বসন্তবাবু ছাদের দিকে তাকিয়ে দুপুর কাটান। একা মানুষ। চিন্তা করতে বাধা নেই। চিন্তা করতে করতে পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে মাথার পিছনটা অবধি ভার হয়ে ওঠে। নিজেকে ডাকেন। বসন্ত, ওঠ, ওঠ, চা বসা।
বিকেল হলে খবরের কাগজটা আবার খোলেন। আবার পড়েন। সকালে পড়া খবরগুলো অবিশ্বাস করেন। আবার পড়তে পড়তে সন্ধ্যে হয়। জীবনটা একা যেন বসন্তবাবুর না। কয়েক টুকরো বসন্তবাবু এক খণ্ড বসন্তবাবুকে বলে, ওঠ, ভাত বসা।
মশারিটা দুলছে। আজ রাতে ঘুমও আসতে পারে, মৃত্যুও। খবরের কাগজে বেরোবে পচা গন্ধ বেরোতে প্রতিবেশীরা পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ তালা ভেঙে ঢুকে দেখে মৃত বৃদ্ধ একজন। সরকারি চাকরি করতেন। স্ত্রী গত হয়েছে। এক ছেলে গত হয়েছে। গতরাতের ভাতের থালায় আলুসিদ্ধটা পুরো খাওয়া হয়নি। ওতে মাছি। পুলিশ বলবে, উনি অবসাদে ভুগছিলেন।
ঘুম এলো। আজ মৃত্যু এলো না। ভোর হল তাই।
দুধের প্যাকেট আর খবরের কাগজ নিয়ে ঘরে এলেন। তার গায়ের গন্ধ আলাদা করে বাইরে থেকে ভেতরে এলে পান। জীবন্ত মানুষের গন্ধ। না, আমার অবসাদ নেই।
ঝাঁট দিয়ে, ছাতুর সরবত খেয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসলেন। কোনো খবরে বিশ্বাস হয় না। পড়তে পড়তে অক্ষরগুলো ঝগড়াঝাটি শুরু করে। বসন্তবাবু এলোমেলো ভাবনায় পিছলে বসে পড়েন। তারপর নিজেকেই ডাকেন, ওঠ, ওঠ, ভাত বসা।
মৃত্যু যে কোনোদিন আসবে। বসন্তবাবু কাগজে লিখে রেখেছেন সব ঘরে --- আমি অবসাদে ভুগছিলাম না। আমি একাকীত্ব নিয়ে বাঁচছিলাম। চাইছিলাম কিনা জানি না। সে তো অনেক কিছুই না চেয়েও সঙ্গে নিয়ে বেঁচেছি। আমার মত মধ্যবিত্তের না পাওয়া অনেক ইচ্ছা সঙ্গে বাঁচে। সুখ দেয় না। দুঃখও দেয় না। সন্দেহবাতিক করে। আমার সবেতে ভীষণ সন্দেহ। আদৌ সুখ বলে কিছু হয়? ভালো লাগা বলে কিছু হয়?
বসন্তবাবু রোজ একটা করে বিশ্বাসকে জন্ম দেন। যেমন একদিন বিশ্বাস করেন, সবুজ পাতা ভালো। ভেবে সুখ হয়। জগতে সব সবুজ পাতা দেখে ক'দিন সুখী লাগে নিজেকে। একদিন বিশ্বাস করেন হাতের পাতা, পায়ের পাতা জলে ভিজালে সুখী হয় মানুষ। কয়েক সপ্তাহ ধরে হাতের পাতা, পায়ের পাতায় জল ঢালেন নিয়ম করে দিনে চার থেকে পাঁচবার। একদিন বিশ্বাস করেন মাটির শীতলতা মানুষকে উজ্জীবিত করে। তখন শুধু মাটিকে ভিজিয়ে মাটির তিলক পরেন, হাতে মাখেন, পায়ে মাখেন। সুখী হন।
বসন্তবাবু জানেন সুখ মানে একটা বিশ্বাস। নাগালের মধ্যে যা আছে শুধু সেইটুকুকেই বিশ্বাস করে সুখ খুঁজে নিতে হয়। যারা পাহাড়ে যায়, জঙ্গলে যায়, সমুদ্রে যায়, তারা সুখ কিনতে যায়। কেনা জিনিস ঘরে আনতে পারে না। হারিয়ে যায়। সুখকে বিশ্বাস করলে ঘরে আসে। দালানে আসে। বসে। আনন্দ দেয়।
বসন্তবাবু মারা গেলেন যেদিন সেদিন একা ছিলেন না। খবরের কাগজের দোকানে লোকটাকে টাকা দিতে দিতে বুকে যন্ত্রণা শুরু হল। বাড়ি ফিরলেন, তবে হাস্পাতাল হয়ে, তিনি যে আর নেই সেই সার্টিফিকেট নিয়ে, ক্লাবের ছেলেদের কাছে রাখা। কিছু মানুষ অকারণেই কাঁদে। তেমন কিছু মানুষ কেঁদেছিল। তারপর তারা চায়ের কাপ নিয়ে ক্ষোভ আর রাগের গল্প করছিল।
যেদিন মারা গেলেন বসন্তবাবু, সেদিন বিশ্বাস করেছিলেন, সব চাইতে সুখী হয় মানুষ বাচ্চার হাসি দেখে। যেখানে খবরের কাগজের দোকান, তার উল্টোদিকে একটা বাচ্চা মেয়ে থাকে, সে মায়ের কোলে চড়ে স্কুলে যাচ্ছিল। বসন্তবাবুর দিকে তাকিয়ে হাসল। তার হাসিমুখটা দেখতে দেখতেই মনে হল, যাওয়াই যায়। ব্যস। এতটুকুই। বসন্তবাবু কোনোদিন অবসাদে ভোগেননি।