Skip to main content

গভীর জঙ্গল। ভাঙা মন্দির। ক্লান্ত মানুষ। আদতে প্রেমিক। আদতে সে পালাতে চায়। আদতে সে হারাতে চায়। আদতে সে....

ভাঙা মন্দিরে পড়ল ঘুমিয়ে। তখন রাত। আকাশে তারা। ধরিত্রীতে অন্ধকার। দূরে কাছে, ইতিউতি পশুপাখির ডাক। ভয়।

ভোর হল। মন্ত্রোচ্চারণ শুনে ঘুম ভাঙল। একমুখ দাড়ি, কয়েকদিন না খাওয়া ক্লান্ত অবসন্ন শরীর। কোনো রকমে চোখ তুলে তাকাতেই হাতে এলো চারটে বাতাসা।

বেঁটে মানুষ একজন। হাঁটুর কাছ অবধি মাথা। শিবলিঙ্গ যার কোমর ছাড়ায়। খালি গা। কোমরে ধুতি। ছেঁড়া। উদাসীন। একটা বই খুলে কি পড়ে, ঢুলে ঢুলে।

বাতাসা চারটে চিবিয়ে লালার স্রোতে ভেসে গেল মুখ। দেহে বল এলো। উঠে বলল, আমি হারিয়ে গেছি। আমি হারিয়ে যেতে চাই।

বেঁটে মানুষ হাতের ইশারায় বলল, চুপ্।

পাখি ডাকে। সাপ এসে মন্দির বেড় দিয়ে চলে গেল। হাতির দল মড়মড়, চড়চড় করে ডাল ভেঙে গেল চলে। হরিণ এলো। ময়ূর পাখা মেলে গেলো। বামন মানুষটা খেয়ালই করল না।

খানিক বাদে, বই বন্ধ করে, গড় হয়ে প্রণাম করে বলল, আমি বিষের খবর জানি। এই কুড়ি পা এগোলেই দীঘি। দীঘির ধারে ফলে আছে বিষাক্ত ফল। মরবে?

দাড়িওয়ালা যুবক উঠে বলল, আমার প্রেম বিশ্বাসঘাতক। সে বিয়ে করল অন্য একজনকে। তার অনেক টাকা। অনেক সময়। অনেক মান। অনেক সুখ। হয় তো বা অনেক রূপ। আমার দিকে তাকাও। আমি এমন কুশ্রী নই। ও বানিয়েছে আমায়। আমি দরিদ্র। আমি মূর্তি গড়ি। আমি আর কিছু পারি না যে!

বামন মানুষটা দাঁড়িয়ে বলল, মরে যাও, এসো, আমি কাল এসে দাহ করে যাব তোমায়। তুমি চলো।

বামন মানুষ আগে আগে চলল। দাড়িওয়ালা যুবক চলল পেছনে পেছনে। ছায়া চলল জঙ্গলের ঝোপঝাড় বুলিয়ে। পাখি ডেকে বলল, যা যা।

বিরাট দীঘি। সবুজ জল। জলে ঢেউ। পাড়ে মাতাল বাতাসে মাতাল নারকেল বন। হঠাৎ ঝোপে ঢুকে গেল বামন। দুটো নীল ফল হাতে এলো বাইরে। বলল, নাও। খাওয়ার পর জল খেতে পারবে না চার ঘন্টা। বিষের কার্যক্ষমতা যাবে হারিয়ে। আমি আসি। তুমি সারাটা দিন ভাবো। সন্ধ্যে নাগাদ খেও। সূর্যাস্তে তীব্র কাজ হয় বিষের। আমি কাল আসব তোমায় দাহ করার সরঞ্জাম নিয়ে। আসি।

হঠাৎ করেই চলে গেল বামন। দাড়িওয়ালা মানুষটা একা। জল ছলছল। বাতাসে গাছের পাতার মর্মর। পাখির ডাক। নীল ফল হাতে। সে শুয়ে পড়ল আকাশে তাকিয়ে। মনে পড়ছে কত কথা। কত সুখ। কত প্রতিশ্রুতি। কত গভীর ঘনিষ্ঠতা। সব মিথ্যা। সব ছল।

 

======= ========

 

বামন এলো সকালে। কোথাও পেলো না তাকে। এদিক ওদিক কত খুঁজল। নেই নেই নেই। কে জানে কোথায় মরে পড়ে আছে। নইলে সাহসে জমে ওঠেনি মন। দুর্বল।

এরপর যখনই জঙ্গলের রাস্তায় পচা গন্ধ পায়। দাঁড়ায়। খোঁজ করে। সে যুবক নয়। অন্য কোনো প্রাণী। শিকার হয়েছে। জঙ্গলেও কি ছলনার অভাব!

 

======= =======

 

বছর গড়িয়ে বছর গেলো। বামন এসেছে হাটে। সস্ত্রীক। সঙ্গে বামন ছেলে, মেয়ে। ভীষণ ভিড়। বামনের বামন বউ কিনছে ঘরোয়া সরঞ্জাম। ছেলেমেয়ে চড়ছে নাগরদোলা। সে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক একা। জ্যোতিষী বসেছে বটগাছের তলায়। ভিড় জমেছে অনেক। বামন গেলো। কপালের আড়াল কে না জানতে চায়!

কাছে গিয়েই চমকে উঠল। চমকালো জ্যোতিষীও বটে। দু'জনেই দু'জনকে চিনতে পারল। জ্যোতিষী ক'টা হাত দেখে বলল, চলো হাটের বাইরে গিয়ে বসি। হাট মানে তো মেলা।

ফাঁকা মাঠ। দু'জনে বসে পাশাপাশি। গল্প শুরু হল। যেন অনেক দিনের বন্ধ কাঁথা কেউ রোদে এনে মেলল। এমন সুখ। এমন চেনা।

 

======= =======

 

তুমি তো গেলে বিষফল দিয়ে হাতে। আমি ভাবতে ভাবতে ফেলে আসা সুখের কথা, গেলাম ঘুমিয়ে। চোখ মেললাম যখন আকাশে আধখানা চাঁদ আলোয়, বাকি আধখানা কালোয় আছে ডুবে। হঠাৎ মাথার কাছে কিসের আওয়াজ?

দেখি নীল শাড়ী পরে এক নারী! আমি বললাম, কে তুমি?

সে বলল, ভাগ্য।

আমি বললাম, আমি এখনই মরব। তুমি তাই কি এসেছ?

সে হাতে আনা ছকের কাগজ দেখিয়ে বলল, মরবে না। তুমি খাবে বিষ। পড়বে অচৈতন্য হয়ে। নামবে বৃষ্টি অঝোরে শেষ রাতে। জল ঢুকবে গলা বেয়ে উদরে। বিষ হবে নিস্তেজ।

আমি অবাক হয়ে বললাম, তবে তুমি এখানে কেন এসেছো?

আমায় দিল সে এই হাতগোনার ছক। বলল, যাও মানুষের দরবারে দরবারে। তাদের ভ্রান্ত করো সুখের মিথ্যা আশ্বাসে, তবু দুঃখের কথাও কিছু বোলো যাতে সব শোনে তারা সরল বিশ্বাসে।

আমি বললাম, আমিই কেন?

সে নারী বলল, আমায় ঢাকো। আমায় আড়াল করো মিথ্যায়। আমি নিশ্চিন্তে জালের পর জাল বুনি, জাল ছাড়াই। মানুষ মরে চিন্তায় চিন্তায়।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোনো পথ নেই খোলা?

সে নারী মিলিয়ে গেল সহসা। আমি দেখি আমার হাতে উজ্জ্বল এই ছক, সে পাতায় তোমার জীবনী খোলা।

জিভ শুকিয়ে গেল বামনের। সে বলল, কি আছে লেখা?

জ্যোতিষী বলল, বলব একটা সত্যি, একটা মিথ্যা। তুমি বন্ধু। তাই, বলব অন্তত একটা সত্যি বটেই।

বামন বলল, বলো।

জ্যোতিষী বলল, তোমার স্ত্রী চলে যাবে পরপুরুষের সঙ্গে তোমায় ছেড়ে… একটি সন্তান নয় তোমার।

এর মধ্যে কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা? উদ্বিগ্ন বামন বলল।

একটু হেসে জ্যোতিষী বলল, একটা সত্যি, একটা মিথ্যা।

জ্যোতিষী চলে গেল।

বামন বাকি জীবনটা কাটালো এই দ্বন্দ্বে, কোনটা সত্যি হলে সে হবে সুখী, কোনটা হলে মিথ্যা।

 

জানেনি কোনোদিন।