সৌরভ ভট্টাচার্য
12 March 2019
বসন্তকালে প্রেম পেতেই হবে এমন একটা ভাব কোনোদিন আসেনি। স্কুলে থাকতে পরীক্ষার হাওয়া বসন্তের মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিয়ে এসেছে বরাবর। গীতবিতানের বসন্তকে পাত্তা দিতাম না। বুড়ো সেধে সেধে মন খারাপ করানোর তালে থাকে, বলতাম আমার যেন খেয়ে দেয়ে কাজ নেই।
এখন চুলে পাক ধরেছে। বয়েস চল্লিশ ছাড়িয়েছে। পড়তে গেলে কাছের পাওয়ার জুড়েছে চশমায়। বসন্ত এখন কেজি টুতে পড়ে, সে তো শিশু আমার পরিপক্ক দার্শনিক বুদ্ধির কাছে। এমনই একটা ভাব করে বিকালে ছাদে উঠেছিলাম জলের ট্যাঙ্কের কল খোলা কিনা দেখতে। দরজাটা খুলে ছাদে পা দিতেই একটা গন্ধ যেন আকাশ থেকে জাল ফেলে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরল। কি ফুলের গন্ধ? ছাদের ওই দিকে ওই ফুলটা অত লাল কেন? শিমূল না পলাশ? উফ না... না.. এসব ন্যাকা চিন্তা.. রাখো... সিঁড়ি ঘরের পিছনেই জলের ট্যাঙ্ক... কি হচ্ছে... হাঁটো..., নড়ো.. কি আদিখ্যেতা হচ্ছে এসব...
হয়ত নড়তাম... হয়ত পলাশ শিমূল উপেক্ষা করে, কি কি সব অদ্ভুত সৌরভে আমোদিত বাতাসকে উপেক্ষা করে এগোতেই পারতাম... পিছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ এলো... "বসন্তে আজ ধরার চিত্ত হল উতলা..." ... কার গলা? জানি না... 'উতলা' শব্দটা সুরের অজগরে জড়িয়ে ধরল... কি যেন একটা মন খারাপ... যে আকাশটা আমার সামনে মেলা, ঘন নীল... গ্রীষ্মের তাপে পুড়বে... তারপর ওই দক্ষিণদিকের হলুদ তিনতলা বাড়িটার পিছন থেকে মহাসমারোহে আসবে বর্ষার প্রথম মেঘ... এই যে কোকিলটা ডেকেই চলেছে সে চুপ করে যাবে সেদিন... কিন্তু আজ তার ডাকে কোনো দ্বিধা, কোনো ক্ষোভ নেই... এত নেই নেই, যা আমার এই ছাদের নীচের ঘরটা জুড়ে.. এই এতবড় আকাশ দিগন্তের সামনে সে কথাটা কই?... আমার থাকা না থাকাতে এই পলাশ, শিমূল, বর্ষার কিছুমাত্র আসবে যাবে না... যেমন আমি আসার আগেও আসে যায়নি কিছু...
এতবড় একটা ঘটনাপ্রবাহ আমারই বাড়ির সামনে... কি অহংকার আমার.. চোখের দুটো পাতার মত... বন্ধ করলেই সব শূন্য... তখন 'আমি' কথাটা শুধুই 'নেই নেই' কথাটাকে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়….. 'আরো চাই... আরো চাই'..... হায় রে মহাপুরুষ মন আমার... দুমুঠো জীবনের সবটুকুই শুধু মুঠো আঁকড়ে কেটে গেল.. ঘেমে উঠছি যে...
পুরুলিয়ায় গেল বসন্তে বেড়াতে গিয়ে খিদের রঙ পলাশের চেয়ে লাল দেখে এসেছি.. বাচ্চাগুলোর চোখের নীচে... বড্ড টাটকা... তাই পুরুলিয়ায় বসন্ত বিজ্ঞাপনে মন ভোলাইনি আর...
কল বন্ধই ছিল। অন্ধকার হয়ে এলো। তারারা একে একে পরিচিত জায়গায় এসে দাঁড়াল। সমস্ত প্রকৃতিটার মুখোমুখি হয়ে হঠাৎ মনে হল যেন মস্ত বড় ফাঁকিটা বড্ড স্পষ্ট হয়ে গেল আজ। কিছু একটা কৈফিয়ত দিতে যাচ্ছিলাম, সামনের নারকেল গাছটা একটা দমকা বাতাসে মাথা নেড়ে নেড়ে বলল, চুপ করো... শান্ত হও.. সাজানো কথা রাখো...
তার সুরে অভিমান ছিল না, ক্ষমা ছিল না.. আত্মীয়তা ছিল... বলল, কিসের এত কাজ তোমার!!