মা মেয়েকে বলল, তুমি কোথায় টিউশন পড়তে যাও, স্কুলে কাউকে বলার দরকার নেই। কোনো বন্ধুকে না।
মেয়ে আইস্ক্রিম খেতে খেতে বলল, আমি বলব, আমি আমার দাদার কাছে পড়ি, তাই না মা?
মা চাউমিন কাঁটা চামচে তুলতে তুলতে বলল, এই তো আমার সোনাটা বুঝে গেছে।
সোনাটা আবার আইস্ক্রিমে মন দিল। মা কয়েকবার ফোন চেক করল। ভুরু কুঁচকাচ্ছে। তোর বাবাটা এত দেরি করে না!
রেস্টুরেন্টে শরতের রোদ এসে পড়েছে। গরমটা কম। সামনে পুজো। মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা পল্লবীর। কিছুতেই ঠিকঠাক মার্কস আসছে না। কোথায় যে আটকাচ্ছে! এই নিয়ে চারবার স্যার, ম্যাডাম চেঞ্জ করা হয়ে গেল। লজ্জাও তো লাগে। রাণাঘাট থেকে কল্যাণী তো কম দূর না। ক্লাস থ্রি-তেই যদি এতটা রাস্তা আসতে হয় প্রতি সপ্তাহে চারবার, হাইস্কুলে উঠলে কী হবে?
সোনা, মানে বৃষ্টি আইসক্রিম খাচ্ছে মন দিয়ে। কিন্তু গোটা মনটা দিতে পারছে না। জানে মা রেগে আছে। বাবার উপর, তার উপর। বাবার উপর কারণ বাবা দেরি করছে আসতে। আজকে এখান থেকে তাদের পুজোর বাজার করতে যেতে হবে কাঁচরাপাড়া। আর তার উপর রেগে আছে, কারণ বৃষ্টি গরিমা আর লাভলিকে বলে দিয়েছে সে প্রকাশ স্যারের কাছে কল্যাণীতে টিউশান পড়তে আসে, আর এবারে সে স্ট্যান্ড করবেই, প্রকাশ স্যার মা'কে কথা দিয়েছে।
মা হঠাৎ বলল, এত দেরি হল?
বাবা কখন এসেছে?
জয়ন্ত মুখটা রুমাল দিয়ে মুছে বলল, বলছি। একটা চাউমিন আমারও বলো… মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে আছে…..
পল্লবী সব রাগটা গিলে ফেলল। অনেক কিছু বলবে ভেবেছিল। ওর বাবাকে নিয়ে কিছু বললে ওর সব চাইতে বেশি লাগে। সেই কথাটাই বলতো, “তোমার মা যেমন সারাটা জীবন তোমার বাবাকে নিয়ে ভুগেছে, আমি তেমন ভুগতে পারব না….. ব্যস।”
জয়ন্তর বাবা রেলের বড় অফিসার ছিলেন। প্রশান্ত মণ্ডল। ভীষণ কুঁড়ে মানুষ। অন্তত পল্লবীর শাশুড়ির তাই মত। প্রশান্ত আর জয়ন্তর মত, সবেতেই এত উস্তাড়া করার পাব্লিক আমরা নই।
পল্লবী কথাটা গিলে ফেলল, কারণ জয়ন্তকে এতটা রাগতে খুব কমই দেখেছে। মুখটা লাল হয়ে আছে। পল্লবী বলল, কি হয়েছে?
জয়ন্ত বলল, বলছি দাঁড়াও…. মা, ও মা, তুমি ওই ফাঁকা টেবিলটায় বসে একটু মোবাইলটা নিয়ে খেল তো… আমি মাম্মির সঙ্গে দুটো কথা বলে নিই একটু…. বড়দের কথা মা…. তোমার শুনতে নেই….
বৃষ্টি মুখটা ইচ্ছা করে দুঃখ দুঃখ করে, বাবার মোবাইলটা নিয়ে একটু দূরে একটা ফাঁকা টেবিলে বসল। মোবাইল পেলে তার দারুণ আনন্দ। কিন্তু সেটা দেখালেই মা বকতে শুরু করবে। “বই নিয়ে বসলেই তোমার গায়ে জ্বর আসে”। যা হোক, বৃষ্টি কাঁচের দেওয়ালের সামনের টেবিলটায় বসল। রাস্তায় কি দারুণ দুটো ডগি। বৃষ্টি চোখের ইশারা করে ডাকল। আড়চোখে দেখল, বাবা হাত নেড়ে নেড়ে কি সব বলছে, আর মা ভুরু কুঁচকে শুনছে।
জয়ন্ত বলছে, আর বোলো না। আজ পুজোর মিটিং ছিল। ফাইনাল মিটিং। তো আমি বলেছি, এবারে অষ্টমীর দিন লুচি শুধু না করে, ফ্রায়েড রাইসও তো করা যেতে পারে…. মানে সবাই তো আর অষ্টমীতে লুচি খায় না…… অমনি জগন্নাথ দা… মানে জগন্নাথ ব্যানার্জি, ওই প্রফেসর, ইতিহাস না পলিটিকাল সায়েন্স কি পড়ায় না?
পল্লবীর এই ধরণের কথা ভীষণ বিরক্ত লাগে। জয়ন্তদের বাড়িতে কালচার বলে কিছু নেই। একটা খবরের কাগজ অবধি নেয় না। জয়ন্ত রাজ্য সরকারের চাকরি করে। ক্লার্কের চাকরি। পল্লবীদের বাপের বাড়ি ভীষণ কালচারড। তার বাবাও রেলে ছিল। বিপুল ভট্টাচার্য। এমন দাপুটে অফিসার যে লোকে বলতো তার বাবার হাঁকডাকে নাকি বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। ওই রেলকলোনিতেই আলাপ এদের পরিবারের সঙ্গে। জয়ন্তর সঙ্গে প্রেম তারপর। ওর বাবা রাণাঘাটে বাড়ি করল, কারণ গ্রামের বাড়ির কাছাকাছি হবে। ওদের গ্রামের বাড়ি মাটিকুমড়ো। কি অজগ্রাম বাবা! চোদ্দোগুষ্টির কপাল ভালো যে ওখানে মরতে বাড়ি বানায়নি। যা হোক এই সম্পর্ক নিয়ে তার বাপের বাড়ি অনেক আপত্তি ছিল। কাস্ট নিয়েই। নইলে জয়ন্তর বাবাও একই পোস্টে কাজ করত, তার বাবার স্কেলেই। কিন্তু ওই কাস্টের জন্য…. অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষে বিয়েটা হয়েছিল। এদের বাড়িতে পড়াশোনা, সাহিত্য, গানবাজনা…. কিস্যু চল নেই। শাশুড়ি এই বয়সে যে সব সিনেমা দেখে, গান শোনে…. তার মা ভাবতেও পারে না। বাবা সবসময় বলত, সাহিত্যিকদের মধ্যেও দেখ না, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় এসব উচ্চবর্ণের ছড়াছড়ি। সাহিত্যিকদের মধ্যে ক'জন নিম্নবর্ণের পাস? হাতে গোনা... পল্লবী তখন কলেজে পড়ে… এস এফ আইয়ের সদস্য… মাথা গরম হয়ে যেত ওসব শুনলে। কিন্তু বাবার মুখের উপর কথা বলতে পারত না। বাবার উন্নাসিকতা কোনদিনই মানতে পারে নি পল্লবী... বাবার কাছে ইউরোপ-আমেরিকার লোক যত কাছের, নিম্নবর্ণের সম্প্রদায় কোনদিনই তত কাছের হয় নি। অনাত্মীয়ই ঠেকেছে। কালচার তো একটা অজুহাত... তাই দুই বাড়ির মধ্যে যাতায়াত খুব একটা নেইও। পল্লবী অবশ্য বদলে গেছে অনেক। সংসারের পল্লবী আর কলেজের পল্লবীর মধ্যে অনেক ফারাক। অনেক ফারাক তার মনে উঁকি মারে। চোরাকুঠুরি দিয়ে উঁকি মারে। বদলে গেছে সে। এদের আত্মীয়স্বজনেরা তো এক-একটা নমুনা। প্রায় কোনো অনুষ্ঠান বাড়িই যায় না তো পল্লবী বৃষ্টিকে নিয়ে! ওই সব গান, নাচ, সাজপোশাক… সব এই বয়সে শিখবে মেয়েটা। কি যে হবে!
পল্লবী একটু দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ইতিহাস পড়ান উনি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই হল…., জয়ন্ত বলল।
অন্য সময় হলে পল্লবী হাতটা উঁচু করে জয়ন্তকে থামিয়ে বলতো, অশিক্ষিতের মত কথা বোলো না তো…. ওই হল না… কিন্তু এখন থাক…. কিছু একটা সিরিয়াস হয়েছে…..
জয়ন্ত বলে যাচ্ছে….
তো উনি বললেন, বাজেট ফেল করবে…. তাই শুধু লুচিই হবে আর নিরামিষ হবে…. আমি বললাম, বাজেট ফেল হবে আগেই কী করে বলছেন…. আর টাকাটা তো আপনার পকেট থেকে দিতে হচ্ছে না…. ব্যস…. অমনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তা মশায় ওপার বাংলা থেকে আসা হচ্ছে বুঝি…. মানে বাঙাল… আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই বললেন, মাছ ছাড়া অষ্টমীতে খাওয়া হয় না তো আপনাদের…. বাঙাল…
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম…. হঠাৎ পাশ থেকে নারানদা বলল, না না, ওরা মাটিকুমড়োর আদি লোক…. একদম ঘটি….
সে বাল বলে, উঁহু বাঙাল…. আপনি মণ্ডল না? তা হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ, না আম্বেদকর? মানে আপনারা দলিত তো…. তা মশায় আম্বেদকর তো আপনাদের বুদ্ধধর্ম নিয়ে আমাদের বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, এই ব্রাহ্মণ্যধর্ম রুখে দিতে বলেছিলেন। তা না করে, আপনি মশায় এই বামুনদের দিয়ে করানো দুগ্গাপুজোতে কেন ভাগ নিচ্ছেন বলুন তো? নিজেদের দলিত ভাইবোনদের নিয়ে বুদ্ধপুজোর আয়োজন করুন, আমি নাক গলাতে যাব না। তাই আপনিও যা বোঝেন না তাই নিয়ে কথা বলবেন না।
পল্লবীর কান-মাথা গরম হয়ে গেল। কিন্তু রাগটা কেন যে জয়ন্তর উপর হল বুঝল না। সে হঠাৎ বলল, কেন তুমি বলতে গেলে যে, টাকাটা তো আপনি দিচ্ছেন না…. একটা বয়স্ক মানুষ… তার উপর পুজোটা উনি করেন। দেখেছ তো আমাদের খুব একটা কাছে ঘেঁষতে দেন না। উনি আছেনই তো ওরকম।
জয়ন্ত সব সময়েই নিজের থেকে পল্লবীকে বেশি বিশ্বাস করে। এখন আবার করল। ঘাবড়েও গেল। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি তো জানো আমার মুখ ভালো না…. তাই বলে কাস্ট তুলে বলবে? ব্যস, কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আমি বললাম, নিজের অওকাতে থাক স্লা….. কাস্ট মারাতে এলে এমন গাঁড়পেঁয়াজি করব না…..
পল্লবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বৃষ্টি কি করছে ওই কাঁচের দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে…. জয়ন্ত বলে যাচ্ছে….
বলে নাকি, বংশ বংশ তোমরা এই রিজার্ভেশানের সুযোগ নিয়ে ডিজার্ভিং ক্যাণ্ডিডেটদের ভোগাবে…. একবার নিয়েছ নিয়েছ….. সরকার থেকে এগুলো বদলানো দরকার….
তুমি বলো, আমি চুরি করেছি? না ডাকাতি?
জয়ন্তর চোখে জল। গলাটা বুজে এলো। জয়ন্ত বলল, অফিসেও… জানো… স্লা অফিসেও এই কাস্ট.. রিজারভেশানের খোঁটা শুনতে হয়…. বলে বাবা এত বড় চাকরি করত…. আরে তোদের এই সুযোগ থাকলে তোরা ছাড়তিস? কেউ ছাড়ে কোনো সুযোগ? বাল বড় বড় কথা…..
পল্লবীর এবার কষ্ট হচ্ছে। একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটাকেও শুনতে হবে এসব? যদি ইউপি, কি বিহারে চাকরি পায়? পল্লবীর নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বৃষ্টির জন্য কষ্ট হচ্ছে।
চাউ দিয়ে গেল। জয়ন্ত বেসিনে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে এলো। এসে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বলল, যদিও সবাই আমারই সাপোর্টে কথা বলেছে…. কিন্তু ওই মালটা তো একাই একশো…. কি গলা মাইরি…..
পল্লবীর জগন্নাথদার গলা দারুণ লাগে। যখন চণ্ডীপাঠ করে গায়ে কাঁটা দেয়। মনে হয় বাবা যদি শুনতেন! গমগম করে পুজোমণ্ডপ। পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রগুলোও ওনার মুখে যেন কি পবিত্র লাগে। মনটা ভরে যায়। করোনার সময় কে একটা পুজো করেছিল, ওনার তখন করোনা হয়েছিল…. একটুও ভালো লাগেনি…..
জয়ন্ত বলল, চলো, কাঁচরাপাড়ায় লাঞ্চ করে নেব, এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।
পল্লবী বৃষ্টির হাত ধরে বাইরে এসে দাঁড়ালো। রোদটায় জ্বালাপোড়া লাগছে। জয়ন্ত টোটো ডাকতে গেছে। কল্যাণী স্টেশান যাবে। কিন্তু পল্লবীর ইচ্ছা করছে বাড়ি চলে যেতে। কিম্বা বৃষ্টিকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও। জয়ন্ত টোটো নিয়ে আসছে। টোটোচালকের পাশে জয়ন্তকে বসে থাকতে দেখে নিজের মনের চিন্তায় ছোটো হয়ে যাচ্ছে পল্লবী... সেও কি কোথাও বাবার মতো? নইলে এমন সংকীর্ণ চিন্তা তার মনে জন্মায় কি করে? নিজেকে অসহ্য লাগছে পল্লবীর... মাঝে মাঝেই সব অসহ্য লাগে। নিজেকে... বাবাকে... জয়ন্তকে... সবাইকে…..
বৃষ্টি বলল, মা, বাবা টোটো চালাতে পারে?
পল্লবী ঠাস করে একটা চড় বৃষ্টির গালে মারল…. বলল, কথা বলতে শেখোনি?!….