Skip to main content
বাসন্তীদেবী


     "গাও তো বাবা গোপাল, 'মানুষও হইয়া জনম লভিয়া, মানুষের করিলাম কি'.. কি বুঝলে বাবা? পৃথিবীতে এসে কাজের কাজ কিছু করতে হয় বুঝলে!" বলে তিনি গুনগুন করে গানটা গেয়ে উঠলেন।
      বাসন্তীদেবী যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছিলেন সে কোনো মানুষ না, খাঁচায় বন্ধ একটা টিয়াপাখি, নাম গোপাল। বাসন্তীদেবীর বয়স পঞ্চান্নর আশে পাশে হবে। তিন বছর হল তাঁর স্বামী গত হয়েছেন। আন্দুল স্টেশান থেকে বেশ কিছুটা ভিতরের দিকে তাঁদের বাড়ি। শীতের দুপুরে ভাত খেয়ে উঠে তিনি গোপালের সাথে কথা বলেন কিছুক্ষণ। তারপর নিজের দাওয়ায় বসে সামনের শিমুলগাছটা, আমগাছটা, জামগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের পেরিয়ে আসা এতদিনের জীবনটার কথা ভাবতে থাকেন।
     খুব স্বচ্ছল সংসার তাঁর কোনোদিনই ছিল না। তবে আধপেটা খেয়ে থেকেছেন, এমনও না। তাঁর স্বামী একটা মুদিখানার দোকানে কাজ করতেন। এক ছেলে আর এক মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়েছেন। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে হাসখালিতে। ছেলেটা ব্যাঙ্গালোরে সোনার দোকানে কাজ শিখছে। সে বলেছে বছর দশেক পর সে আন্দুল বাজারের কাছেই একটা দোকান দেবে।
    আজ বাসন্তীদেবীর মনটা খুব চঞ্চল। ঠিক আজ না, গত পনেরো দিন ধরেই কিছু একটা পরিবর্তন তিনি ভেতরে ভেতরে নিজের টের পাচ্ছেন। একবার ভাবলেন মেয়েটার বাড়ি গিয়ে থেকে আসেন ক'দিন। জামাই বলেও খুব করে। কিন্তু মেয়ের বাড়ি তো হাজার হলেও। তাই যাওয়া হল না। ছেলেটার কাছেই বা কি যাবেন! তার নিজের থাকা খাওয়া কুলিয়ে উঠতেই সে হিমশিম খেয়ে যায়, তার উপরে আবার তিনি গেলে তো তার আর হুজ্জুতির একশেষ থাকবে না। যা খরচ ওখানে! তাও তো শুনেছেন। তাই সে চিন্তাও মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন।
     শীতের সন্ধ্যে খুব তাড়াতাড়ি নামে। বিকাল আসতে না আসতেই অন্ধকার। তিনি ধীরে ধীরে উঠে সামনের রাস্তাটায় এসে দাঁড়ালেন। রাস্তাটা আরেকটা গ্রাম হয়ে স্টেশানের দিকে গেছে। কাঁচা রাস্তা। এই শীতকালটায় ট্রেনের শব্দটা বেশ কাছ থেকে পাওয়া যায়। তিনি লেপের তলায় শুয়ে শুয়ে ভাবেন, কেমন লাগে ট্রেনে চেপে অনেক দূর দেশে গেলে? শুনেছেন ট্রেনে খেতে দেয়, আবার শোয়ার জায়গাও নাকি থাকে!
     বাসন্তীদেবী রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যের ঘরে ফেরা পাখিগুলোর ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে আছেন। সামনের মাসে ছেলেটার জন্মদিন। কে জানে আসতে পারবে কি না! ছেলেটা গতবার এসে তাঁকে একটা মোবাইল কিনে দিয়ে গেছে। দু'তিন দিন অন্তর ফোনও করে। কি ভাল যে লাগে, অতদূর থেকে ছেলেটার গলা তো শুনতে পান!
    সন্ধ্যে হয়ে এল। সন্ধ্যা দিয়ে টিভি চালিয়ে বসলেন। পাড়ার ছেলেগুলো হই হই করে মাঠ থেকে ফিরছে। মনটা কেমন কেঁদে ওঠে তাদের চীৎকার শুনতে শুনতে। মনে হয় বাবু যেন ওদের ভিতর থেকে এক্ষুণি এসে দাওয়ায় দাঁড়িয়েই বলবে, মা খেতে দাও!

      এই দেখো পাখীটাকে ঘরে তোলা হয় নি যে!
     তাড়াতাড়ি খাঁচার কাছে দৌড়ে আসলেন। পাখিটা তাঁকে দেখেই 'ট্যাঁ ট্যাঁ' করে ডাকতে শুরু করল। তিনি হাত বাড়িয়ে খাঁচার দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেলেন। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলেন চুপ করে কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ কি মনে হল, খাঁচার আগল খুলে তাকে বললেন, যাঃ...
     পাখিটা থতমত খেয়ে ঝটপট শুরু করল খাঁচার ভিতর। তারপর উড়ে গিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।
     বাসন্তীদেবী অন্ধকারে দাওয়ায় বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ভিতরে টিভিতে তখন খবর হচ্ছে। ব্যাঙ্গালোরে একটা বিস্ফোরণে ছ'জন প্রাণ হারিয়েছে। অনেক লোক ঘায়েল হয়েছে। তিনি ছুটে গিয়ে ফোনটায় বাবুকে ধরার চেষ্টা করলেন। লাইন ঢুকছে না। বার বার চেষ্টা করতে লাগলেন। তবু ঢুকল না। তিনি ছুটে বাইরে এসে শূন্য খাঁচাটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চীৎকার করে ডেকে উঠলেন, গোপাল গোপাল। কোন সাড়া আসল না। কিছুক্ষণ সব স্তব্ধ।
     অনেক রাতে বাবু ফোন করল ব্যাঙ্গলোর থেকে। সে ভাল আছে। বিস্ফোরণটা অন্য জায়গায় হয়েছে। এত ফোন আসছিল বলে নাকি ফোনের লাইন জ্যাম হয়ে গিয়েছিল।
    পরের দিন ভোরে বাসন্তীদেবীর যখন ঘুম ভাঙল তিনি দেখলেন তিনি দাওয়াতেই ঘুমিয়েছিলেন সারারাত, গায়ের শালটা জড়িয়ে। এমন সময় 'ট্যাঁ ট্যাঁ' আওয়াজ শুনে আমগাছটার দিকে তাকালেন, গোপাল! বাসন্তীদেবীর দু'চোখ জলে ভরে আসল। তিনি বাচ্চাদের মত দু'বার লাফিয়ে উঠলেন দু'হাতে মুখটা আড়াল করে। তারপর আনন্দে গেয়ে উঠলেন, 'প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনা মাঝে গোরাচাঁদ দেয় হামাগুড়ি'
   গোপাল আমগাছটার এ ডাল ও ডাল নাচতে নাচতে 'ট্যাঁ ট্যাঁ' করে ডাকতে থাকল। সূর্য্যের আলো তখন কুয়াশা ভেদ করে বাসন্তীদেবীর উঠোনে। তিনি মনে মনে বললেন, তিনি কোত্থাও যাবেন না, কোত্থাও না, কক্ষণো না!


(ছবিঃ সুমন দাস)