(এ নিতান্ত মজার জন্য লেখা। মতামত সম্পূর্ণ ক্ষেমীর। লেখকের দায় নেই।)
ক্ষেমঙ্করী বসু-রায়-মল্লিক-ভৌমিক-ভট্টাচার্য-পাল-নন্দী যেদিন চুল্টুলুলু গ্রামে বড় দারোগা হয়ে এলেন, সবাই প্রমাদ গুনল। কারণ অবশ্যই আছে। ক্ষেমঙ্করীর একটা তত্ত্ব আছে। তিনি হিসাব করে দেখেছেন সারা বিশ্বে অপরাধীদের পরিমাণ পুরুষেই বেশি। পুরুষমাত্রেই অপরাধপ্রবণ জাতি। সেই জন্যেই সারা বিশ্বে যতবার ঈশ্বর মানবরূপে এসেছেন, পুরুষ রূপেই এসেছেন। কারণ উদ্ধার করতে হয় পুরুষকে, নারীকে নয়। সেই ব্যাসদেব থেকে বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, মহম্মদ, শঙ্কর, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ সব পুরুষ। কারণ পুরুষদের উদ্ধার করতে হবে।
তো ক্ষেমঙ্করীর পুরুষ নিয়ে আরেকটি তত্ত্ব আছে --- স্বামী শুধরাও, জগত তরাও। মানে হল ক্ষেমঙ্করীর মতে যদি স্বামীরা শুধরে যায় তো সংসার শুধরে যায়, সংসার শুধরে গেলে পুত্রসন্তান শুধরে যায়। পুত্রসন্তান শুধরে গেলে সমাজ শুধরে যায়। তাই ক্ষেমঙ্করীর প্রকল্প হল --- স্বামী সংশোধন শিবির। এই নিয়ে প্রচুর পুরষ্কারও পেয়েছেন দেশ-বিদেশ থেকে। নারী নোবেল কমিটি থেকে নোবেল, নারী ম্যাগসেসে কমিটি থেকে ম্যাগসেসে, নারী গ্র্যামি থেকে গ্র্যামি ইত্যাদি। গ্র্যামি কেন? পরেই জানতে পারবেন।
তো ক্ষেমঙ্করী তো চুল্টুলুলু গ্রামে এলেন বড় দারোগা হয়ে। এসেই সব মহিলাদের ডেকে পাঠালেন। সবাইকে তাদের স্বামী, প্রেমিকদের দোষের কথা লিস্ট করে লিখে দিতে বললেন। সবাই সোল্লাসে লিখে ফেলল। কেউ কেউ এক্সট্রা পাতা চাইল। ক্ষেমঙ্করী জানতেন এরকম হয়। তিনি তাই অনেক লুজ পাতা, স্টেপ্লার আগে থেকেই আনিয়ে রেখেছিলেন। তারপর ডাক্তারও ছিল। অবশ্যই মহিলা ডাক্তার। কারণ অনেক মহিলা উৎসাহের চোটে লিখতে লিখতে জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। তাদের গ্লুকোনডি খাইয়ে, মাথায় বাতাস করে আবার বসিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। মোটামুটি তেরো ঘন্টা সময় দিয়েছিলেন ক্ষেমঙ্করী। এও তার অভিজ্ঞতা লব্ধ তত্ত্ব। এই সময়ের মধ্যেই তারা খসড়াটা বানিয়ে ফেলেন। বিশদে লিখতে গেলে তো স্বয়ং গণপতিকে লাগবে।
শুরু হয় গেল 'চুল্টুলুলু স্বামী প্রশিক্ষণ শিবির'। যারা নিজের থেকে এলো তারা তো এলোই। যারা নিজের থেকে এলো না, তাদের বাড়ি থেকে পেয়াদা গিয়ে পাকড়িয়ে নিয়ে এলো। ও আচ্ছা, একটা কথা তো বলিই নি, কেন ক্ষেমঙ্করীর এতগুলো পদবী। আসলে তিনি জীবনে যতবার বিয়ে করেছেন তাদের সবার পদবী উনি সঙ্গে রেখেছেন। কাউকে অস্বীকার করা মানে অপমান করা। অবশ্য নিন্দুকে বলে ওগুলো ওর কলারের অদৃশ্য স্টার, মানে কতগুলো পুরুষকে ঘায়েল করেছেন। ওগুলো ওর অ্যাচিভমেন্ট নাকি। নিন্দুকের কথা থাক।
তো পুরুষেরা তো সব এসে গেল। সবাইকে সার দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন ক্ষেমঙ্করী। সবার কেস হিস্ট্রী মিলিয়ে দেখা হয়ে গেল। প্রশিক্ষণ শুরু হবে উঠান ঝাঁট দেওয়া দিয়ে। প্রথম টাস্ক --- আসুন উঠান ঝাঁট দিই। তারপর চা করতে শেখানো। তারপর কাপড়-জামা ভিজিয়ে ভাত-ডাল চাপানো। গ্যাস না থাকলে উনুন ধরানো শেখানো। তারপর তরকারি কাটা থেকে শুরু করে জামাকাপড় মেলা শিখিয়ে রান্নার বাকি অংশগুলো শেখানো। তারপর রান্নাঘর পরিষ্কার করে স্নান করতে পাঠানো।
পুরুষদের কিছু অহংকার নাশ করতে হয়। যেমন তারা তর্ক করতে যতটা সক্ষম ঝগড়া করতে ততটা নয়। সেটা শেখানো হাতে ধরে। তারপর বড্ড খেলা আর রাজনীতি নিয়ে চর্চা তাদের। সেগুলো ছেড়ে দিয়ে সিরিয়ালের গুণাগুণ নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করানো।
তারপর আসে স্বভাবগত দুষ্ট পুরুষদের মানসিক বিকার ছাড়ানোর প্রকল্প। যেমন যারা চুরি করে, তাদের জন্য থানায় এখানে ওখানে পটল, ঝিঙে লুকানো থাকে। সেগুলো খুঁজে বার করতে হয়। যারা খুনী, তাদের জন্য আরশোলা রেখে দেওয়া হয়, সেগুলো টিপে টিপে মারার জন্য। যারা লম্পট, তাদের কোমরে ছাগী বেঁধে দেওয়া হয়, আর বলা হয় একশো পাক রোদে ঘুরে এসে সেই ছাগীকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে জমা দিতে। যারা মদ্যপ, তাদের চিরতার জলে সিমাইয়ের পায়েস করে দেওয়া হয়। যারা বউ পেটায় তাদের বুনো শুয়োরের খোঁয়াড়ে পনেরোদিন রাত্রিবাস করতে হয়। সেখানে সব শুয়োর বলা বাহুল্য মহিলাই হয়। যারা অলস তাদের মহামতি কোরিয়াপতি কিমের জীবনী পড়ানো হয়।
সন্ধ্যেবেলা প্রার্থনা সভা আর ক্ষেমঙ্করীর ভাষণ। প্রার্থনা সভা উদার। যে যে গুরুর দীক্ষিত বা যে ধর্মের মানুষ তাদের সেই অনুযায়ী আয়োজন। যারা নাস্তিক তাদের জন্য ক্ষেমঙ্করীর লেখা গান, “জানি জানি প্রভু তুমি নেই, তাই উল্লাসে মোরা নাচি ধেই ধেই/ জগত জড়ের মেলা, সবই ইন্দ্রিয়লীলা, তুমি ব্যাটা মিছেকথা, সেই সেই সেই”। এই গানের জন্যেই ক্ষেমঙ্করী গ্র্যামি পেয়েছিলেন, আগেই বলছিলাম না।
তো শিবির তো ভালোই চলছিল। পনেরোদিন হল। স্ত্রীরা বলছে স্বামীদের চরিত্রে নাকি বেজায় পরিবর্তনও আসছে। কিন্তু একটা গোল ঘটে গেল। ওই যে আছে না, ‘কি ছিল বিধাতার মনে’।
চুমকির স্বামী, পুতুটুনু ঘোষ, তার আবার কবিতা লেখার বাতিক। আর ক্ষেমঙ্করীর সব চাইতে দুর্বল জায়গাও ওটি। একদিন ‘কাপড় কাচো, ইজ্জত রাখো’ ওয়ার্কশপে হঠাৎ পুতুটুনুর পকেট থেকে একটা কবিতা পাওয়া গেল। আর সেকি যে সে কবিতা, স্বয়ং ক্ষেমঙ্করীকে নিয়ে কবিতা!
ক্ষেমঙ্করী ক্ষেমঙ্করী করছ তুমি কি?
এই দেখো না তোমায় নিয়ে কবিতা লিখেছি
ক্ষেমু গেল চোর ধরতে ক্ষীর নদীর কূলে
ক্ষেমুর মন নিয়ে গেল পুতুসোনা
হৃদয় মজল কাব্যবিলে
সবাই ভাবল আজ নিশ্চয় পুতুটুনুর শেষ দিন এই জগতে। ওমা! একি! কবিতা পড়ে কিচ্ছুটি না বলে ক্ষেমঙ্করী নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিল? তারপরের দিন শিবির ছুটি। তারপর আবার যদিও বা শিবির খুলল, আবার কবিতা পাওয়া গেল,
ও ক্ষেমু, ও ক্ষেমু, করছ তুমি কি?
এই দেখো না তোমায় নিয়ে ঘর বেঁধেছি
তোমার প্রাণে আমার প্রাণের কলিজা সেঁকেছি
উচ্ছে ভেবে তোমায় আমি কি ভুল করেছি
কাছে এসে দেখি এযে রাজভোগ পেয়েছি
কি অশালীন কবিতা! কিন্তু তাও, মানে তাও আবার ছুটি শিবির। ক্ষেমঙ্করী খায় না। শুয়ে থাকে। গান গায়। হাসে। একটা খাকি রঙের শাড়ি কিনে মাথায় ওড়না দিয়ে রাত বিরেতে ছাদে উঠে পায়চারি করে।
প্রেম আর শত্রুতা চাপা থাকে না। এও চাপা থাকল না। শিবিরে সব শিথিল হল নিয়ম। ক্ষেমুর চোখে কিসের যেন রঙ। সব তেজ গলে যেন সোনার ঝলক। পুতুটুনুর চোখেও যেন কিসের ঘোর। কিন্তু আশ্চয্যি কাণ্ডটা হল চুমকি, মানে পুতুর বউ, সে একদম চুপ। কেন? সবাই ফিসফিস করে, কেন কেন কেন? ইতিমধ্যে শিবিরে থাকতে থাকতে ছেলেরাও ভালো পরনিন্দাপরচর্চা শিখে গেছে। তাই ফিসফিসানির মধ্যে খানিক পৌরুষ ঢুকে গেছে। আগে যারা নারীবাদীদের সুবিধাবাদী বলে ক্ষ্যাপাতো, তারাও আজকাল ওসব কথা বলে না। চুমকি কেন চুপ!
এ রহস্য আর কেউ না জানুক, পাঠককে বলে আমি বিদায় নিই।
সেদিন পনেরোই আগস্ট। থানায় পতাকা উত্তোলনের দিন। সারা চুল্টুলুলু গ্রাম ঝেঁটিয়ে এসেছে। চুল্টুলুলু গ্রামে এখন সত্যিই অখণ্ড শান্তি। কোনো অপরাধ ঘটেনি এই শিবির চলাকালীন। আজ শিবিরের সদস্যরাই জিলিপি আর বোঁদে বানিয়েছে। মানে পুরুষেরাই। সবাই মিলে হইহই করে আনন্দ করছে।
হঠাৎ দেখা গেল চুমকি ক্ষেমঙ্করীকে ডেকে একটু আলাদা আসতে বলল। ক্ষেমঙ্করী জানে সে অপরাধী। কিন্তু ভালোবাসা কি আর নীতি মানে!
চুমকি আর ক্ষেমঙ্করী পাশাপাশি দাঁড়ালো। ক্ষেমঙ্করী ভাবছে সরি বলবে কি বলবে না, হঠাৎ চুমকি তার বাঁ হাতে চিমটি কেটে বলল, ওটা কি উড়ছে? ক্ষেমঙ্করী চুমকির ইশারা অনুযায়ী তাকিয়ে দেখল সে পতাকাকে ইঙ্গিত করছে। ক্ষেমঙ্করী কিছু বুঝল না, কি ইশারা, সে শুধু বলল, পতাকা।
চুমকি বলল, আরেকটা বাংলা কি হয়?
ক্ষেমঙ্করীর এবার নার্ভাস লাগছে। চুমকি কি বলতে চাইছে সে এই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে দেশের নাম ডোবাচ্ছে সে?
ক্ষেমঙ্করী নার্ভাস হয়ে বলল, পতাকার আরেকটা বাংলা হল ফ্ল্যাগ।
চুমকি আবার চিমটি কেটে বলল, আরে ধুর, ওটা ইংরাজি শব্দ... আমার ওর প্রেমে পড়ে এক্কেরে মাথাটা গেছে দেখছি…
ক্ষেমঙ্করী তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে বলল, না মানে ধ্বজা…
চুমকি হাসল। চোখ টিপল। তারপর বলল, এ ধ্বজা যতই ওড়াও, সে ধ্বজা না ওঠে, না ওড়ে…
এই বলে চুমকি "উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে ওই যে তিনি"... গাইতে গাইতে ভিড়ে মিলিয়ে গেল…
ক্ষেমঙ্করী চুল্টুলুলু গ্রাম থেকে বিদায় নিল। চাকরি থেকে ইস্তফা দিল। পুতুটুনুকে বিয়ে করে এখন শুনেছি হিমালয়ে গেছে। ওখানে কি এক বাবার জড়িবুটিতে নাকি মায় বরবটিও তলোয়ার হয়, আর এতো... যাক গে... অনেক পৌরুষকে বরবটি বানিয়েছি, তাই হয় তো ভোলাবাবা আমায় এই ভাবেই প্রায়শ্চিত্ত করতে বলছে, দেখা যাক কপালে কি থাকে!
(ছবি Suman Das)