কথা হচ্ছে ব্যঙ্গ করবেন না কেন? অবশ্যই করুন। আমরা ট্রোল, মিম আরো কি কি সব নামে এই সব উন্নত মানের ইতরামি দেখতে অভ্যস্ত এখন। সেখানে কেউ বাদ যায়? মহাপুরুষ থেকে রাজনীতিবিদ, বিনোদনের দুনিয়া থেকে বিজ্ঞানী - সবাই আমাদের খাদ্য। আমার মাথার উপর দিয়ে যাই যায়, তাই আমাদের ট্রোলের বিষয় এখন। করুন করুন। আমরা হাসি। আমি তো সকাল থেকেই জানি আজ শিকার মাধ্যমিকের নাম্বার। করুন। এরপর এখন যারা শিকার হচ্ছে কাল তারা করবে। এই তো হচ্ছে। এই তো হবে।
তবে কি শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায়? পাড়ার দাদাদিদিকাকুকাকিমা এরা সব ছেড়ে দেবেন ভাবছেন? কেউ ছাড়বে না। আগে রোমে যেমন গ্ল্যাডিয়েটর দিয়ে লড়াইয়ে মজা পেত মানুষ, এখন আমাদের সেই মজা মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের নিয়ে। কি পৈশাচিক গা ঘিনঘিনে কৌতুহল, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, এ সব দেখে দেখে চুলে পাক ধরে গেল। কিছু বদলিয়েছে? কিচ্ছু বদলায়নি। রেজাল্ট বেরোনোর পর পরই শুরু হয়ে যায় এই শত্রুপক্ষ বনাম মিত্রপক্ষের খেলা। আমি জানি না এই নীচতা আর কোথায় এইভাবে আছে কিনা। আশানুরূপ রেজাল্ট না হলে রাস্তায় বেরোতে ভয়। ফোন ধরতে ভয়। আর এইবার তো সবার চোখেমুখে দুষ্টু হাসি - কিরে তোর কত হল?
মজার কি জানেন, ওরাও অনেকেই বুঝছে ওরা তুল্যমূল্য বিচারের রাস্তায় আসেনি। আমার দিদির মেয়ে আমায় বলল, নিজেই হাসতে হাসতে বলল, "আমি নিজেই বিশ্বাস করছি না মামু"। এইটা অনেক বড় কথা। ও যথেষ্ট পড়াশোনায় ভালো, তার উপরেও যখন ও বলছে এই কথাটা, তখন শুনে আমার খুব ভালো লাগল। হ্যাঁ, এই স্পিরিটটাই দরকার। যে সময়ে বেঁচে আছি সেই সময়ে বেঁচে থাকাটাই যখন একটা সফলতা, অ্যাচিভমেন্ট, সেই সময়ে কাগজে লেখা কয়েকটা সংখ্যার মূল্য কত?
আমি গার্জেনদের অনুরোধ করব ওদের স্বাভাবিকভাবেই এটার সম্মুখীন হতে বলুন। কেউ ব্যঙ্গ করলে যেন বলে, "ইস হিংসা হচ্ছে না?, কি করবে বলো তোমাদের সময় তো করোনা ছিল না"। ওদের এইটুকু বোঝার বয়েস হয়ে গেছে যে আন্তরিকভাবে শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা হাতে গোনা। আর তারা আদৌ মার্ক্স নিয়ে ততটা চিন্তিত নন যতটা তাদের সুরক্ষা নিয়ে। বাকি সব এলেবেলে।
তর্কবিতর্ক চলুক। কিন্তু সে সব পরীক্ষাপদ্ধতি ইত্যাদির মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। এদেরকে আর না খোঁচানোই ভালো। বরং উৎসব হোক যে সবাই সুস্থ আছে, ভালো আছে। সুদিন ফিরলে আবার সব ভাবা যাবে। এই সময়ে তারা পুঁথিগত বিদ্যা কি শিখলর থেকে বড় শিক্ষা যেন পায় - মানুষ হওয়ার শিক্ষা। যথার্থ মানুষ হওয়ার শিক্ষা বই, সিলেবাস দিয়ে তো হয় না। সে হয় বাড়ি, পাড়া, ইত্যাদির সম্মিলিত সুস্থ সামাজিক সহাবস্থানে। সেইটা যেন কিছুতেই বিঘ্নিত না হয় এটাই দেখার। বাকিটা সব সামলে যাবে। এতদিন এত এত বই পড়েও যখন আমরা তেমন কিছু খুঁতহীন সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি, তখন আজ কয়েকটা দিক আলগা হল বলে সমাজ মুখ থুবড়ে পড়বে না। অগত্যা "তোরা তো কিছুই শিখলি না" বলে নাটকীয় ঢঙে ওদের ঘাড়ের উপর পড়বেন না। যদি জীবনে অনেকটা এসে থাকেন, অনেক রোজগারও করে থাকেন, তবে এটা নিশ্চয় বুকে হাত রেখে বলবেন যে সুস্থভাবে বাঁচতে ততটা তথ্য-জ্ঞান-অর্থ লাগে না যতটা লাগে হৃদয় আর ভালোবাসা আর সেই দিয়ে গড়া সুসম্পর্কের ঘের। এইটা থাকলে অনেক বড় সংকট কাটিয়ে দেওয়া যায়। নইলে শুধুই বিদ্যা বোঝাই বাবুমশায় হয়ে অবসাদের মধ্যে ডুবে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা তো কম নয়!
আমার তরফ থেকে সবার জন্য রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাক, সুস্থ থাক। একজন সবল মস্তিষ্ক আর উন্নত হৃদয়ের মানুষ হ, বাকিটা আমরা বুঝে নেব।