মেয়েটা ভরা সংসারে এসে পড়ল
না চাইল নিজেকে, না চাইল সংসারকে
তবু অনেক চাওয়ার ভাঁড়ার ঘরের দ্বারী সে
ব্যানার্জী বাড়ির বড়বউ।
দিন যত গেল, পা তত দাবল
অভ্যাস যত পোক্ত হতে লাগল
মন হল তার চেয়ে দ্বিগুণ অবাধ্য
সে বুঝল - সে বাধ্য হলেও, পোষ্য নয়
তবু সে ব্যানার্জী বাড়ির বউ।
স্বামী চাইল শরীর, শাশুড়ি চাইল রান্নাঘর
শ্বশুর চাইল তার ছবিতে রোজ নতুন ফুলের মালা
দেওর চাইল ঠাট্টা, ননদ চাইল সাজের বাক্স
টিয়া চাইল লঙ্কা, দেবতা চাইল দুবেলা প্রদীপ ধুপ আর নকুলদানা।
সে দিল। রোজ দিল। দিতে দিতে হাতে পড়ল কড়া, কপালে পড়ল ভাঁজ
যদিও সে পুরোদস্তুর গিন্নী, তবু কিসে যেন ফাঁক-
হল না যেন পুরোপুরি ব্যানার্জী বাড়ির বড়বউ।
কোল ভরে এলো দুই ছেলে
মান বাড়ল। খোরাক বাড়ল কিছু।
তবু কি যেন তার আটকে থাকে গলার কাছে।
জানে সে। একটা মাত্র খাতা। তার কবিতার খাতা।
সেই ছোট্ট বেলার শখ। পরে হল সাধনা।
শব্দের সুরে আত্মতৃপ্তি। এই কারণেই তো দিন যাপনা!
আঁৎকে উঠল বর! দুশ্চরিত্রা!
শোয়ার বিছানায় ওকি খাতা রাখা!
ছি ছি। বল না কাউকে। লুকিয়ে রাখো।
তবু লিখবে? বেশ লিখো
লুকিয়ে লেখো, যেমন লুকাও মাসিকের নোংরা ন্যাকড়া।
তাই হল। তবু লিখল।
একটু যেন ফিকে হল সে পরিচয়, ব্যানার্জী বাড়ির বড়বউ।
মনের ভিতর খুলল আগল। নিজেকে চিনল কবিতায়।
বাইরের বিশ্ব কড়া নাড়ল দরজায়। সাড়া দিও না! হুঙ্কার দিল স্বামী।
সাড়া দিল না। জানলাখানা করল, রত্তি মাত্র ফাঁক।
তাতেই এল শীতল হাওয়া। প্রাণ জুড়ালো। কিছু কবিতা ছাপা হল।
লোকে বলল, বাহ। ছেলেরা ভেংচী দিল।
স্বামী বলল, মেয়ে মানুষের মনের কথা স্বামী জানবে।
পাড়া রাষ্ট্র হল, তুমি তো হলে বেশ্যা!
সে কাঁদল। বালিশ জানল। স্নানের জল জানল।
নষ্টা হল ব্যানার্জী বাড়ির বড়বউ।
ছেলেরা এখন বড়। সে ঠাকুমা এখন।
নাতি নাতনিরা এড়িয়ে চলে।
কি করেছে সে সংসারে! শুধু বাচ্চা বিইয়ে, কাব্য লিখেছে!
হারামজাদী, গতরখাগি, বেবুশ্যে মাগী - এরকম বহু শিরোপা পেয়েছে তো!
তবু বুকের রক্তে ভিজে, ওই যে বালিশের নীচে, কবিতার খাতা।
এরপরের ঘটনা কিছু নেই। মনে বড্ড জ্বালা।
কবিতাগুলো তার বুক থেকে জন্মে, হল বড্ড হেলাফেলা।
না হল সে ব্যানার্জী বাড়ির সার্থক বড়বউ
তবু কবি তো সে!
কেউ চিনবে না! কেউ জানল না, বুঝল না সে কথা!
ভগবান, তার একমাত্র চোখের বিষ!
কি দিল সে? তারই করুণার দিকে তাকিয়ে ছিল শুধু!
সব কেড়েছে। ভুল পথে ভুলিয়ে ছলেছে তাকে!
সে দেয় না ধুপ, না দীপ, না নকুলদানা।
বর বলে, বেশ্যার কি আর ধর্মেতে হয় মন।
আত্মীয়েরা বলে, অলক্ষী!
এমন স্বামীতেও যে না হয় সতী সাবিত্রী!
এখন সে না চায় বাঁচতে, না পারে মরতে।
যদিও শরীরে ধরেছে একাধিক মারণ ব্যাধি।
কবিতাগুলো রোজ স্বপ্নে আসে। বলে আরো কিছু আছে তো গো, না লেখা। অনেক আছে বাকি!
সে ধড়মড়িয়ে ওঠে। গভীর রাত। রাস্তাতে স্ট্রীটের আলো।
নিঝুম কলকাতা। কেউ চেনেনা তাকে।
চেয়েছিল আর কিচ্ছু না, একটুখানি স্বীকৃতি।
কাশতে কাশতে গলায় রক্ত আসে ।
কবিতার খাতা বুকে জড়িয়ে বসে,
গভীর অন্ধকারে, সে কবি-
আর কেউ জানুক না জানুক, সে জানে।
চোখের জল গড়িয়ে পড়ে শীর্ণদুটো গালে।
ফুঁপিয়ে কাঁদে কবি,
ব্যানার্জী বাড়ির বড়বউ - এক বেবুশ্যে মাগী।
(ছবিঃ সুমন দাস)