্গিয়ে আরেকটা নৌকা হয়ে ফিরছি, মন বলছে, আমার পায়ের তলায় নদী, বিপদসীমার চাইতে অনেক বেশি জল যাওয়া নদী। আমি তবু হাঁটছি। কারণ তবুও হাঁটতে হয়। সেই জন্যেই মানবতা সাধারণত্বে। যে সাধারণত্ব ভালোবাসা ছাড়া অন্য সব শক্তিকেই বর্বরতা বলে। আমার চারপাশে হাজার হাজার আত্মীয় এখন। কেউ পান, কেউ খেলনা, কেউ মহাদেবের মূর্তি, কেউ চাট ইত্যাদি কত কি কিনতে ব্যস্ত। কত কথা সবার। নিজের কথা, অন্যের কথা। না বলা কথা, বহুবার বলা কথা ইত্যাদি সব ভিড় করে নেমে আসছে আকাশ থেকে, ধরিত্রীর ছোঁয়া পাবে বলে।
 
 
 
 
 
----
বুদ্ধের দরবারে অনেকবার গেছি। সারনাথও তাই আগেও ঘোরা। এবারও এলাম। শ্রীলঙ্কা থেকে একটা বড় দল এসেছে দেখলাম। বেশিরভাগই খুব স্বচ্ছল অবস্থার নন দেখে বোঝা যাচ্ছে। তাদের সাথে কথা বলছেন এক বৃদ্ধ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। সিংহলী ভাষা। বুঝছি না। যারা শুনছেন তাদের চোখ কানের থেকে বেশি সক্রিয়। তাই তো হয়। যে মানুষটা নিজের দেশ থেকে এতটা দূরে এসে বসেছে, সে কি আর দেবতার বাণী শুনবে বলে? তাই যদি হত, তবে তার বাড়ির ঠাকুরঘর কিম্বা উঠানই যথেষ্ট ছিল। সে এসেছে মানুষ দেখবে বলে। তার পরম প্রিয় মানুষটার হেঁটে চলে বেড়ানো মাটিটার দিকে তাকাবে বলে। সেই মাটির একটা তিলক নিজের কপালে কেটে নিজের জীবনকে ঋদ্ধ করবে বলে। তাই তার কানের থেকে চোখের তৃষ্ণা আজ অনেক বেশি।
একজন বিদেশিকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কিসের টানে বেণারসে আসা? বুদ্ধের জন্য?' তার বয়েস হবে সাতাশ আটাশ। সে গভীরভাবে নিজের মধ্যে একবার ঘুরে এসে বলল, "No, it’s the unique culture of India."
নিশ্চই তাই। না হলে এই নোংরা এঁদো গলির মধ্যে কিসের টানে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে? এক ফ্রান্সের বয়স্ক মানুষকে দেখলাম, একটা গলির মধ্যের বাদ্যযন্ত্রের দোকানের মধ্যে, বেশ হাত-পা ছড়িয়ে সেতারে সরগম প্র্যাক্টিস করছেন। কথা বলে জানলাম, তার ফ্রান্সের নিজের বাড়িতেও একখানা সেতার আছে।
 
শ্রাবণের শেষ সোমবার এলো। মানুষের পাঁচিল! বাঁশবাঁধা লক্ষ মানুষের সারি। চারদিকে চলছে, 'ব্যোম শঙ্কর', 'হর হর মহাদেব' হুঙ্কার। বহু অল্পবয়সী ছেলেদের পায়ের দিকে তাকালাম। যেন আর খানিক পা হাঁটলেই রক্ত ফেটে পড়বে পা থেকে। তবু হাঁটা চাই।চারদিকে কি সাজো সাজো রব! মন্দিরকে ঘিরে তিন চার কিলোমিটার অবধি চলে গেছে বাঁশে বাঁধা প্রণালীপথ। তার মাঝে অজস্র নরনারীশিশু সাপের মত এঁকেবেঁকে দাঁড়িয়ে। মাইকে চলছে ভজন এখানে সেখানে। কেউ রামচরিতমানসের কোনো চৌপাই গাইছেন গদগদ ভক্তি বিহ্বল হয়ে। থেকে থেকেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে রব উঠছে, “হর হর মহাদেব!” মন ভিজছে। যুক্তি কাদার তালের মত গলে গলে ধুয়ে যাচ্ছে এই লক্ষকোটি অপেক্ষমাণ নরনারীর পায়ের সাথে, পায়ের বেগে মিশে। চোখ ভিজছে। জোর করে মনকে বলছি, না না, আমি ভক্ত নই। ভোলানাথের ভক্তের প্লাবনে সব ভুললাম। এ বিশ্ব সাগরের অতি ক্ষুদ্র এক বুদবুদের মত ভেসে গেলাম। মন প্রাণ কেঁদে আকুল হল এ মহাসাগরের স্পর্শে। বুঝলাম কেউ কিছু চাইতে আসেনি, এসেছে এ পবিত্র স্পর্শে ধন্য হতে। 
 
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামছে যখন তখন। দেখি প্রায় কেউই ছাতা নিচ্ছে না। জিজ্ঞাসা করলাম, কারণ কি? উত্তর পেলাম, বর্ষা হল ঈশ্বরের দান, তাকে দু'হাত পেতে, মাথা ভিজিয়ে নত হয়ে নিতে হয়, আনন্দ করতে হয়।
 
মনে এবার বাজল ফেরার ডাক। বেণারসের গলি, নোংরা, গোবর, যত্রতত্র ত্রিকালজ্ঞ নির্বিকার ষাঁড়, অনিয়ন্ত্রিত ট্রাফিকের ঝঞ্ঝাট – সব কখন নিজের হয়ে গেল খেয়াল হল না। বিশ্বনাথ কখন বুকের কোণায় আসন গেড়ে বসে পড়েছেন খেয়াল হল না। শুধু বুঝলাম আবার হেরে গেলাম এই অপরিষ্কার প্রাগৈতিহাসিক অদ্ভুত শহরটার আন্তরিকতার কাছে। যাঁকে বিশ্বনাথ বলা যায়, তাঁকেই কি করে হৃদয়নাথও করা যায়, কাশী তা জানে। তাই সে এত কিছুর মধ্যেও আজও সার্থক। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ না করলে যা বাকি থাকে তা শুধুই বোঝা। তাই এত জ্ঞান, এত পাণ্ডিত্য, এত তথ্য যে বোঝা হাল্কা করতে পারে না হৃদয় থেকে, কাশী তা পারে।
 
ফেরবার পথে তাই আবার আসার কথাটাই আবার মনে উঁকি দিয়ে গেল। একদল মাঝবয়েসী বাঙালী অধ্যাপকদের দেখলাম যারা সবাই মিলে দল বেঁধে, সারনাথে এক ধ্যানরত সাধুর ট্রাইপড লাগিয়ে ছবি তুলতে দ্বিধা করে না। আর করবেই বা কেন? কম জানেন নাকি তারা? এত অসহায় মানুষ, এত আর্ত মানুষ, এত অদ্ভুত মধ্যযুগীয় বিশ্বাসী সাধু সন্ন্যাসী (যাদের সাথে তাদের নিজেদের কল্পনার স্বদেশের, মানে ওই প্রথম বিশ্ব আর কি - কোনো মিল নেই), এতসব ‘সাবজেক্ট’ কোথায় পাবেন তেনারা? মুখ খুললেই লাইব্রেরী। মন খুললেই সেই ভীতু, আত্মতুষ্টিতে ভোগা নিরপত্তাহীনতার নজির। মনটা খানিক দমে গেল। কারণ আবার তো সেই ‘এতো জোরে না’… ’এত সাহস ভালো না’… ’এত বাড়াবাড়ি করতে নেই’ দের মধ্যে গিয়ে সিঁধোতে হবে। ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হবে, পাছে আমিও যে সাধারণ মানুষ এই অসম্ভব সত্যি কথা উলঙ্গ হয়ে সবার সামনে বিশ্রী ভাবে ধরা পড়ে যায়!
ব্যোম শঙ্কর! হর হর মহাদেব!
 
 
 
 
(ছবি: Debasish, Suman, Aniruddha, Joydeep)
 
 

Category