Skip to main content
কিছু মানুষকে আমার চেতনার আশেপাশে খুব অল্প সময়ের জন্য পেয়েছি। কারণ, সময়টা অল্প ছিল বলে না। মনটা পরিণত ছিল না। শিশু যেমন হাতটা মুঠো করে জন্মায়। ঠিক তেমনই আমাদের চেতনাও হাত মুঠো করেই আসে। পরে ধীরে ধীরে সে হাত পুরোপুরিভাবে খোলে, ধীরে ধীরে স্পর্শ করতে শেখে, ধারণ করতে শেখে। চেতনাও তাই।

আজ সেরকম একজন মানুষের মুখ চেতনার গবাক্ষে উঁকি দিয়ে গেল। বীরেন কাকু, আমার বন্ধুAditya আর ভাতৃ প্রতিম Achintya-র বাবা। বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম। কষ্ট করে পড়াশোনা। রেলে চাকরী। এ কথাগুলো পরিচিত। সেটা বলার জন্য এ লেখা নয়। ওনার একটা ক্ষমতা ছিল, বয়সের আঁচ কমাতে পারতেন ইচ্ছা করলেই। ফলে গল্প জমে যেত বয়সের হিসাব ভুলেই। নানান সময়ে নানান গল্প ওনার মুখে শুনেছি। কোনো বিখ্যাত সাহিত্যিকের না। যে আদি ঔপন্যাসিক জীবনগুলোর নানা অধ্যায় যুগ যুগ ধরে লিখে যাচ্ছেন, সেই ঔপন্যাসিকের কথা। তাঁর বলা দুটো গল্প।


গল্প - ১) আমাদের গ্রামে একটা ছেলে ছিল। গরু চরাত। আমার কি ইচ্ছা হল ভাবলাম গ্রামে যে সময়টা যাই, ওকে একটু পড়াশোনা শেখাই। তো তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করানো হল। কথা হল, দুপুরবেলা সে গরু চরানোয় খানিক বিরতি টেনে স্টেশানে আসবে। আমিও যাব। স্টেশানে বেঞ্চে বসে আমরা পড়ব।

আমি খুব গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি স্টেশানে নির্দিষ্ট দিনে। সে আসল। তাকে আমি নতুন খাতায় বর্ণ পরিচয় করাতে শুরু করালাম। সে মন দিয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখল। পুরো ব্যাপারটা অনুধাবন করল বলেই অন্তত সেদিন মনে হয়েছিল। ভুল ভাঙল কয়েক সপ্তাহ পর।
বেশ কয়েকটা শনি রবি পার হল। তার দেখা পাই না। দেখা পেলেও নাগাল পাই না। অবশেষে তাকে পাকড়াও করলুম। খাতা খুলে বললাম, 'ক খ' লিখে দেখাও দেখি। সে অনড়। আমি বললুম, বেশ। এই বলে, খাতায় একটা বড় '' লিখলাম। বললাম, বলতো এটা কি? সে চুপ। আমি বললাম, ''। সে বলল, আমি মানি না। বলে সে খাতাটা টেনে নিয়ে একটা বক্ররেখা টানল। বলল, বল তো এটা কি? আমি বললাম, জানি না। সে বলল, গরুর পেচ্ছাপ! বলে সে হাঁটা দিল।
আমি স্টেশানের বেঞ্চে খোলা খাতা সামনে বসে রইলাম। একদিকে '' আরেকদিকে গরুর পেচ্ছাপের অলঙ্করণ। কত মেল, এক্সপ্রেস, প্যাসেঞ্জার ট্রেন আমার অলক্ষ্যে পার হয়ে গেল টেরই পেলুম না। তার শিক্ষাচেষ্টা চিরকালের মত শেষ হল।
এখন তার অনেক বয়েস। বাড়ি ভরতি নাতি-নাতনি। আমার সাথে দেখা হল গতবার পূজোয়। বললে, বীরেন তোর মনে আছে, সেই আমায় লেখাপড়া শেখানোর কথা? সেদিন যদি ওরকম গোঁয়ার্তুমি না করতুম জীবনটা অন্যরকম হয়ে যেত রে! সারাটা জীবন গরু চরিয়েই কেটে গেল। তার ভেজা চোখ। এবার আমারও মন খারাপ হওয়ার পালা। বললুম, যাক গে যা হওয়ার হয়ে গেছে।


গল্প - ২) আমার বাবা ছিলেন খুব মজার মানুষ। একবার ধানবাদ থেকে একটা বড় টর্চ কিনে আনালেন। তিন'ব্যাটারীর। আমি ছিলাম ওনার ল্যাঙবোট। যেখানে যেতেন আমায় সাথে করে নিয়ে যেতেন।

রাত্তিরে প্রায়ই আমায় নিয়ে কীর্ত্তন, কি রামগান, কি কারোর বাড়ি যেতেন। মজা হচ্ছে উনি সারাটা রাস্তা কিছুতেই টর্চ জ্বালতেন না। গ্রামের রাস্তা - এবড়োখেবড়ো, উঁচু-নীচু। তাও টর্চ জ্বালবেন না। যেই না কিছুতে হোঁচট খেলেন, কি খোঁচা খেলেন, অমনি বলতেন, দাঁড়া তো দেখি কি ছিল? বলেই টর্চ জ্বেলে পর্যবেক্ষণে লেগে পড়তেন। ও আচ্ছা, ইঁট ছিল, ও আচ্ছা কাঁটাঝোঁপ ছিল....
আবার পথ চলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতে বন্ধ টর্চ। আবার হোঁচট, খোঁচা... আবার টর্চ জ্বলে ওঠা।


আজ কাকু নেই। কিন্তু এই গল্পটা খুব মনে পড়ে। সেদিন হাসিয়েছিল। আজ ভাবায়। সত্যিই তো আমরাও তো টর্চটা বন্ধ করেই হাঁটি। মুখ থুবড়ে পড়েই পড়ার কারণ খুঁজি। পড়ার আগে গর্তের দিকে ধ্যান দেওয়ার সময় কই, তখন ছোটার গতিই সার।