বাইশে শ্রাবণে কবির অন্তিমযাত্রার যে ভিডিওটা দেখি, তাতে কতটা উন্মাদনা আর কতটা আন্তরিক শূন্যতার হাহাকার --- সংশয় জাগে। রবীন্দ্রনাথকে ভারতবাসী সেদিন কতটা নিজের ভিতরে নিয়েছিল, সন্দেহ হয়। আজও কতটা নিতে পেরেছে জানি না। কয়েকটা কবিতা আর গানেই যেন মানুষটার সব প্রতিভা শেষ হয়ে গেল। শুধুই নিজের ব্যক্তিগত শোকে-দুঃখে-আনন্দে-বিষাদে তাঁকে স্মরণ করার মধ্যে স্বার্থ চরিতার্থতার ভাব আছে, যদিও খুব সুক্ষ্ম। কিন্তু তাঁর পাঠশালায় বাধ্য, উৎসুক, বিনীত ছাত্র কতজন হতে পেরেছিলেন, বা পেরেছি? জানি না। কয়েকটা কথা সে মানুষটার চিঠির ভাষায় শোনা যাক। আজ রবীন্দ্রনাথের অনুভবে রবীন্দ্রনাথকে একটু দেখা যাক। প্রথম চিঠির অংশ-
"দেশের অধিকাংশ লোকে আমাকে হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করতে পারে না, এবং আমার আঘাতে অপমানে যথেষ্ট ব্যথিত হয় না, এই সত্যকে আমি স্বীকার করে নিয়েছি - বুঝেছি দেশের মধ্যে তার স্বাভাবিক কারণ রয়েচে। যদি দেখা যায় সকল চেষ্টা সত্ত্বেও আমার বাগানের মাটিতে আমের মধ্যে কীট জন্মায় তবে মনে আক্ষেপ হতে পারে কিন্তু আবহাওয়ার সঙ্গে রাগারাগি করতে গেলে ছেলেমানুষি হবে....
তোমাদের সমাজের দিক থেকে আমি ব্রাত্য, আমি একঘেয়ে, আমি অস্পৃশ্য। এই বর্জ্জন আমার জীবনে দেবতার বরের মত কাজ করেছে, এতে মানুষের অভিশাপ যদি লাগে, তবে তাতে সাপের নিঃশ্বাস লাগবে মাত্র বিষ লাগবে না...
... যখন জীবলোক থেকে বিদায় নিয়ে যাব তখন আমার ভাগ্যবিধাতাকে অক্ষুণ্ণ প্রণাম নিবেদন করে যেতে পারব - তিনি আমাকে অনেক দিয়েচেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এই মিনতি জানিয়ে যাব যে বাংলাদেশে আর নয়।" (১৭ই অগস্ট, ১৯৩৪)
এর কারণ ছিল হয়ত রবীন্দ্রনাথের মানসলোকের ভারতের সাথে বাস্তব ভারতের বিরোধ। আরেকটা চিঠির অংশে আসি,
"গভীরভাবে আমি তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভারতীয়। যথার্থ ভারতবর্ষ মহাভারতবর্ষ। মনুসংহিতা ও রঘুনন্দনের ছাঁটাকাটা হাড়-বেরকরা শুচিবায়ুগ্রস্ত ভারতবর্ষ নয়। যে দেশ কেবলি বিশ্বের ছোঁওয়া বাঁচিয়ে নাক তুলে চলে সে রুগ্ন দেশ - আমি সেই পঙ্গু দেশের মানুষ নই। আমি ভারতবর্ষের মানুষ - সেই ভারতবর্ষ স্বাস্থ্যের প্রাবল্যদ্বারাই চিরশুচি - সে আমার মহাকাব্যের চিরন্তন ভারতবর্ষ।" (২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৩)