বাঙালি গর্ব করতে ভালোবাসে। এখন গর্ব করতে কে না ভালোবাসে! বাঙালিও বাসে। তা শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে বাঙালির গর্ব করার বস্তুও ছিল মেলা। সাহিত্যে, শিল্পে, সিনেমায়, বিজ্ঞানে, খেলাধূলায়, রাজনীতিতে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ সে দিন নেই। যে সিনেমার উপর বাঙালির একাধিপত্য ছিল, সেও ক্রমে পশ্চিম আর দক্ষিণের ঝড়ে প্রায় ধরাশায়ী অবস্থায়। বইমেলা ইত্যাদিতেও জয়পুর প্রমুখেরা যে গরিমায় সেজে উঠছে সেখানে গর্বের জায়গায় বড় চ্যালেঞ্জ। এককালে বাঙালির অধ্যাত্মিক জগতেও বেশ নামডাক ছিল। নানা গুরু, অবতারেরা প্রায় ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মত এসেছেন। আজকে সেও দক্ষিণ আর পশ্চিমের দখলে। সদগুরু, প্রেমানন্দ, রবিশঙ্কর, ইত্যাদি ইত্যাদি। মায় বাঙালির গণেশ পুজোর আধিপত্যও বুঝিয়েছে বাঙালির আপন ইষ্টের উপর ভরসা কমেছে। আজকাল হাস্যরসের উপাদানেও মেলা ভেজাল মিশছে। রিলেও টেক্কা দিচ্ছে ভুবন বাম, আশিষ ইত্যাদিরা।
তবে বাঙালির হাতে কি আছে? কি এই গভীর অবসাদ থেকে বাঙালিকে ত্রাণ দিতে পারে? কি আছে বাঙালির তবে? আছে আছে। সে হল, প্যাণ্ডেল। বাঙালি চাইলেই যে কোনো বড় স্থাপত্যের নকল বানিয়ে দিতে পারে। কিভাবে? প্যাণ্ডেলে! সে বুর্জ খালিফা হোক, কি সোমনাথ মন্দির, কি স্বামীনারায়ণ টেম্পল, কি চারধাম, কি হোয়াইট হাউস, কি চিরকালের চেনা লোকের তাজমহল, লালকেল্লা ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাই এখন মহালয়া থেকেই বাঙালি নাওয়া-খাওয়া ভুলে প্যাণ্ডেল দেখতে ছুটছে। তারা ভক্ত, কিন্তু মায়ের না। প্যাণ্ডেলের। বাঙালির হয় তো নিরানব্বই শতাংশ চণ্ডীর কোনো একটা স্তব গোটা মুখস্থ বলতে পারে না, দুর্গাপুজোর সময় চারঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে। মা ভাবে আমি দেব, শিব ভাবে আমি, লক্ষ্মী সরস্বতী ভাবে আমি দেব, লুকিয়ে হাসে লাইট, প্যাণ্ডেলযামী।
প্যাণ্ডেলের পর প্যাণ্ডেল। নকলের পর নকল। অবশ্যই এ শিল্প। মানুষ যখন গুহায় বাইসন এঁকেছিল সেও নকল ছিল। প্রকৃতিকে নকল করেই তার সঙ্গীত, আঁকাঝোঁকা। কিন্তু নিজের বানানো জিনিস নিজেই নকল করলে সেটা কি আর সেই স্তরের আর্ট হয়?
বাঙালির এই জাতীয় উৎসবে আর সব দিকের গরিমা গিয়ে যা পড়ে আছে সে শুধুই প্যাণ্ডেল। আর বাড়ছে মদের বিক্রি। অবশ্যই সব মিলিয়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। একটা বড় উৎসবে সে তো হয়ই। তার আনুষাঙ্গিক যা সমস্যা সে মেনে নিতেই হবে। বাচ্চাগুলো স্কুল থেকে ফেরার সময় ট্রেনে উঠতে পারছিল না, কারণ মহালয়া থেকেই কিছু কিছু লাইনে প্যাণ্ডেল দেখার এমন ভিড়। ভাগ্যে স্কুলগুলো ছুটি দিয়েছে। ভিড়ে রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স আটকে যাচ্ছে। মদের ফোয়ারা ফুটছে। সব উৎসবের অঙ্গ।
মহারাষ্ট্রের গণপতি উৎসবের সঙ্গে আমাদের একটা বড় জায়গায় পার্থক্য হচ্ছে, গণেশ মহারাষ্ট্রের ইষ্টস্বরূপ। বাড়ি বাড়ি তাঁর অধিষ্ঠান। সঙ্গে সে পুজো সার্বজনীনও বটে। কিন্তু দুর্গা আমাদের শুধুই সার্বজনীন। বাড়ি বাড়ি দুর্গা অধিষ্ঠিত দেবী নন। সে ক্ষেত্রে কালী কিছুটা আর বেশিরভাগই গোপাল, নয় রাধাকৃষ্ণ। তাই দুর্গাপুজোটা বাঙালির পাড়ার উৎসব। ঘরের নয়। যে ভুলটা হিন্দি পরিচালকেরা তাদের সিনেমায় দেখিয়ে থাকেন। তারা বাঙালি বাড়ি মানেই দুর্গা মূর্তি দেখিয়ে থাকেন। যা আমি অন্তত আজ অবধি কটা বাঙালি সিংহাসনে দেখেছি মনে পড়ে না। সেখানে নানা গুরুদেব, লক্ষ্মীর পট, শিবলিঙ্গ আর কালী-কৃষ্ণই থাকেন। কিন্তু মহারাষ্ট্রের বহু বাড়িতে গণপতি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অধিষ্ঠিত দেবতা। মুম্বাইয়ের সিদ্ধিবিনায়ক মন্দিরের জনপ্রিয়তা মহারাষ্ট্রবাসীর গণেশ যে ইষ্টদেব সে সাক্ষ্যবহন করছে। বাঙালির? নেই। তার দুর্গার নানা নকলের গর্বে বানানো প্যাণ্ডেল আছে। কিন্তু কোনো মন্দির সে অর্থে নেই। ওই বিষ্ণুপুরের মত কয়েকটা হাতে গোনা ছাড়া, যার অস্তিত্ব সিংহভাগ বাঙালি জানেই না। অবশ্য মহারাষ্ট্রের আরেকদিকও আছে। সেখানে দলিতদের অধিষ্ঠিত দেবতা হলেন বুদ্ধ আর আম্বেদকর। আমাদের এখানে যেমন হরিচাঁদ ঠাকুর।
অনেকে বলবেন, কালী আর দুর্গা একই তো কথা। তত্ত্বত তাই। কিন্তু উৎসবত তাই তো নয়। যেমন জন্মাষ্টমী আর রামনবমীর মধ্যে উৎসবের তারতম্য।
একদিন সব প্যাণ্ডেল চলিয়া যাইবে, একদিন সব আলোকসজ্জা চলিয়া যাইবে, একদিন বৃদ্ধবৃদ্ধাদের অসুস্থ করিয়া, ঘাটে পৌঁছাইয়া সব মাইকও নীরব হইবে, সেইদিন কোন বাঙালিকে মা রাখিয়া যাইবেন? এক অবসাদগ্রস্ত, হীনমন্যতায় ভোগা জাতিকে? যে হিন্দি ইংরাজি বলিয়া আপনাকে জগতের উপযুক্ত বলিয়া প্রমাণ করিতে উদ্যত। যে আগমনী ভুলিয়াছে, বিজয়ার প্রণাম ভুলিয়াছে, যে চণ্ডীর স্তব ভুলিয়াছে (হনুমান চালিশার বাংলা ভার্সান এখন জনপ্রিয় হচ্ছে), মহালয়ার নামে টিভিতে বালখিল্য প্রহসনকে অনুমোদন করিয়াছে, যে পুজার শুদ্ধতা নেশার রঙে ভাসাইয়াছে…. সে কোন পথে চলিয়াছে?