Skip to main content

নিবারণ সমাদ্দার ওলটা সিদ্ধ করতে দিয়ে চুপ করে তার দোকানের সামনে এসে বসে আছে। নিবারণের দোহারা মাঝারি উচ্চতা। চাপা রঙ। বেশ গোলগাল মুখ। একটা নীল শার্ট আর ধুতি পরে দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে পা দুলাচ্ছে। বয়েস এই পঞ্চান্ন'র কাছাকাছি হবে। বাড়িতে স্ত্রী আছে (বাসন্তীদেবী, লোকে বলে উনি বাপের বাড়ি গেলে নাকি পাড়ায় কাক-চিলের সংখ্যা বেড়ে যায়) আর এক মেয়ে, নাইনে পড়ে, ফুলটুসি।


নিবারণের আগে ছিল সারের দোকান। এখন মোবাইল রিচার্জের। এই শিবক গ্রামেই। এখন অবশ্য শিবককে গ্রাম বলা যায় না। মফঃস্বল বলা চলে।
নিবারণের মুখের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সে হাসছে কি কাঁদছে মুখ দেখলে বোঝার জো নেই। দুটোর ক্ষেত্রেই চোখদুটো কুঁচকে যায়, ঠোঁটের দুটো পাশ ধনুকের মত বেঁকে কানের দিকে সরে যায়। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, এই বুঝি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে। লোকে বোঝে কি করে তবে? সে খুব সহজ উপায় না। ভালো করে খেয়াল করতে হয় যে, চোখের কোণে জলের বিন্দু দেখা যাচ্ছে কিনা, তবে গিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।
নিবারণবাবুর স্ত্রী কাশী গেছে। শিবের মাথায় জল ঢালতে। সাথে ফুলটুসিও। আর ওর মামাবাড়ির লোকজন সব। তাই আজ নিবারণ ঠিক করেছে শুধু ওলসিদ্ধ আর ভাত খেয়ে নেবে। বর্ষাকাল। বৃষ্টি যে খুব হচ্ছে এ বছর তেমন না। সকাল থেকে গুমোট হয়ে আছে।


"হ্যাঁ গো বাসন্তীদি কবে ফিরবে?"
নলিনী মাসি। নিবারণ চমকে তাকালো। কি যেন একটা ভাবছিল সে। নলিনীমাসিকে চিনতে তার কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল। নিবারণ হাসি হাসি মুখ করে বলল (যদিও দেখে মনে হচ্ছে সে কাঁদতে কাঁদতেই বলছে), "এই সামনের বিস্যুধবার গো মাসি। কেন?"
নলিনী কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, "না এমনি আর কি।" আসল কথাটা হল নলিনী বড়ি দেবে, তা হঠাৎ এত কাকের পরিমাণ বেড়ে গেছে যে দিতে পারছে না। তাই প্রশ্নটা করেছিল আর কি‍! নিবারণ যদিও জানে। কারণ এই নিয়ে চার পাঁচজন তাকে এই একই প্রশ্ন করে গেছে। কেউ বাসন্তী আসলেই ছাদ ঝাঁট দেওয়াবে, কাকে এত নোংরা করেছে। কেউ শাড়িতে মাড় দিয়ে শুকাতে দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে অবশ্য নিবারণের মন খারাপ হয় না। এটাকে সে সমাজসেবা বলেই মনে করে।


হারান এলো রিচার্জ করাতে। হারানকে দেখলেই তার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। তার একটাই ছেলে ছিল, মুম্বাই বিস্ফোরণে মারা গেল। ওই যে বার লোকাল ট্রেনে পরপর বিস্ফোরণ হল না? সেই বার। সেই শোকে হারানের বউটা গলায় দড়ি দিল। এখন সে পুরোপুরি একা। রিট্যায়ার করেছে এই তিন বছর হল। কেউ তার খোঁজ নেয় না। অথচ তাদের অনেক আত্মীয়। হলে কি হবে হারানের ক'টা টাকাই বা আছে। তার ওপর হারানের যা দানের বাতিক।


হারানের আজ জন্মদিন। নিবারণের মনে পড়ল। হারান ওর জন্মদিনে ওর কয়েকজন কাছের আত্মীয়ের মোবাইল রিচার্জ করে দেয়। বিশেষ করে ওর দুটো ভাগ্নীকে ও প্রচণ্ড ভালোবাসে। কিন্তু ওরা পড়ার ক্ষতি হবে বলে ওকে যেতে বারণ করে। একজন ইলেভেনে আর আরেকজন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। দু'জনেই নাকি পড়াশোনায় খুব ভালো। হারানের গর্ব নাকি ওরা। যদিও এসব আদিখ্যেতা দেখলে নিবারণের গা-পিত্তি জ্বলে যায়। অমন পড়াশোনার ক্যাঁতায় আগুন, যা দু'দিন মামা গেলে নষ্ট হয়ে যায়! হারানের দেওয়া মোবাইলগুলো রিচার্জ করতে করতে সে আড়চোখে ওর দিকে তাকালো একবার। হারানদার চোখে জল। সে জানে, প্রত্যেক বছর দেখেছে। আজ হঠাৎ তার কেমন যেন কান্না পেল হারানের মুখটা দেখে। সে হাসি হাসি মুখ করে তাকালো হারানের দিকে। হারান মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে কি একটা ভাবছে।



---
ওলসিদ্ধ আর ভাত খেয়ে নিবারণ যখন স্টেশানে এলো তখন আড়াইটে। নৈহাটিতে আসতে তার বাইকে সময় লাগে কুড়ি মিনিট। আজ এসেছে সাইকেলে, তাই হাঁপাচ্ছে। গাড়িটা সার্ভিসিং করতে দিয়েছে। কলকাতা যাবে দোকানের মাল তুলতে। ট্রেন এলো। ফাঁকাই। ইতিমধ্যে কালো করে মেঘ এসে প্রায় সন্ধ্যের মত অন্ধকার করে এসেছে। শ্যামনগর আসতে না আসতেই তুমুল বৃষ্টি নামল। নিবারণ জানলার কাঁচ নামিয়ে বাইরেটা দেখতে লাগল। মাথার মধ্যে হারানের মুখ। ওর ভেজা চোখ। তার মনটা আবার খারাপ হচ্ছে। পাশের লোকের কাছ থেকে খবরের কাগজটা চেয়ে নিল। লোকটা ঝিমোচ্ছে। তার দিকে খানিক তাকিয়ে কাগজে মন দিল। তাকাতেই কানের পাশটা তার ভোঁ ভোঁ করে উঠল। কাশীতে নাকি উগ্রপন্থীর হামলার আশঙ্কা আছে, এমন মনে করছে বিশেষজ্ঞের দল। সাথে সাথেই সে বাসন্তীকে ফোন করল। ফোনের ভল্যুমটা কমিয়েই নিল। বাসন্তীর সাথে সবচাইতে লো ভল্যুমে কথা বললেও কানে তালা লেগে যায়।


বাসন্তী ফোন ধরল। যেই নিবারণ বলতে গেছে হামলার আশঙ্কার কথা, তার ভয়ের কথা, অমনি ওপাশ থেকে যে খ্যাঁকারি ভেসে এলো, খানিক্ষণের জন্য নিবারণের মনে হল ট্রেনের সবাই বুঝি তার দিকে তাকিয়ে। না কেউ শোনেনি। লোকটা এখনও ঝিমোচ্ছে। সে কাগজটা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। দরজার উপরের দিকে নানা বিজ্ঞাপন। একটা বিজ্ঞাপনে নিবারণের চোখ আটকে গেল। ট্রেন বারাকপুর ঢুকছে। নিবারণ নেমে গেল।


স্টেশানের বাইরে এসে বারাসাতের অটো খুঁজতে লাগল। খুব জোর বৃষ্টি পড়ছে। এদিকে ছাতা নিতেও ভুলেছে। যাক গে। অটো পেল। কি আশ্চর্য, বারাসাতে বৃষ্টি নেই। শুকনো খটখট করছে।


এবার খুঁজতে হবে চন্দ্রমৌলি স্বামীর ঠিকানা। সে পেতেও বেগ পেতে হল না। খুব বিখ্যাত মানুষ। একটা মিষ্টির দোকান থেকে বলল রিকশা নিয়ে নিতে। নিবারণের কি মনে হল যাওয়ার আগে একটা একশো টাকার সন্দেশ নিয়ে নিল। স্বামীজির বাড়ির দরজা বন্ধ। সামনে বিরাট লাইন। পাঁচটায় উনি বসবেন। বাড়িটা দোতলা। লাল রঙ করা। বহুদিনের রঙ মনে হচ্ছে। সামনে বিরাট বাগান। লোকজন সেখানেই বসে। নিবারণ নাম লিখিয়ে একটু হাঁটতে বেরোলো। গা'টাও শোকানোর দরকার রোদে। পিছনে তাকিয়ে দেখল আর না হোক গোটা তিরিশেক লোক বসে আছে। তার নাম একুশ নম্বরে। তিনি নাকি দু'বেলা পঁচিশটা করেই কেস নেন। যাক তার ভাগ্য ভাল, না হলে অন্যদিন আসতে হত আবার।


নিবারণ একটা পার্কে বসল। কেউ নেই। দূরে একটা ফুচকাওয়ালা ঘুমাচ্ছে গামছা পেতে বট গাছের ছাওয়ায়। আর কিছু কাক, শালিক, কাঠবেড়ালি। নিবারণের মনের মধ্যে আজ অদ্ভুত সব খেয়াল কাজ করছে। ফোনটা বার করল। পকেট থেকে একটা চিরকুট। তা দেখে দেখে ফোন নাম্বার ডায়াল করল।

একটা হট্টগোল শুনে ফুচকাওয়ালা ধড়মড় করে বসে পড়ল। তাকিয়ে দেখে একটা লোক সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে কি জোরে জোরে কথা বলছে। কিন্তু সে মুখ দেখে বুঝতে পারছে না লোকটা কাঁদছে না হাসছে। ফুচকাওয়ালার মনে হল, এত কথা বলে লোকটার যদি খিদে পায়, তাই তার দিকে তাকিয়ে 'হাঁ' করে বসে রইল।


নিবারণেরও সত্যি অনেকদিন পর ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে। ফোনটা করেই তার মনটা হাল্কা হয়ে গেছে। ফুরফুর করছে। হেলতে দুলতে ফুচকাওয়ালার কাছে গেল। ফুচকা দিতে বলল। কিন্তু প্রথম ফুচকাটা মুখে দিয়েই তার ফুলটুসির মুখটা মনে পড়ে গেল। কান্না পেল। ফুচকাওয়ালা আবার ঘাবড়ে গেল – বাবু হাসছে না কাঁদছে? সে বলল, "বাবু দেব না?" নিবারণ তার হাতে একটা কুড়ি টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, "না গো আর না।" বলেই সে হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে গেল।



---
স্বামীজি বসে গেছেন। যজ্ঞ চলছে। বিরাট মা কালীর মূর্তি স্বামীজির সামনে। চারধারে বসার জায়গা। যাদের গোপন কথা আছে, তাদের নিয়ে তিনি তার গোপন কক্ষে যাচ্ছেন। নিবারণের ভক্তিতে চোখে জল এলো স্বামীজিকে দেখে। মাকালীর দিকে তাকালো। মুণ্ডমালাগুলো গুনল। চৌকাঠের দিকে তাকিয়ে জপ করল। আবার মুণ্ডমালা গুনলো। আবার জপ করল। এমনি করে করে তার পালা এলো।


"কি চাই? কি সমস্যা তোর?" – স্বামীজি চোখ বুজেই তার দিকে তাকিয়ে বলল। নিবারণ এতক্ষণ তার মনের কথাগুলো গুছিয়েই এনেছিল। আচমকা সব কেমন গুলিয়ে গেল। চারদিকে লোকজন কমেই এসেছে। রাত সাড়ে আটটা হবে। নিবারণ আবার মুণ্ডমালাগুলোর দিকে তাকালো। তারপর কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় খুব জোর বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। স্বামীজি চোখ খুলে জানলার দিকে তাকিয়ে বললেন, "জয় মা... জয় মা... জয় মা... কি লীলা মায়ের। কখনো জল, কখনো আগুন, কখনো দুঃখ, কখনো সুখ... আমি কে রে? ওরে তোরা যে আমার কাছে ছুটে ছুটে আসিস, সে ও বেটি আনায় বলেই না আসিস! না হলে আমার কি ক্ষমতা বল? জয় মা... জয় মা... জয় মা... সকলি তোমারই ইচ্ছা..." স্বামীজি গান গেয়ে উঠলেন। কেউ কেউ ডুকরে উঠল...


"হ্যাঁ বল...কি চাই? প্রেমের সমস্যা... ব্যবসার... রোগ হয়েছে... কার? তোর তো খুব বাজে সময় যাচ্ছে রে পাগলা... আগে আসিসনি কেন রে?... অবশ্য মা না আনলে কেউ কি আর আসতে পারে রে ছোঁড়া..." (ছোঁড়া!!! নিবারণের কেমন যেন লজ্জা লাগল শুনতে, ভালো করে দেখল স্বামীজিকে। লাল কাপড় পরা, বেশ দোহারা চেহারা, লম্বায় তার থেকে বেশ বড়, বয়েস তারই মত হবে... যা হোক... সাধনায় সব সন্তানবৎ হয়ে গেছে হয় তো... সারা জগৎ হয়তো তার কাছে তার ফুলটুসির মত হবে। হঠাৎ নিবারণের সেই ফুচকাওয়ালার মুখটা মনে পড়ল... ইস্... নিশ্চই ও কিছু মনে করেছে... যা হোক ফুলটুসি ফিরলে একবার ওকে নিয়ে এলে হবে, ওর কাছে ফুচকা খেতে।)
"কি রে বল? না কি ইচ্ছা মায়ের কথা আমার মুখে শুনবি?" একমুখ হেসে স্বামীজি বলল, সব্বার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে।
নিবারণ আচমকা বলে উঠল, "আজ্ঞে উগ্রপন্থী..."
স্বামীজি চমকে উঠে বললেন, "কি পন্থী? সাধনার মার্গ জানতে চাইছিস? দীক্ষা নিবি? কিন্তু সে তো আমি কালীপূজার রাত ছাড়া দিই না। তুই নাম অবশ্য লিখিয়ে যেতে পারিস আগে।"


নিবারণ এবার একটু জোরের সাথেই বলল, আজ্ঞে তা না, বলছিলাম, "উগ্রপন্থীর কথা। আপনি তো শুনেছি বশীকরণ, মারণ করতে পারেন। ওই উগ্রপন্থীদের বশীকরণ করে দিন না... যত টাকা লাগে আমি দেব... বাড়িঘর বিক্রী করে হলেও দেব... আপনি প্লিজ আমায় ফেরাবেন না... দিন ওদের বশীকরণ করে... যাতে ওরা আর ওসব নাশকতার কাজ আর না করে... প্লিজ..."
নিবারণের গলা বুজে এলো। স্বামীজি ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। আশেপাশে যারা বসে ছিল তাদের অনেকেই আরো কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে আরো স্পষ্ট করে শুনবে বলে। ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। বাইরে হাল্কা বৃষ্টি নেমেছে। পুরোনো পাখাটার আওয়াজ হচ্ছে শুধু। ঘরে দুটো খুব মৃদু লাল আলো।


স্বামীজি একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, "পাগল ছেলে আমার! কি বলে শোনো... ওরে মায়ের সেই ধ্বংসলীলা কি আর আমাদের ইচ্ছায় থামবে রে বোকা? শুনিসনি... সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানং... অর্থাৎ কিনা মা-ই এই সৃষ্টি, স্থিতি, বিনাশ করে চলেছেন। তাকে কি থামানো যায় রে বোকা, না থামাতে আছে?"
"তবে আমাদের জীবনে যা ঘটছে তা কি মায়ের ইচ্ছায় নয় স্বামীজি? তবে তাকে থামাবার অধিকার কে দিল আপনাকে?" নিবারণ কিছুটা রেগেই গেছে।


স্বামীজি চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরকণ্ঠে বললেন, "সে ক্ষমতা আমার নেই রে পাগলা।"
নিবারণ উত্তেজিত হয় পড়ল, বলল, "সে হতে পারে না। এত মানুষ কিছু মানুষের উন্মাদনায় মরে যাবে... এতো বাচ্চা প্রাণ দেবে অকালে... এত বাচ্চা অনাথ হয়ে যাবে... এত মানুষ তাদের সন্তান হারাবে আর তোমার মা কিচ্ছুটি করবে না? তা কি করে হয় স্বামীজি?"
আচমকা মনের মধ্যে হারানের মুখটা ভেসে এলো... তার মৃত ছেলের মুখ... তার বউটার মুখ... সে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না... হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।


পিছনে বসে থাকা কয়েকজন মহিলাও মনে হল ডুকরে কেঁদে উঠল তার সাথে... নিবারণের নিজের বউ... মেয়ে... সবার মুখ মনে পড়তে লাগল... আরো আরো কাঁদতে লাগল।


স্বামীজি তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, "শান্ত হ... শান্ত হ... নিবারণ" (নাম লেখানো কাগজ থেকে নামটা জেনে নিয়েছেন। কতলোক তো তার কাছে আসে, সবাই স্বার্থ নিয়ে আসে। এই প্রথম এরকম একটা মানুষ এলো যে সবার জন্যে কাঁদছে। তার নিজেরও কান্না পেল।)
"তুমি বাইরে গিয়ে একটু বোসো নিবারণ, আগে আমি এদের ছেড়ে নিই তারপর তোমার ব্যাপারটা দেখছি কি করা যায়।"
নিবারণ উঠতে যাবে, এমন সময় পাশ থেকে এক বৃদ্ধা বললেন, "তুমি বোসো বাবা, আজ আমরাও আমাদের কিছু সমস্যার কথা বলব না, স্বামীজি আজ এই নিয়েই কথা হোক। আপনি দেখুন না যদি কোনো উপায় থাকে!"



---
স্বামীজি চোখ বুজে চুপ করে বসে রইলেন। এই প্রথম তার মনে হচ্ছে সে চীৎকার করে বলে দিক সব মিথ্যা... সব মিথ্যা... সব মিথ্যা... এগুলো কিছুতেই কিছু হয় না... সে নিজের ছেলেকে বাঁচাতে পারেনি... যখন সে জলে ডুবে হাত-পা ছুঁড়ছিল তখন তার কত বয়েস হবে? পাঁচ... তখন স্বামীজি নয় তো সে... সাধারণ পুরোহিত... তার বউটার মাথা খারাপ সেই থেকে... মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে সে এই ঘরে এসে বসে... বলে মায়ের ভর হয়েছে... সে যত কাঁদে তত লোকের মনের মধ্যে থেকে হাহাকার বেরোতে থাকে... যেন সবার হয়ে সে একা কেঁদে যাচ্ছে...
অবশেষে চন্দ্রমৌলি কাঁদল। মায়ের পায়ে আচমকা হুমড়ি খেয়ে পড়ে কেঁদে উঠল... তারপর তার বউয়ের কাছে গিয়ে তার পা জড়িয়ে কাঁদল... বউটা থতমত খেয়ে তার মাথার মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, "খোকা এসেছে? দেখেছো তাকে?"
চন্দ্রমৌলি হাঁটু গেড়ে বউয়ের কোলে মুখ গুঁজে বলল, "চলো আমরা আজই চলে যাবো... আজই... ভিক্ষা করে খাব... তবু এ কাজ আর না... আর আমি লোক ঠকাতে পারছি না গো..."

নিবারণ যখন বাড়িতে ঢুকলো তখন সাড়ে তিনটে। চন্দ্রমৌলি নিজে তাকে তার গাড়ি করে ছেড়ে দিয়ে গেছে। সে অনেক কথা বলল সারা রাস্তা গাড়িতে। সে নাকি মাকে প্রার্থনা জানাচ্ছিল যাতে মা তাকে কাজ থেকে মুক্তি দেয়... কিন্তু কি এক নেশা যেন তাকে পেয়ে বসেছিল...
নিবারণ তার ছেলের মৃত্যুর কথা শুনে কেঁদেছিল... স্বামীজি বুঝতে পারেনি... কারণ সে তার দিকে তাকায়নি...
বাড়িতে ঢুকতেই মনে পড়ল ফোন অফ্ করা। আজ আর খোঁজ নেওয়া হল না কাশীতে। যা হোক ফোন অন্ করল, ফুলটুসির ম্যাসেজ, ‘বাপি চিন্তা কোরো না। আমরা ঠিক আছি। তুমি ফোনটা চার্জে বসিও না হলে ব্যাটারি পাল্টাও, মা বলল।‘
নিবারণ হাসল। ফোনটা রাখতেই হারানের ফোন।
"আরে কখন থেকে তোমায় চেষ্টা করছি।"... হারান কাঁদছে নাকি?... "ওরা কাল আসছে নিবারণ... তোমার ঋণ আমি জন্মেও শুধতে পারব না..."
নিবারন শুতে গেলো... দুপুরের কথাগুলো মনে পড়ছে তার। সে হারানের ভাগ্নীদুটোর নাম্বার টুকে রেখেছিল। সে শুধু ফোনে বলেছিল... "মানুষ বেঁচে থাকতে যদি তার কথা ভুলে যাস মা... ওই পড়ার বইয়ের মড়া শব্দগুলো মুখস্থ রেখে কি হবে? মড়া টাকায় কি হবে যদি না একটা জ্যান্ত মানুষকে ভালোবাসতে পারিস... আয় আয়... আর দেরী না করে... মানুষটা বেঁচে থাকতে থাকতে আয় রে মা..."