ঠিক কী হয়েছে আমাদের? রাজনীতি ক্ষমতার লড়াই। একজন যাবে একজন আসবে। কিন্তু সমাজ? আমরা তো প্রশাসনিক ভবনে বাস করি না। সমাজে বাস করি। প্রশাসনিক ভবনে যাকেই আমরা আনি তাদের সিদ্ধান্তের ঠিক-ভুল আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে এ সত্য। কিন্তু তারা কেউ চিরস্থায়ী নয়। তারা আসে আবার চলে যায়। আবার নতুন জন আসে। কিন্তু আমাদের জীবন চলে আমাদের সামাজিক নিয়মে, প্রথায়, উৎসবে।
বাঙালির রাজনীতিতে ক্ষমতার উগ্র প্রদর্শন, গোলাবারুদ, বোমাবন্দুক আছেই। ইতিহাস সাক্ষী। কিন্তু বাঙালি সমাজ? তার একটা শান্ত ধারাও আছে। তার উত্থান-পতনের ইতিহাসও আছে। একটা সময় বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার শরণার্থী এল। তাদের নিয়ে বাংলা একটা জায়গায় থিতু হল। সময় লাগল, কিন্তু হল। তারপর খাদ্য আন্দোলন। তারপর একটা সময় বাংলার কিছু মহলে নকশাল আন্দোলন চলল। তাও থিতু হল। তারপর এল ইমার্জেন্সির সময়। বামসরকারের ভূমি সংস্কার। এর বহুদিন পরে আবার এল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন।
বাঙালি সমাজ তার ভদ্রলোক, বুদ্ধিজীবী, তর্কপ্রিয়তা আর শান্তিপ্রিয়তা - এমন একটা ছবিতে দাঁড়িয়েছিল। মোট কথা বাঙালির সেদিন নিজের কিছু বলার ছিল। নিজের কিছু মত ছিল। সমাজে অনেকবার আলোড়ন এসেছে, বাঙালি নিজের মত করে নিজের আদর্শেই তা সামাল দিয়েছে। বাঙালি সমাজে ধর্ম চিরকালই ছিল। সে ধর্মের ধারাও নানাভাবে বদল হতে হতে তারও নিজস্ব একটা রূপ নিয়েছে। সেখানে বৃহত্তর সমাজে মহাপ্রভু চৈতন্যের ভক্তিরসের প্রভাব, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলনের মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবীমহলে প্রভাব, তাছাড়াও আরো অনেক গুরুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছোটো ছোটো গোষ্ঠী। সব ছিল। আছেও। বৈষ্ণবের গোঁড়ামি যেমন ছিল, শাক্তের উদারতাও তেমন ছিল। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের শিক্ষায় এক উদার ধর্মবোধে বাঙালির সমাজ জারিত হয়েছে দীর্ঘদিন। জাতপাত নিয়ে ভারতের অন্যান্য জায়গায় যেমন ছবি, বাঙলার ছবিটা ভিন্ন এখানে তাই।
কিন্তু হঠাৎ করে বাঙালি যেন তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। সে যেন স্পষ্ট করে কোনো কথাই জোরের সঙ্গে বলতে পারছে না। এত বেশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে আত্মকলহই কী এর কারণ? অসম্ভব আত্মতুষ্টিতে ভোগাই কী এর কারণ? আজ বাংলার যে কোনো দিক নিয়ে নিন্দা করতে এক শিশুও পারদর্শী। বাংলার সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, সিনেমা ইত্যাদি যাই হোক না কেন ঘরে বাইরে নিন্দার ঢেউ। কিন্তু কেন? আমাদের পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নির্মাণ করে সেখানে সর্বেসর্বা হয়ে পরম আত্মতুষ্টিতে মাথা ঝুঁকিয়ে দেওয়াই কী এর কারণ?
বাংলা সমাজ তো মুক্তমঞ্চ নয়, যে এখানে এসে যে খুশি তার মত যা খুশি করে যাবে। সব সমাজের একটা নিজস্ব ধারা থাকে। প্রথা থাকে। বিশ্বাস থাকে। তা অবশ্যই বদলায়। সে পরিবর্তন ভালো থেকে আরো ভালোর দিকে গেলেই তো ভালো। গ্রহণযোগ্য। সমাজে ভালো বলতে কী? তার প্রথম উত্তর - ইক্যুয়ালিটি, লিবার্টি এবং ফ্র্যাটার্নিটি। সমতা-স্বাধীনতা এবং ভ্রাতৃত্ব। হ্যাঁ, ফ্রেঞ্চ রিভোলিইশ্যানের কথা। এই বিশ্ব নাগরিক হওয়ার একমাত্র সূত্র। আমার স্বাধীনতা বোধ যেন অন্যের সমতার অধিকার বা আমার তার প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধের অঙ্গীকারকে অস্বীকার না করে। স্বাধীনতা সেই দায়বদ্ধতা নিয়ে চলুক। আমাদের সংবিধানের প্রিয়াম্বেলেও এই কথাগুলোই আছে, সঙ্গে জাস্টিস কথাটাও আছে।
বাঙালি সমাজেই জন্মেছি আমি। লালনগীতি, শ্যামাসংগীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদী, রজনীকান্তগীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতি এসব অনায়াসে বিনা বাধায় রক্তে মিশেছে, স্নায়ুতে, হৃদয়ে মিশেছে। আরেকটু বড় হলে দর্শন হিসাবে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ, গান্ধী, কথামৃত, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি থেকেও একই সুরের ধারা পাচ্ছি। এমনকি প্রবল বামপন্থী এম এন রায়ের লেখাতেও পাচ্ছি অতীতের ভারতে বেদ বেদান্তের গ্রহণযোগ্য কথাগুলোকেও আমাদের নিতে হবে। শূন্যের উপর ভবিষ্যৎ গড়া যায় না। অতীত আর বর্তমানের সঙ্গে সে একসূত্রে গাঁথা। তাকে অস্বীকার করা যায় না। বিবেকানন্দও তাই বলছেন, অতীতের সব ভালো না। কিন্তু যেটুকু ভালো গ্রহণযোগ্য তা-ই নিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ সুভাষ গান্ধীরও একই বিধান। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন এর পূর্ণ বাস্তবায়িত রূপ।
আসল কথাটা হল অতীতে যা-ই থাকুক না কেন, যিনি যত বড় মানুষই হোন না কেন, ঘৃণা-অসাম্য-প্রশ্নহীন আনুগত্যের কাছে কোনো আধুনিক সমাজ মাথা নোয়াবে না। সবার উপরে এই আদর্শ। সদ্য আমেরিকাতেও যে আন্দোলনে সবাই রাস্তায় নেমেছে তার কারণও খানিক এমনই। ফরাসী বিপ্লবই সেদিন ঠিক করে দিয়েছিল মানুষের সমাজের আসল ছবিটা কী হওয়া উচিৎ। আসলে মানুষের আত্মার আসল সুরটা সেদিন ফরাসী বিপ্লবে ধরা পড়েছিল। রাজা আর পুরোহিতের পায়ের তলায় দীর্ঘদিন নিষ্পেষিত হতে হতে সেদিন মানুষ হুংকার দিয়ে উঠেছিল। তার আত্মার আসল সুরটা মুক্তির রাস্তা খুঁজেছিল।
সেদিন বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, যা গোটা ভারতের নবজাগরণ বলে বিশ্বাস তা প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ভাবধারার মিলনেই ঘটেছিল। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষায় পাশ্চাত্যের শিক্ষার আলো মিশেছিল, প্রাচ্যের সঙ্গে সঙ্গে। বিবেকানন্দর যে নববেদান্ত সেও যে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মিলনের ফল, তা একটু গভীরে পড়লেই বোঝা যায়। বিবেকানন্দ বলেন, যে জাত বলে বা যে মানুষ বলে আমার আর কিছু শেখার নেই, সে জাত বা সে মানুষ মৃত। আজ যে নতুন হিন্দুত্ববোধ জেগেছে সে ধারা রবীন্দ্রনাথের সময়েও জেগেছিল, তিনি লিখছেন,
“বর্তমান সময়ে কতকগুলি বিশেষ কারণে হিন্দু আপনার হিন্দুত্ব লইয়া ভয়ংকর রুখিয়া উঠিয়াছে। সেটা সম্বন্ধে তাহার মনের ভাব বেশ সহজ অবস্থায় নাই। বিশ্ব-রচনায় এই হিন্দুত্বই বিধাতার চরম কীর্তি এবং এই সৃষ্টিতেই তিনি তাঁহার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করিয়া আর-কিছুতেই অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না, এইটে আমাদের বুলি। সাহিত্যের বাস্তবতা ওজনের সময়ে এই বুলিটা হয় বাটখারা। কালিদাশকে আমরা ভালো বলি, কেননা তাঁহার কাব্যে হিন্দুত্ব আছে। বঙ্কিমকে আমরা ভালো বলি, কেননা স্বামীর প্রতি হিন্দুরমণীর যেরূপ মনোভাব হিন্দুশাস্ত্রসম্মত তাহা তাঁহার নায়িকাদের মধ্যে দেখা যায়; অথবা নিন্দা করি, সেটা যথেষ্ট পরিমাণে নাই বলিয়া।”
আজকের হিন্দুত্বও এমনই। সে কারোর কথা শোনে না। তার যেন কোথা থেকে কিছু শেখার নেই। সে নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবী করে। সে আস্ফালন করে।
বাঙালি সমাজের দুটো আদিম সমস্যা আছে। এক, তার হুজুগে মেতে যাওয়া অল্প উদ্দীপনাতেই। দুই, তার ঈর্ষাকাতরতা। কিন্তু কয়েক দশক ধরে বাঙালি সমাজে আরেকটা রোগ দানা বেঁধেছে, সেটা হল সিউডো-ইন্টেলেকচ্যুয়ালিজম। আসল ইন্টেলেকচ্যুয়ালিজমের কথা হল, সে আগে থেকেই মত প্রতিষ্ঠা করে তর্কে নামে না। অথবা ইন্টেলেকচ্যুয়ালিজম মানেই যে শুধু তর্কসর্বস্ব হওয়া তাও তো নয়। কিন্তু এই দুটো বাংলা সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকল। ভীষণ বায়াসড, ন্যারো, কূট তার্কিককে ইন্টেলেকচ্যুয়াল ভেবে ভুল হতে লাগল। যেমন নামাবলী আর কণ্ঠি আছে মানেই বৈষ্ণব, তেমন। তার মধ্যে মহাপ্রভু নির্দেশিত “তৃণাদপি সুনীচেন….” ইত্যাদি গুণ আছে কিনা দেখার দরকার হল না। তেমনই যা কিছু ভারতীয় তাকে নস্যাৎ, বিশেষ করে হিন্দুদর্শন সম্বন্ধীয়, অন্য ধর্ম নিয়ে নীরব বা স্বল্প কনসিডারেট, আগে থেকেই জানে কী মত প্রতিষ্ঠা করতে হবে, ফলে বাদবিতণ্ডার বাদ গেল বাদের খাতায়, বিতণ্ডা, ঈর্ষা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নির্মাণ করে হামবড়াভাবে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল ছেয়ে গেল। এবং সব মিথ্যারই যা পরিণাম হয় তাই হল, ক্রমে দুর্বল হল, গোটা ভারতে, তথা বিশ্বে অপ্রাসঙ্গিক হল। কিন্তু তাও স্বীকার করল না তার কোথাও একটা মস্ত ফাঁকি আছে। সেই ফাঁক দিয়ে নানা বেনোজল ঢুকে গেল। তারা চোখ বন্ধ করে চীৎকার করল, ওরা অভদ্র, অসংস্কৃত, আর ওদিকের ওরা গোবলয়ী….ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তদ্দিনে বড় দেরি হয়ে গেছে।
আজ বাংলা সমাজ আবার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। তার উপরে যে রামনবমী চাপানো হচ্ছে, সে তার কোনোদিনও ছিল না। কিন্তু তাকে সে না করতে পারছে আপন, না করতে পারছে দূর। কারণ তার মধ্যেই কেউ কেউ ভবিষ্যতের আশার আলো দেখছে। ফলে যে গরু দুধ দেয় তার লাথিটাও যেমন খেতে হয়, এই বিশ্বাসে সেও সহ্য করে নিচ্ছে। অবশ্য তার আর কোনো বিকল্পও নেই। কারণ তার আদর্শ, বিশ্বাস সব মরুপথে হারিয়েছে। তবে উপায়? রবীন্দ্রনাথ তো আর ফিরবেন না। বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, চৈতন্য যে সাজে ফিরবেন তার সঙ্গে মূলের অনেক পার্থক্য হবে। কিন্তু সে পার্থক্য ধরার মত বাঙালির অভাব হবে তার চাইতে বেশি। তবে উপায়? উপায় সেই বুদ্ধিজীবীতাকে ফিরিয়ে আনা। নিজের অহংকার, আত্মতুষ্টি জলাঞ্জলি দিয়ে আবার নিজের জাতের মূলের কাছে ফেরা। সেখান থেকেই আসবে সঞ্জীবনী। পঁচিশে বৈশাখ চাট্টি সেজেগুজে পঞ্চাশটা কবিতা গান গেয়ে নেচে-কুঁদে না। রবীন্দ্রনাথকে আরো গভীরে আবার করে পড়তে হবে। চর্চায় আনতে হবে, শুধু তর্কে না। বিশ্বের বুদ্ধিজীবীমহলে যে যে কাণ্ডকারখানা ঘটে চলেছে তার সম্বন্ধে নির্মোহ ধ্যানধারণা থাকতে হবে। সর্বোপরি ভ্রাতৃত্ব-স্বাধীনতা-সমতার আদর্শে দাঁড়ালে তবেই ভয়হীন, ত্রাসহীন মুক্তসমাজ আবার ফিরে পাব।
আমাদের অনেক সমস্যা। বেকারত্ব থেকে পানীয়জল, স্বাস্থ্য শিক্ষা থেকে দুর্নীতি অনেক অনেক সমস্যা। কিন্তু তার উপায় ধর্মগ্রন্থ বলে না। তার উপায় আছে উদার বৌদ্ধিক চর্চায়। আধুনিক শিক্ষায়। ধর্ম ব্যক্তিগত জীবনে শান্তির খোঁজ দেয়। উৎসবের আয়োজন করে। কিন্তু তার বেশি করতে গেলে ভালোর চাইতে ক্ষতিই করে বেশি। বহুত্ববাদ বা প্লুরালিজম হল নানা ধর্মের সহাবস্থানের একমাত্র উপায়। হিন্দুধর্ম যেহেতু বহুসিদ্ধান্তবাদী চিরকাল, তাই তার মধ্যে এ চর্চা প্রাচীন, অন্য ধর্মের তুলনায়। সেই বহুমত, বহুপথকে এক সংবিধানের শাসনে রেখে সমাজ যদি চলে তবে সে সমাজ শান্তির হবে। আর তার উপর তীক্ষ্ম নজরদারির ভূমিকা আমাদের সবার। একে এড়িয়ে না তো গণতন্ত্র সঠিক অর্থে থাকবে, না সমাজ, না নাগরিক হিসাবে আমি।