নধরকান্তি বাবু ব্লাড সুগার নিজের ছন্দে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। চায়ে চিনি খান না। কারোর বাড়ি গেলে কেউ যদি ভুল করে বা না জিজ্ঞাসা করে চিনি দিয়ে ফেলে চায়ে, মুখেও দেন না সে চা, কিন্তু চায়ের পর দুটো রসগোল্লা ওনার চাই-ই চাই।
নধরকান্তিবাবু খেলা পাগল মানুষ। নিজে
খেলেন না, কিন্তু লুডো ছাড়া সব খেলাই দেখেন, খোঁজ রাখেন। সেই নিয়েই সমস্যা। দুটো চিন্তায়
ওনার সুগার বাড়ব বাড়ব করছে। এমনিতে উনি ফাস্টিং আড়াইশোর উপর উঠতে দেন না, এটা ওনার
একটা পারিবারিক প্রন্সিপিল। আসলে উনি ওনার শাশুড়ির হাতে মানুষ। শাশুড়ির ফাস্টিং সুগার
কোনোদিন তিনশোর নীচে নামত না, তাই উনি বেশি নীচে না নেমে শাশুড়ি মায়ের কাছাকাছিই নিজেকে
রাখেন। কিন্তু এবার ফাস্টিং সুগার এসেছে পাঁচশো তিরিশ।
সে যা হোক, চিন্তার কারণ দুটো বলি।
এক, কোহলিকে নিয়ে ক্রিকেট বোর্ডে যা হচ্ছে, আর দুই হল, ডোকোভিচের এই বেয়াড়াপনা। দুজনেই
ওনার ভীষণ প্রিয় খেলোয়াড়। নধরকান্তি নাস্তিক মানুষ। ঘরে শুধু খেলোয়াড়দের ছবি। এমনকি
ওনার গিন্নীও ছিলেন পাড়া চ্যাম্পিয়ান কবাডিতে। দুই ছেলেও ভালো খেলে, একজন ক্রিকেট,
একজন ভলিবল।
কিন্তু আর তো নেওয়া যাচ্ছে না। রাতে
ঘুম হচ্ছে না। বিরাটের মুখটা মনে পড়লেই কান্না পাচ্ছে। কান্না পেলেই অ্যাসিড হচ্ছে।
রোজ সকাল বিকাল প্যানডি খেতে হচ্ছে। ঘুম হচ্ছে না। আর ডোকোভিচের ব্যাপারটা নিতেই পারছেন
না। নিজে নাস্তিক, তাই আস্তিক স্ত্রীকে দিয়ে কালীবাড়ি মানত করিয়েছেন, এ দুটো ঝামেলার
সুরাহা করে দিলে তিনি পাড়াশুদ্ধ সবাইকে বিরিয়ানি ভোগ খাওয়াবেন। কিন্তু হবে কি?
সমস্যার সমাধান কি আর বললেই হয়। কতবার
মনে হয়েছে এই ডোকো যদি পাড়ার ন্যাপলা, কার্তিকের মত হত, তবে তিনি নিজে গিয়ে মিউনিসিপালিটিতে
নাম লিখিয়ে আসতেন ভ্যাক্সিনের জন্য। তারপর মাস্ক পরিয়ে, টোটোয় করে ভ্যাক্সিন দিতে নিয়ে
যেতেন।
মায় একদিন স্বপ্নও দেখে ফেললেন নধরকান্তিবাবু।
হাবুলের টোটো করে ডোকোকে নিয়ে যাচ্ছেন হালিশহর মিউনিসিপালিটিতে ভ্যাক্সিন দেওয়াতে,
কিন্তু ডোকো খালি বায়না করছে দুটো রসগোল্লা আর কচুরি গৌরনিতাই মিষ্টান্নভাণ্ডার থেকে
না খাওয়ালে সে কিছুতেই যাবে না।
নধর পড়েছেন বিপদে। কি করেন। এদিকে
গৌরনিতাই মিষ্টান্নভাণ্ডারে যা ভিড়, ওখানে মাস্ক খুলে খাওয়া? খেলেই তো প্রতি কচুরি
দশটা করে করোনা ঢুকবে। তবে? কিন্তু ডোকোও হাত পা ছুঁড়ে বায়না করছে। বলছে না খাওয়ালে
ভ্যাক্সিন তো নেবেই না, উপরন্তু অস্ট্রেলিয়ায় খেলতেও যাবে না। এদিকে টিকিট কাটা প্লেনে।
কাল সাড়ে এগারোটার বজবজ লোকালে হালিশহর থেকে ডোকোকে তুলে দিয়ে অফিসে যাবেন, সে কথাও
হয়ে আছে, ডোকো নিজেই দমদম নেমে যাবেখন। এবার কি হবে?
নামলেন নধরকান্তিবাবু আর ডোকোভিচ গৌরনিতাইয়ের
সামনে। কোনো রকমে মারাদোনা, পেলে, বরিস বেকার এদের নাম করে একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজতে
খুঁজতে পেলেন অবশেষে। দিলেন অর্ডার, দু প্লেট কচুরি আর চারটে করে মিষ্টি। দুটো করে
রসগোল্লা আর দুটো করে পান্তুয়া। বাইরে গিয়ে চিনি ছাড়া চা খেয়ে নেবেন ঠিক করলেন মনে
মনে।
কি আশ্চর্য। অর্ডারের জন্য বসে আছেন,
হঠাৎ দেখেন হাবুল, মানে টোটোয়ালা এসে বলল, স্যার, বিরাট এসেছে, বলছে ওকে একটু রামপ্রসাদের
ভিটেটা ঘুরিয়ে আনতে, কোনো টোটো ফাঁকা পাচ্ছে না।
নধরকান্তি ডোকোকে বসিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে
এলেন। সত্যিই বিরাট কোহলি দাঁড়িয়ে। চোখ দুটো লাল। অভিমানে চোয়াল দুটো শক্ত। নধরকান্তির
গলার কাছটা টাটিয়ে উঠল। বলল, তা আপনি যদি ঘুরবেনই তো আমাদের সঙ্গে চলুন না, আমিও ওদিকেই
যাব। ভিতরে ডোকো আছে, ও টুক করে একটা ভ্যাক্সিন নিয়ে নেবে, তারপর আমরা ঘুরব। আপনাকে
নিগমানন্দের আশ্রম, গঙ্গার ঘাট সব ঘুরিয়ে আনব। আসুন দুটো কচুরি খেয়ে যান, মুখটা তো
শুকিয়ে গেছে।
এই বলে বিরাটকে কিছু বলার সুযোগ না
দিয়ে হাতটা ধরে টেনে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেলেন। তারপর এটা ওটা গল্প করে বিরাটের মনটা
ভোলাতে চেষ্টা করলেন। এরপর খাওয়া দাওয়া সেরে তিনজনে মিলে রওনা দিলেন মিউনিসিপালিটির
দিকে হাবুলের টোটোতে।
ভ্যাক্সিন নেওয়া হল। ডোকো একটু কেঁদেছিল।
তাড়াতাড়ি দুটো ক্যাডবেরি কিনে একটা ডোকোর হাতে, একটা বিরাটের হাতে দিলেন। ডোকো চুপ
করল। বিরাট, পরে খাব, বলে পিঠের ব্যাগে ভরে নিল।
আবার যাত্রা শুরু হল। রামপ্রসাদের ভিটে দেখিয়ে টোটো যেই না
শ্মশানে পাশ দিয়ে রাসমণির ঘাটের দিকে এগিয়েছে, হঠাৎ নধরকান্তি দেখেন তার শাশুড়ি মা
দাঁড়িয়ে। হাত দিয়ে টোটো দাঁড় করালেন।
নধর তাড়াতাড়ি নেমে নীচু হয়ে পা ছুঁয়ে
প্রণাম করে বললেন, মা আপনি?
শাশুড়ি মা বললেন, তোমার সময় হয়ে গেছে
বাছা, এসো আমার সঙ্গে, আর দেরি কোরো না।
নধর হাতজোড় করে, চোখের ইঙ্গিতে গাড়িতে
বসা ডোকো আর বিরাটকে দেখিয়ে বলল, কিন্তু মা, এরা?
শাশুড়ি বললেন, ওরে পাগলা এ জগতে মানুষ
যে যার ঘর আপনি রচনা করে... তুই কে এদের ভাগ্যলিপি বদলাবি? যা, ওদের ছেড়ে দে, আমার
সঙ্গে আয়….
কিছু বলার অবকাশ পেলেন না আর নধরকান্তি।
হাতটা শাশুড়ি ধরে টানছে। ওদিকে টোটোটা মিলিয়ে যাচ্ছে সকালের ভাতের ফ্যানের মত কুয়াশার
মধ্যে। ডোকো আর বিরাট মিলিয়ে গেল। হাতটা ধরে শাশুড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানের দিকে।
ভয়ে, বিষাদে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল নধরকান্তির।
হাতটা ধরে বিমলা, মানে গিন্নী টানছে আর বলছে, ওগো ওটো ওটো.. আবার তুমি এপাশ ওপাশ করচো...
আবার বিচানা ভেজাবে.. কি মেঘলা দেকেচ না বাইরেটা... এর মধ্যে শুকাবে ভেবেচ.. যাও যাও….
বাদরুমে যাও….