ভাঙা রাজবাড়ির গায়ে শ্যাওলা, ঝুল জমেছে। এদিক ওদিক ভাঙা পাখির বাসার খড়কুটো। ভাঙা মেঝের ধুলোর আস্তরণের উপর পাখির গুয়ের ঢিবি জমেছে। কত যে কীটপতঙ্গ সে হিসাব করে পাওয়া যায় না। তবু রাজবাড়িটা ভিতের জোরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কোনোদিন মেরামত করবে, কেউ কোনোদিন রক্ষণাবেক্ষণ করবে ভালোবেসে আন্তরিকভাবে এই ভেবে। কোনো অনুসন্ধিৎসু যদি ভালো করে ঘরগুলো দেখে, দেখবে কত মনীষী, সাধক-সাধিকার ছবি ধুলোয় এদিক ওদিক পড়ে। কাঁচ ভেঙে গেছে। কাঠের ফ্রেমের দু’দিক হয় তো নেই। সব ধুলোয় ঢাকা। আকার আছে, কিন্তু বস্তু নেই।
রাজপরিবারের লোকেরা? যারা আছে তাদের আর আগের যুগের সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই। তাদের পূর্বপুরুষেরা যা বলেছে সে সেসব ভোরের ঘুমের স্বপ্ন তাদের কাছে। বাস্তবের মত, কিন্তু বাস্তব নয়। আর কয়েকজন আছেন। তেনারা একদম উপরের মহলে একটা ঘর গুছিয়ে নিজেদের মত থাকেন। তেনারা সবাই নিজেদের যোগ্য উত্তরসূরী বলে দাবী করে থাকেন। মাঝে মাঝেই অতীতের গর্ব ধুলো ঝেড়ে আলোচনা করেন, হাততালিতে পুরোনো রাজবাড়ি কেঁপে ওঠে। নীচের তলার লোকেরা বোঝে না, ওদের কিসের উল্লাস হল। খানিকবাদেই সেই উপর তলার সৃষ্টিকর্তারা নাকডেকে ঘুমিয়ে পড়ে। বলে এ নাকি গভীর অর্থপূর্ণ বিষাদ। এ না হলে কোনো সৃষ্টিই সম্ভব নয়! তারা যা যা দরকার লাগে নীচের তলার মানুষদের ফাইফরমাশ খাটিয়ে আদায় করে নেয়। অল্প একটু দরজা খোলে। আবার দরজা বন্ধ করে দেয়। নীচু তলার লোক বলে কিছু একটা হচ্ছে বটে, কিন্তু কি যে হচ্ছে বোঝা যায় না। এমনকি রাজবাড়ি ছেড়ে কিছু দূর যেতে না যেতেই তাদের শব্দগন্ধও পাওয়া যায় না। তারা বলেন তারা ভীষণ সুক্ষ্ম। এরা বলে, হবেও বা।
নীচুতলার লোকেরা ভাঙা রাজবাড়িকে রাজবাড়িই মানে না এখন। ভাবে একটা ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছু নয়। তারা এদিক ওদিক থেকে নকল আসবাব, সাজসরঞ্জাম যা পায় কিনে এনে সাজাতে চায়। খাপ খায় না। তবু বলে, এই দিয়েই কাজ চালিয়ে নাও বাপু। উপর তলা থেকে ব্যঙ্গবিদ্রূপের হাসির রোল ওঠে। এরাও ভেংচি কাটে। ওরা তখন শিক্ষিত, রুচিসম্মত ভেংচি কাটে। এরা ক্ষেপে গিয়ে অশিক্ষিত, অরুচিসম্মত ভেংচি কাটতে শুরু করে। অনেকে রাজবাড়ির নাম দিয়েছে ভেংচিবাড়ি।
এরকমই চলছিল। কোথাও যে কিছু পরিবর্তন দরকার মাঝে মাঝে মনে হলেও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন করার সামর্থ্য কারোর ছিল না। মাঝে অবশ্য উপরতলার কিছু লোক দারুন প্রোটেকশন নিয়ে এসে বলল, চল পরিবর্তন আনি! একটা রফা হল। এদিকের ধুলো ওদিকে, ওদিকের ধুলো এদিকে, ছাদের ঝুল মেঝেতে, মেঝের ঝুল ছাদেতে করে এক পরিবর্তন হল। আবার ওরা উপরে উঠে দোর দিল। মাঝে মাঝে হুল্লোড় করল। আবার ঘুমিয়ে পড়ল। গর্ভসঞ্চারী বিষাদঘুম। নীচের এরাও আবার ঝুলধুলো মেখে আবার নকল এটাসেটা জড়ো করে ঘর সাজাতে গেল। আবার নতুন করে ভেংচিপর্ব শুরু হল।
এর মধ্যে হঠাৎ করে কোত্থেকে কারা এসে জুটল। তারা ভিনদেশী। তাদের ভাষা, চাহনি, বড় তীক্ষ্ম। তারা বেশ ধনী। অন্তত এই রাজবাড়ির চাইতে বেজায় বেজায় ধনী। তারা এসে বলল, ওহে তোমাদের এই যে এই কুয়ো…. আরে এই যে গো…. এই কুয়োর মাহাত্ম্য জানো? এখান থেকে একটা অশ্বত্থ গাছ বেরিয়ে একদিন মহাকাশে গিয়ে পারিজাত পুষ্পের বীজ এনেছিল।…
রাজবাড়ির নীচুতলার লোকে হাঁ করে তাকিয়ে বলল, তাই? আমাদের কি করতে হবে?
তারা পিঠে হাত রেখে বলল, হে হে, সব আমরা করব, মার্জনা করব, নতুন করে উৎসব করব। তোমরা শুধু সে উৎসবে যোগদান করবে আর আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
তারা সবাই বলল, বেশ বেশ।
তারা আবার বলল, এই যে দেখছ নদী… আরে এই যে গো জলের দাগ… জানো এই নদীতে আজ থেকে আড়াইহাজার বছর আগে কারা স্নান করেছিলেন?
নীচুতলার লোকে আর জিজ্ঞাসা করল না কারা। তারা বহুদিন পর প্রাণে এমন সংস্কারী, প্রাচীন তীব্র আবেগে বিহ্বল হয়ে বলল, জানি জানি…. তোমরা মার্জনা করো… আমরা সবাই যোগদান করব…. তোমাদের জয়গান করব… আমাদের এসব কথা কেউ বলেনি!
উপর তলার লোকের নাকডাকার আওয়াজের সঙ্গে মিশে হইহই করে উৎসব শুরু হয়ে গেল। মাঝে মাঝে অবশ্য উপর তলার কিছু লোক জেগে উঠে কেউ হিব্রুতে, কেউ ল্যাটিনে, কেউ ফ্রেঞ্চে নানাবিধ ভাষণ দিয়ে আবার এ ওর পিঠ চাপড়ে ঘুমিয়ে পড়ছিল। স্পষ্ট করে স্পষ্ট ভাষায় সহজ করে কিছু বলছিল না, কারণ স্পষ্ট করে কিছুই যে বুঝতে পারছে না স্পষ্ট জিনিসটা ঠিক কি! কারণ নিজেদের স্বার্থের চাইতে স্পষ্ট কোনো বস্তু যদি থাকতে পারে, সে তো তাদের বৌদ্ধিকচর্চার বিষয়… থোড়ি জীবনের অভ্যাসের বিষয়…. তাই তারা বেজায় বিপদে পড়ল।
রাজবাড়ির পুরোনো স্তম্ভগুলো দীর্ঘশ্বাস ফেলছে মাঝে মাঝে, আর ক্ষীণ স্বরে গাইছে… অলসরে জাগো…. জাগো… জাগো….
কে জাগবে? কবে?
জানে মহাকাল। যাকে কেউ জানে না।