Skip to main content

        খোঁজ থাকে। কিসের খোঁজ বুঝি না। মানুষের যে ঈশ্বরের খোঁজ, সেই ঈশ্বরের কথা কত বইতে কত ভাবে। কত আবেগ, কত নীতি, কত বর্ণনা, তার কোনো শেষ নেই। মোদ্দা কথা মানুষের নিজের ভিতর নিজেকে নিয়ে একটা বোঝাপড়ার যেন আর শেষ নেই। যেই তুমি মনে করেছ একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছ, অমনি এমন একটা ঢেউ এলো যে সব এলোমেলো হয়ে গেল। তুমি যা যা ভেবে রেখেছিলে সব গেল গুলিয়ে। কিচ্ছু নিজের মত করে করা হয়ে উঠল না, নিজের ইচ্ছার মত নিজেই হয়ে ওঠা গেল না। এমন হয়, সবার হয়। 
        সন্ধ্যের অন্ধকার ধুম করে কখন নেমে এলো খেয়াল করিনি। গ্রামের মধ্যে আকাশ, মাঠ-ঘাট-বাটের মত একটা সত্যকারের চরিত্র। শহরের লোকের সারাদিন আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাবার অবসর বা ইচ্ছা থাকে না একান্ত দরকার না পড়লে, কিন্তু গ্রামের মানুষের সারাদিন একবার হলেও আকাশের দিকে চোখ যাবেই, অকারণেই। গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাই বারবার অকারণেই আকাশে চোখ যাচ্ছে। শ্রাবণের মেঘ সূর্যাস্তের ঘাটে নাইতে এসেছে যেন গেরুয়া গায়ে। 
        অপরাহ্ন থেকে গোধূলি হয়ে কখন অন্ধকার নেমেছে খেয়াল করিনি। খেয়াল হল বাঁশির আওয়াজে। কে বাজায়? তাকে খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম অন্ধকার নেমেছে, তাকে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছি কই? মনের তলা থেকে একটা একটা সিঁড়ি চড়তে চড়তে বাইরে এলাম, নিজের চোখ আর কানের পাশে এসে দাঁড়ালাম। নাকে নেশার গন্ধ এলো। কয়েকজন গ্রামের লোক চায়ের দোকানের মৃদু আলোর সামনে রাস্তার একধারে মাটিতেই বসে আছে। তাদের মধ্য একজন নেচে নেচে গান গাইছে, বাঁশি বাজাচ্ছে। কি সুর বাজাও? প্রেমের সুর। গানের কথায় আদিরস। ভালোবাসার আগুনের কথা, বিরহানলের কথা। না পুড়লে ভালোবাসা হয়? 
        হঠাৎ খ্যানখেনে গলায় কে বলে উঠল, কবি কি ভেবে লিখেছে সেই জানে... কি বলো...
        অন্ধকারের মধ্যে থেকে নেশায় চুর আরেকটা কন্ঠস্বর ভেসে এলো...থামবি (এ যে ধমক)... গানটা শুনতে দে। 
        চোখ অন্ধকারের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। দেখলাম যাকে বকা হল, সে একজন মাঝবয়েসী মহিলা। একটা একটা জীর্ণ ম্যাক্সি গায়ে, গলায় কণ্ঠী, কথায় নেশার টান, চোখদুটো শুশুকের মত সমস্ত অভাব যন্ত্রণা থেকে গলা উঁচু করে যেন শ্বাস নিতে চাইছে ওই বাঁশিতে, ওই গানে। আর যে গান গায়? তার গায়ে নানা রঙের তাপ্পি মারা একটা জামা, কোমরের নীচে লুঙ্গি। বয়েস আন্দাজ ষাটের উপর তো হবেই। সে নাচছে। যৌবন যেন এই অন্ধকারে তার বার্ধক্যকে ফাঁকি দিয়ে এসে বসেছে তার শরীরে। তার নাচের কি অপরূপ ভঙ্গীমা, হাসিতে নেশার মাধুর্য। এ নেশার বস্তু শুঁড়িখানায় মেলে না। এ নেশার বস্তু সে নিজেকে পুড়িয়েই পেয়েছে। 
        আবার গান শুরু হল। সে মেয়েটা হেসে উঠল। সে পাগল? সংসারে কে পাগল না? কেউ প্রকাশ্যে পাগল, কেউ গোপনে। বাইরের পাগল দেখে ভিতরের পাগল হিসেবি বুদ্ধিকে ভেংচি কাটে। এখনও কাটল। গানের দুপদ গাওয়া হল, তারপর হঠাৎ-ই সে বাঁশির সুরে ডুবে গেল। গানের বাকি পদ কি? সে হাসল। জানে না, না বলবে না বুঝলাম না। সে বাঁশির সুরে ডুবে গেল। হাঁটতে শুরু করল। কোথায় থাকো? সে উত্তর খুব স্পষ্ট করে দিতেও সে নারাজ। দেবেই বা কেন? ঠিকানা না ভুললে ঠিকানা পাবে কি করে? সংসারের যে ঠিকানা সেখানে সে দরিদ্র, অপমানিত, লাঞ্ছিত পদে পদে। সে সেটা ভুলতে চায়। তার খিদে, তার অপমান, তার জ্বালাপোড়া সব ভুলতে চায় গলায় ঢালা বুক পোড়ানো শুঁড়িখানার গরলে, প্রাণ ভাসাতে চায় তার স্মৃতির গোলায় পাকানো দুঃখ বিরহ গলানো সুরে। 
        হাঁটতে শুরু করল। অন্ধকারে আর দেখা যায় না। পাশে পাশে চলেছে সেই মেয়ে, এখন যেন সে অন্য মানুষ। বাঁশির সাথে সাথে কত কি বলছে সে, অসংলগ্ন। কেউ বলছে না তাকে, এই মেয়ে চুপ! কেনই বা বলবে, কেই বা বলবে। হোক তার কথা অসংলগ্ন, কিন্তু কথার মধ্যে যে আন্তরিক সুর বাঁশিওয়ালা সেটা বোঝে। সে বোঝে বলেই নিত্যকারের দরদাম, মান-সম্মানের দায় এড়িয়ে নিজেকে আড়ালে নিয়ে চলেছে। চাঁদের গায়ে ইচ্ছে করেই লাগিয়েছে গ্রহণ। 
        আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম সারা গায়ে অন্ধকার মেখে। আবার নিজের চোখ আর কানের থেকে সরে আসছি। মনের গভীরে সেই ব্যথাটা। কিসের ব্যথা? কিসের খোঁজ? তীরের খোঁজ। মাঝি কই তুমি? তোমায় দেখা যায় না। তোমার বাঁশির আওয়াজ কানে এসেছে মাঝে মাঝে অন্ধকারে, কোথায় ভাসছি মাঝি? কোনদিকে যাচ্ছি? জানি না। শুধু বাঁশি থামিও না মাঝি। পথ শূন্য হই, দিশাহীন হই ক্ষতি নাই, তুমি শূন্য যেন না হই। ওগো আমার আজন্ম আকুতির গতি, বাঁশি থামিও না, এ ঘোর অন্ধকারে শ্রবণহারা কোরো না।