সৌরভ ভট্টাচার্য
13 June 2019
বাঙালির হিপোক্রেসি বিখ্যাত। আজ খানিক আগে বাজারে গেছি। আমার প্রিয় একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে চা খেয়ে প্রতিদিন হেঁটে ফিরি। দোকানটা রেলের কারখানার সামনেই হওয়াতে প্রচুর রেলের লোকেরা আসে চা খেতে। আজ দুই মাঝবয়েসী বেশ পদস্থ বাঙালিবাবুর কথা শুনলাম।
- "ভেলোর (cmc) চেন্নাই অ্যাপোলোও কি লাগাতার ধর্মঘটে সামিল হচ্ছে নাকি?
- "না না প্রতীকী হয়ত করতে পারে"
- "বাঁচা যায় তবে, আমার এই স্যাটারডে তে চেন্নাইয়ের টিকিট কাটা করমণ্ডলে"
- "ওই প্রস্টেটের সমস্যাটা"?
- " আর বলবেন না, এখানে তো এরা প্রায় মেরেই ফেলেছিল ক্যান্সার বলে"
- " ও হ্যাঁ শুনেছিলাম.. আরে আমার শালীরও তো..."
এর পরে সেই একই গল্প। বহু বাঙালিরও একই গল্প। আমিও নিজেও তাই ভাবতাম যতদিন না বুঝলাম এরা এখানকার সরকারি হাস্পাতালের সাথে ওখানের প্রাইভেট বা মিশনারী হাস্পাতালের তুলনা করে। আমাদের সরকারি হাস্পাতালের অবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রবন্ধ লেখার কিছু নেই। এতগুলো চিকিৎসকের এই সাংঘাতিক মনের জোর আর প্রতিবাদের শক্তি একদিনে এক পরিবহ তো তৈরি করেনি। দীর্ঘদিনের অরাজকতা, শারীরিক নিগ্রহ ইত্যাদির মিলিত ফল এটা।
তবু বাংলার ঘরে একটা বাচ্চা জন্মালেই, একটু জ্ঞান হতেই জেনে যায় ভালো চিকিৎসা আর সঠিক চিকিৎসা পেতে ভেলোর যেতে হয়, চেন্নাই অ্যাপোল যেতে হয়। এই মানসিকতা কবে, কি করে তৈরি হল জানি না। অন্তত আমি ছোটোবেলায় তো এত শুনিনি। খুব অসুস্থ হলে মা-বাবার সাথে কলকাতার মেডিকাল কলেজে গেছি। বড়মার অপারেশান sskm এ হয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথাবার্তার শেষ অংশটা শুনুন,
- "যা হোক দেখিয়ে আসুন। এখানে এ ক্যাঁচাল তো লেগেই আছে। এই হাত ধরে...."
রাজনৈতিক কথা শুরু হল। অর্থাৎ বর্তমান সরকার এই সমস্যায় ভালো বিপদে পড়েছে এতে তিনি ভীষণ খুশি জানালেন। তাই তিনি ডাক্তারদের পাশে আছেন। এটাই ভয়ংকর যুক্তি। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র, এই নীতিতে অনুগ্রহ করে পাশে দাঁড়াবেন না। যিনি স্টেথো ঝুলিয়ে আসছেন, তাঁকে যেন আত্মরক্ষার সামগ্রী নিয়ে চিকিৎসা করতে না আসতে হয় সেটা দেখুন। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কয়েকদিন আগে আমার হাতের ডিসলোকেশান হয়েছিল যখন একজন সিস্টারের দেওয়া ইঞ্জেকশানে আমার ডান হাতের বেশ কিছুটা পেশি এখনও অসাড়। আমার বন্ধু চিকিৎসক বলেছেন একটা নার্ভ ভুলভাবে ইঞ্জেকশন দেওয়াতে অসাড় হয়ে গেছে, সেন্স ফিরতে সময় লাগবে। এখন বলুন, আমি কি তাকে গিয়ে মারব? তিনি তো ইচ্ছা করে করেননি রে বাবা, মানু্ষের ভুল হয়। কিন্তু 'ইগো'তে দেখলে বাস্তব বুদ্ধি হারাতে হয়। ঘটনাটা ঘটেছিল জওহারলাল হাস্পাতালে। আমার আবার দরকার হলে আমি ওই হাস্পাতালেই যাব। উনি ইঞ্জেকশান দিতে এলে যদি চিনতে পারি ওনার কাছ থেকেই নেব। কারণ ভুলটা ভুল। অনিচ্ছাকৃত। ইগোর থেকে যদি আজকের সমস্যাটার দিকে তাকানো না যেত তবে চিকিৎসকদের কয়েকটা যুক্তিসঙ্গত দাবী মানতে এত বেগ পেতে হয় না।
আমি এখনও চাই কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় না ফেরে, কিন্তু তাদের চিকিৎসা করার পরিবেশটাও যেন সুস্থ থাকে। ওরা কেউ ধর্না দেওয়ার জন্য, মানুষ মারার জন্য এত কষ্ট করে এতগুলো বছর পড়েননি।
ইগো সরিয়ে ভাবা যাক। "আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল" রামকৃষ্ণদেব বলতেন। শান্তি ফিরুক। আর আমরা যেন রাজনীতির পক্ষাপাত জনিত সমর্থন আর চিকিৎসকদের প্রতি সহানুভূতি জনিত সমর্থন আলাদা করতে পারি।