Skip to main content
guha

বুদ্ধদেব গুহ বললে আমার একটা ঝাপসা স্মৃতি মনে আসে। একটা টিভি অনুষ্ঠানে উনি এসেছেন। কোনো একটা স্কুলের অনুষ্ঠান সম্ভবত ছিল, কারণ প্রচুর বাচ্চা বসেছিল সামনে।

    কথাপ্রসঙ্গে একটা কথা উঠে আসে, অনাথ। কোনো একটি বাচ্চাকে উদ্দেশ্য করেই সম্ভবত বলা হয়েছিল।

    বুদ্ধদেব বাবু বেশ জোরের সঙ্গেই বলে উঠলেন, না না, অনাথ কেন হবে? আমরা কেউ অনাথ নই, তুমি আমি কেউ অনাথ নই, আমাদের সবার একজন নাথ আছেন। কেউই অনাথ নই।

    বুদ্ধদেব বাবুকে এরপরে নানা অনুষ্ঠানে লাইভ শুনেছি। শ্রদ্ধেয়া ঋতু গুহকে নিয়ে ওনার বেশ কিছু মজার মজার ঘটনাও বলতে শুনেছি। যেমন ঋতু গুহ'র জন্য রেডিও স্টেশানের বাইরে অপেক্ষা করা ইত্যাদি।

    ছোটোবেলায় বেশ কিছু কিশোর উপন্যাস পড়েছিলাম যার স্মৃতি এখন প্রায় শূন্য। কিন্তু বুদ্ধদেব বাবু বললেই, আমার ওই একটাই কথা মনে আসছে সকাল থেকে, কেউ অনাথ হয় না।

    বুদ্ধদেব বাবু'র ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়ে আমার পড়াশোনা নেই। কিন্তু সেদিনের বলার মধ্যে যে দৃঢ়তা ছিল সেটা আমায় ছুঁয়ে গিয়েছিল। পরের দিকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল ওনার গাওয়া টপ্পা। বেশ ভালো লেগেছিল। "ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে, আমারও স্বভাবও এই আমি তোমা বই কিছু জানি নে".... মুগ্ধ করেছিল। তবে ওঁকে শুনলে মনে হত যেন কোথাও ঋতু গুহ'র মেল ভার্সান শুনছি। উচ্চারণ, স্বরক্ষেপণে এত মিল! আশ্চর্য লাগত। এখনও লাগে।

    চাক্ষুষ করেছি বইমেলায়। টকটকে লাল ফর্সা মানুষ একজন। শীতের রোদ গায়ে মেখে বসে আছেন। চারদিকে অনুরাগী পাঠক পাঠিকাবৃন্দের ভিড়। দূর থেকে দেখেছি। স্মিত হেসে কথা বলছেন সবার সঙ্গে। সই করছেন। বিস্ময় লেগেছে, এই মানুষটা এমনভাবে জঙ্গলের গভীরের গল্প লেখেন! এত নরম, এত কোমল একজন মানুষ জঙ্গলে... ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি বইমেলায় হাঁটতে হাঁটতে... আবার ভুলে গেছি। বই সত্য অবশেষে, লেখক তো নন।

    মনটা অসাড় হয়ে আছে। আজকাল কোনো কিছুতেই ভীষণ আঘাত যেন পাই না। অতিমারিই করে দিয়ে গেছে। আফগানিস্তান খবরের পাতা জুড়ে। কি অসহায় ছবি সব। বারবার মানুষ আশ্রয় খোঁজে। মানুষ অন্ধকারের রাজাকে খোঁজে। বিশ্বাসে, অবিশ্বাসে, যুক্তিতে, ভক্তিতে একটা ব্যাখ্যা খোঁজে সব কিছুর। এক টুকরো কুড়িয়ে বাড়িয়ে যদিও বা পায়, আবার তছনছ হয়ে যায়।

    মানুষের গভীরতম অন্ধকার ভবিষ্যতের অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে সে কল্পনা করতে চায় অনুকূলভাবে। হয় না। জীবন মানেই তো নিত্যনতুন প্রতিকূলতা। নিজেই নিজের অনুকূল হই কই?

    বুদ্ধদেব গুহ একটা অনুষ্ঠানে দুষ্টুমি করে তারাপদ রায়কে বলছেন, তাই.. এইসব দুষ্টুমি ছিল বুঝি আপনার… (না, তোমার বলেছিলেন মনে নেই)। তারাপদ বাবু একটুও অপ্রতিভ না হয়ে বলেন, হ্যাঁ তো, আপনি যেমন ওইসব দুষ্টুমি নিয়েই গল্প লেখেন।

    হাসির হুল্লোড় উঠল বৈঠকে। এই হয়। অল্প অল্প সুখ। অল্প অল্প স্বপ্নপূরণ। আর অসীম অধরা, অসীম অজানা, অসীম না বোঝা। কতটুকু জীবন আর! লেখকের কাছে চাহিদা তো এই, সলমন রুশদির ভাষায় কব্জি ডুবিয়ে মানুষের গভীরে ঢুকে কিছু বলতে যাওয়া। গভীরের কথা বলতে যাওয়া। কিন্তু সবাই কি অত গভীরের কথা বলতে চান? অনেকে বাইরের কথাও তো বলেন। মনের উপরে ভেসে থাকা সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, এ সবের গল্পও কম কি! পাঠক তাও তো চায়! একটু ভুলে থাকা। একটু আরাম। সব সময় মুখের সামনে আয়না ধরা লেখা কি পছন্দ করে মানুষ? না। মানুষ সত্যকে চায় না। মানুষ সুখ চায়। দুঃখের মধ্যেও সুখ চায়। কান্নার সুখ। ব্যর্থ ভালোবাসার কোনো লেখকের কলমে সার্থক হয়ে ওঠার সুখ। কিম্বা সে ব্যর্থতাকে তুচ্ছ না করে তাকেও মনের মুকুরে ভাস্বর করে দেখার সুখ। সেও তো আছে। বুদ্ধদেব বাবু'র অজস্র লেখায় পাঠক নিজেকে খুঁজে পাবে, এ নিশ্চিত। লেখক চলে যান, বই থেকে যায়। বই সত্য, লেখক তো নয়।