সৌরভ ভট্টাচার্য
25 February 2019
রোজ চারটে করে ঘুঁটে দিত বুড়িটা। তার উপর লিখে রাখত 'সুখ'। তারপর সেগুলো উনুনে দিয়ে উল আর কাঁটা নিয়ে বসত। অবশ্য সোমবার করেই বসত। রোজ দিনে তিনবার দু'ঘন্টা করে বুনত। তারপর শনিবার দুপুর আড়াইটে বাজলেই খুলে ফেলত। খুলতে ঠিক তেত্রিশ মিনিট লাগত। একবার খালি পর পর বারোটা হাঁচি হওয়ায় আটত্রিশ মিনিট লেগে গিয়েছিল। রবিবার উল আর কাঁটা ঠাকুরের আসনে রেখে পুজো দিত। সোমবার আবার শুরু হত বোনা।
একদিন এক বুড়ো এলো। তার পায়ে সাতটা করে আঙুল, আর হাতে চারটে করে আঙুল। রাত্রি হলেই তার দাড়ি থেকে রামধনুর মত সাতটা রঙ ছড়ায়। বুড়ো এসে আশ্রয় নিল বুড়ির বাড়ি। কারণ তখন শহরে বন্যা হচ্ছিল। বুড়ো বলল এই শহরেই তার জন্ম। এই শহরটা নাকি দু'বার বন্যায় গ্রাম হয়ে গিয়েছিল। এবারও হবে।
বুড়িটা কিছু বলল না। রাতে তাকে জোলাপ মাখানো শশা খেতে দিত, আর দিনে ভুট্টাভাজা আর হরিতকীর চাটনি। বুড়ো তাই মন দিয়ে খেত।
একদিন বুড়ো বলল, সেও ঘুঁটে দেবে। বুড়ি তার গরুটাকেও জোলাপ খাওয়ালো বিচালির সাথে মিশিয়ে। গরুটা দ্বিগুণ গোবর দিল। বুড়োকে এনে দিল ঘুঁটে বানানোর জন্য। বুড়ো ঘুঁটে বানিয়ে লিখল, 'প্রেম'। বুড়ি আড়চোখে দেখল। কিছু বলল না। সে 'সুখ' লেখা ঘুঁটেগুলো নিয়ে আগুনে দিল। বুড়োও তার পিছনে পিছনে এসে তার 'প্রেম' লেখা ঘুঁটেগুলো আগুনে দিল। আগুন গেল নিভে। আগুন অসুস্থ ছিল। এত ঘুঁটে পোড়াবার ক্ষমতা তার কই?
বুড়ি রাগ করল। বুড়োর দিকে রক্তচোখে তাকিয়ে উল বুনতে লাগল। যতই বোনে ততই যায় জট পাকিয়ে। বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি। প্রায় ঘরে জল ঢুকে যায় এমন জল রাস্তায়। বুড়ো ঘুমাচ্ছে বারান্দায় মাদুর পেতে। বুড়ি উল-কাঁটা চেয়ারে রেখে উঠে গেল। দোতলার জানলায় এসে দাঁড়ালো। সত্যিই কি গ্রাম হয়ে যাবে সব? সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল তার সামনে বড় বড় বাড়িগুলো ধুয়ে ধুয়ে যেন কুঁড়েঘর হতে শুরু করেছে। রাস্তাগুলো ধুয়ে মাঠ হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পাঁচিলগুলো পাখি হয়ে উড়ে উড়ে গেল। গাড়িগুলো সব বাঘ, হাতি, মোষ, গরু, খরগোশ ইত্যাদি হয়ে জঙ্গলের দিকে চলে যেতে লাগল। যে বস্তিটা সব চাইতে নোংরা ছিল, সেইখানে ফুলের বাগান হল। আকাশটা আসতে আসতে ঘন নীল হয়ে যেতে লাগল। গাছগুলো সাঁইসাঁই করে বড় হয়ে গেল। বুড়ির দোতলাটা হুট্ করে একতলা হয়ে গেল।
বুড়ি ঘরে এসে দেখল, চাটাইয়ের উপরে বুড়োটা শুয়ে, তার দু'দিকে দু'জন করে বড় বড় ছেলে ঘুমাচ্ছে। তার চার ছেলে। যুদ্ধে গিয়েছিল, আর ফেরেনি। বুড়ি গোয়ালে গেল। গরুর দুধ দুইল। প্রচুর দুধ, আর শরতের মেঘের মত সাদা। বুড়ি পায়েস বানালো। উল আর কাঁটা নিয়ে চেয়ারে বসল। আজ পুরোটা বুনবে। বোতাম লাগাবে। চেন লাগাবে। বুড়ি বুনতে বুনতে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন চার ছেলে আর বুড়োটা উঠবে, দাওয়ায় বসে পায়েস খাবে, আর বলবে, মাগো এমন পায়েস কদ্দিন খাইনি!
বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে।