মন খারাপ হলে লোকে কত কি করে শুনেছি, আমি স্টেশানে এসে বসি। আজকেও বসেছি। অনেক রাত, তাও বসেছি। স্টেশানের পাখা সারা গরমকাল কেউ বন্ধ করে না। ঘুরেই চলেছে। আমি চোখ বন্ধ করে বসে আছি। স্টেশান ফাঁকা। শুধু শেষ ট্রেন আসার বাকি। আসুক, যাক, আমার কি? আমার তো মন খারাপ।
দাদা বাঁশি শুনবেন?
অ্যাঁ! কে রে? মানে কেন? এই রাতে খামোখা বাঁশি শুনব কেন? পকেটে দশটা টাকা আছে, সিগারেট কিনব, ধোঁয়ামগ্ন হব, বাড়ি যাব। খামোখা বাঁশি শুনব কেন?
রোগা মানুষ। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। বয়েস মনে হচ্ছে পঞ্চাশের আশেপাশে। ধুতি আর একটা মাটি রঙের পাঞ্জাবি পরা।
আমি মন খারাপে গেঁজিয়ে যাওয়া গলায় বললাম, কেন হে আমায় বাঁশি শোনাবে, তুমি কি ঈশ্বরের দূত?
হ্যাঁ দাদা, বলতে পারেন….
বাব্বা… নেশা তো ফুলটুস দেখছি… তা তোমার প্রভু এখন কোথায় গেছেন?
প্রভু তো সর্বত্র দাদা, কোথায় আর যাবেন তিনি…..
দেব কানের গোড়ায় একটা….
====
বাজাতে শুরু করল বাঁশি। তাও আবার আমার পায়ের কাছে বসে। বলে মাটিতে না বসলে নাকি তার সুর আসে না। আমিও নামতে গেলাম, সে বাধা দিল। আমি সঙ্কুচিত হয়ে রেলের সিমেন্ট বাঁধানো চেয়ারে বসলাম। কি উৎপাত রে বাবা! সে নাকি রাগেশ্রী বলে কিছু রাগ বাজাচ্ছে। কে জানে সত্যি না মিথ্যা বলছে… আমি এসব গানের কিছুই ছাই বুঝি না। তবে একটা কথা বলব? মনটা কিন্তু জুড়িয়ে যাচ্ছে।
সে হঠাৎ থেমে বলল, আরো শুনবেন?
আমি বললাম, শেষ ট্রেন যাক… তারপর থামলে হবে…
সে একগাল হেসে বলল, শেষ ট্রেন তো আধঘন্টা হল চলে গেছে দাদা…. দেখেন ঘড়ি… আজ টাইমেই গেছে….
সেকি! একটা দশ! মানে? আমি কোন লোকে ছিলাম? সুরলোকে, না ইহলোকে? ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? কি লজ্জা লাগছে…. পকেটে হাত ঢুকিয়ে, অনেক দ্বিধা কাটিয়ে দশটাকার নোটটা ছুঁয়েছি… চাইছি না… তবু বার করে আনলাম…. তার হাতে দেব… আসলে নিজের লজ্জা ঢাকব…. ঘুষ….
একি! না না দাদা… আমি তো এমনিই…. কাল ভোরেই আমাকে আপনার মনে থাকবে না… কিন্তু এই টাকাটা দেওয়ার কথাটা মনে থাকবে… মনে হবে ঠকেছেন…. ভালো লাগবে না…. বারবার ব্রাশ করলেও মুখটা তিতা হয়ে থাকবে…. তার চাইতে থাক… বাড়ি যান…
অ্যাঁ.. বেশ… কিন্তু সত্যি করে ঝেড়ে কাশুন তো… আপনি কি কোনো বড় আর্টিস্ট? আমি চিনতে পারছি না? মানে আসলে আমার এ সব শিল্পগানবাজনাতে তেমন জানাশোনা কেউ নেই তো…..
আমার মধ্যে হঠাৎ কেন "কিন্তু কিন্তু" ভাব জন্মাচ্ছে বুঝছি না। বাঁশিওয়ালা উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, আমার এ সুর লালনের কাছে শেখা…. তারপর রবিঠাকুরের কাছে… কিছু তো তানসেনের কাছে…
ওহ তাই বলুন… পুরোই তারকাটা… মানে পাগল আপনি… তা অবশ্য শুনেছি শিল্পীরা পাগল-টাগল হয়.. তাই বলে এত….
বিশ্বাস হচ্ছে না তো… আচ্ছা চোখ বন্ধ করুন…. করুন… হ্যাঁ…. এইবার আমার সুর শুনুন….
বাঁশিতে সুর বাজছে… চেনা সুর…. আরে এ তো ভীষণ চেনা…. আরে আমার ঠাকুমা… না না…. হ্যাঁ… ঠাকুমাই তো গাইতেন….. রাই জাগো… রাই জাগো…. ঘুমায়ো না আর…..
বাঁশি বাজছে। আমার নাকে আসছে ঠাকুমার দোক্তার গন্ধ। ঠাকুমার গায়ের গন্ধ। বাঁশি কই? এ তো ঠাকুমার গলার আওয়াজ!…. আমি চাইলেও চোখ খুলতে পারছি না… কি যাদু… আমার বন্ধ চোখের পাতা ঠেলে নামছে জলের ধারা…. কে তুমি বাঁশিওয়ালা?....
ঠাকুমাকে দেখলেন… চাইলে সবাইকে দেখা যায়…. শুধু সুরটা মনে রাখতে হয়…. সুর মানে আত্মা… অমর… ধ্বংস হয় না…. ঢাকা পড়ে…. চাইলেই সবাইকে দেখা যায়…. লালন…. রামপ্রসাদ…. রবীন্দ্রনাথ… কাকে দেখবেন?.....
সামনে কেউ নেই। ফাঁকা স্টেশান। কিন্তু আমার কানে বাঁশির সুর। আমি কাকে দেখতে চাইছি….? কাকে দেখতে চাই?.... কার সুরে ডুবে কাকে খুঁজতে চাই? আমার সুর কি বাঁশিওয়ালা… আমার সুর কি?
আমি আমার অজান্তে হাঁটু মুড়ে বসে…. কার সামনে? আমার সামনে তো কেউ নেই… কিন্তু আমায় ঘিরে যেন সব দিক জুড়ে কে….. আমার সুরটা খুঁজতে হবে বাঁশিওয়ালা…. তুমি না, আমিই খুঁজব…. আমায় ঘিরে কে তুমি?.... সব সুরের মধ্যে তোমার সুর….. একি বলছি আমি…. আমিও কি পাগল হলাম…
আমার পকেটে দশটাকা। বার করলাম। এখন আমার কি চাই? সিগারেটের দোকান বন্ধ। টাকাটা নিয়ে এলাম। টাকাটা পকেটে একটা সুর বাজিয়ে দিল মনে, আমি এ টাকাটা তোমায় দিতে চেয়েছিলাম…. দ্বন্দ্বে হলেও…. এ তোমারই থাক…. বাঁশিওয়ালা…. বুকের পাশে এমন একটা কিছু…. তোমাকে দেওয়ার….