কড়িবরগার দিকে তাকিয়ে হাঁ করে শুয়েছিল বিকট।সকাল থেকে বাইরে বেরোয়নি আজ। মনটা ভাল নেই। কেন ভাল নেই অবিশ্যি সে নিজেও জানে না। শুধু এটুকু জানে তার আজ মন ভাল নেই। রোজ সকালে এই সময়টায় সে জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ এনে, চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে, একটু চা করে খায়। চা খেতে খেতে জঙ্গলের শোভা দেখে। সূর্যের আলো, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে তার এই জরাজীর্ণ বাড়ির উঠোনে কেমন আলপনা আঁকে, সেগুলো আবার কেমন সরে সরে যায়, পাল্টে পাল্টে যায়। তার খুব মজা লাগে। তারপর একটু বেলা হলে এক'পো মতন দুধ খেয়ে, গ্রামের দিকে ঘুরতে যায়, কি জঙ্গলের শেষে যে পাহাড়টা আছে, সে পাহাড়টার চূড়োয় একটা শিবমন্দির আছে, সেখানে গিয়ে বসে থাকে। এই মন্দিরটাতেও আজকাল তেমন কেউ আসে না। শুধু বড়গাছা পণ্ডিত সকালে একবার এসে একটু খানিক বাতাসা ধূপ দিয়ে 'নমো নমো' করে পূজো দিয়ে যায়। সেই পণ্ডিত মশায় এলে অবিশ্যি সে যায় না, কারণ পণ্ডিত তাকে খুব একটা সুনজরে দেখে না। দেখা হলেই বিরক্ত হয়ে জ্ঞান দিতে শুরু করে, 'নিজের দোষে তুই এই জীবন বাছলি বিকট... তোর বাবা মা আজ বেঁচে থাকলে এমনধারা ঘটতে দিত?...' এরকম আরো কত কি বলে চলে। স্নেহও করেন অবিশ্যি, এটা সেটা তো তিনিই জোগাড় করে দেন।
বিকটের গড়ন বেশ মজবুত। ইয়াব্বড় বড় পেশি। লম্বায় প্রায় আট ফুটের কাছাকাছি তো হবেই। বর্ষাকালে যখন মাটি কাদা কাদা থাকে তখন বিকট হেঁটে গেলে মনে হয় যেন একটা হাতি হেঁটে গেছে।
বিকট বিছানা থেকে নামল। বাইরের বারান্দায় রাখা একটা ভাঙা মাটির পাত্রে জল রাখা থাকে, সেই জল মুখে চোখে ছেটাল। এটা ওটা খানিক ভাবল দাওয়ায় বসে। তারপর হুড়মুড় করে সামনের দীঘিতে নেমে পড়ল। সাঁতার কাটতে কাটতে মনটা একটু ফুরফুরে হচ্ছে, এমন সময় একটা হাঁক, 'ও জ্যাঠা এত সকাল সকাল নাইছো?' বিকট চিৎসাঁতার কাটছিল চোখ বন্ধ করে, চোখ মেলে সাঁতার থামিয়ে বলল, 'হাই কাণ্ড, তুই এই জঙ্গলে কি কত্তে এলি রে?'
- তা তুমি দিন চার হল গ্রামে যাও নি কেন?
- সে কথা পরে হচ্ছে। তোর আজ বিদ্যালয় নাই?
- না। গরমের ছুটি পড়ে গেল তো?
- কই, গরম তো তেমন কিছু পড়ে নাই? তোদের মাষ্টারগুলো তো আচ্ছা ফাঁকিবাজ!... আরে আরে কি করিস... নামিস না বল্টু, এ এঁদো দীঘি, জ্বর হবে, নামিস না...
কে কার কথা শোনে। বল্টু হুড়মুড় করে জলে নেমে পড়ল। বল্টুকে সাঁতার শিখিয়েছে তার বিকট জ্যাঠাই।
দু'জনে পাশাপাশি চিৎসাঁতার দিতে শুরু করল, সাথে গল্প। 'জানো জ্যাঠা, কাল বাবা মায়ের মধ্যে হেভি ঝামেলা হয়েছে।'
- কি নিয়ে?
- সে জানি না, তবে আমিও একটা কারণ তো বটেই। এবারে আমার উচ্চমাধ্যমিক না, তো বাবার ইচ্ছা আমি মাষ্টার হই, তোমার মত, মানে তুমি যেমন ছিলে আর কি, আর মায়ের ইচ্ছা ডাক্তার হই, যেহেতু মামারা সব ডাক্তার, তাই।
- অ। তা তোর কি ইচ্ছা শুনি?
- কিচ্ছু না। পড়া শেষ হলে এই বাড়িটায় চলে আসব। আমি আর তুমি থেকে যাব। কি মজা হবে বলো! সারাদিন জঙ্গলে ঘুরব ফিরব, ফলমুল খাব। শুনেছি এসব করলে ভগবান নাকি বর দিতে চলে আসেন। তা তিনি এলে কিছু চেয়ে নেব, এই যেমন ধরো একটা গাড়ি, বাড়িটা একটু মেরামত করে দিতে বলব। আর যদি আরো কিছু দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন ভগবান তো, আমার জন্য একটা জ্যাঠাইমা, আর তোমার জন্য একটা বৌমা। কি রকম প্ল্যান বলো?
বলেই বল্টু 'হো হো' করে হেসে উঠলো। ক'টা পানকৌড়ি গাছের ডালে বসে ডানা শুকাচ্ছিল। বল্টুর হাসির আওয়াজে চমকে গিয়ে উড়ে গেল। বল্টু সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল করল তার জ্যাঠা কেমন হঠাৎ করে গুম মেরে গেল।
সে জ্যাঠার দিকে ফিরে বলল, 'ফের?'
- কি ফের? বিকটের গলাটা একটু ধরা ধরা, বিষণ্ণ, গম্ভীর তো বটেই।
- বিয়ের কথা শুনলেই তুমি এমনধারা চুপ করে যাও কেন?
- কই না তো? বিকট যথাসম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল।
- না জেঠু, আজ তোমায় বলতেই হবে, তুমি খালি বলো বড় হলে... আর কতো বড় হবো? যত্তসব...
বল্টু জল ছেড়ে গজগজ করতে করতে পাড়ে গিয়ে বসল। বিকট শুনল হাওয়ায় এক ফিসফিসানি... 'বলেই দাও ওকে আজ...'
বিকট জল ছেড়ে তার পাশে এসে বসল। কাঁধে হাত রাখতে গেল, বল্টু কাঁধ ঝাঁকিয়ে আপত্তি জানাল।
বিকট ওর মুখের দিকে পরম স্নেহে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, 'হুম, গোঁফের রেখা যখন দেখা যাচ্ছে, তখন বলেই ফেলা যায়।'
বল্টু তার দিকে তাকিয়ে হাসল, তার চোখের কোণায় ছলছল করছে জল।
২
—---
'আমাদের গ্রামে একটা বড় শনিমন্দির আছে জানিস তো?'
বল্টু কপালে হাত ছুঁইয়ে বলল, 'হ্যাঁ তা আবার জানি না, অঙ্কের পরীক্ষায় মানত করেছিলাম তো মাধ্যমিকের সময়। ওই দ্যাখো সে লাড্ডু তো আজও দেওয়া হয়নি! লেটার তো ঠিকই হয়েছিল... ছি ছি। না আজই দিতে হবে... হ্যাঁ বলো... তো কি হল শনিমন্দিরে?'
- ওর পাশের বাড়ি ছিল মুখুজ্জ্যেদের। আমি যখন কলেজে পড়ি, তখন ওই বাড়ির একটা মেয়েও আমাদের সাথে কলেজে পড়ত। গ্রামে তো আমাদের তখন ছেলেমেয়েতে কথা বলা, আলাপের সুযোগ ছিল না, তা আগে পরিচয় হয়নি সেভাবে... কলেজে গিয়ে হল। আমাদের নিজেদের নিজেদেরকে খুব ভাল লাগল। মানে তোকে যারা প্রেমে পড়া বলিস আর কি!
- হুম, বল্টু গম্ভীর হয়ে মাটির থেকে শুকনো পাতা তুলে মাটিতেই বোলাচ্ছিল।
- বছর গেল। তোর বাবার কাছে শুনেছিস নিশ্চই আমি খুব ভাল ছাত্র ছিলাম। বিদ্যালয়ে চাকরি পেলাম।
- আচ্ছা তুমি বিদ্যালয় কেন বলো?
বিকট একটু হাসল, 'সেটাও ওরই জন্য, মানে জুঁই বলত, স্কুল বোলো না, বিদ্যালয় বলো, শুনলে বেশ একটা মন্দির মন্দির লাগে। তা সেই থেকেই অভ্যেস।'
- ও আচ্ছা, বলো। তা তুমি বিয়ে করলে না কেন ওনাকে?
বিকটের মুখটা একটু কালো হয়ে আসল। বলল, 'কপাল রে বল্টু। বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ঠিক চারমাস আগে ওকে সাপে কামড়ালো। সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়টুকু অবধি নাকি দেয়নি। তখন তো আমি কলকাতায় মেসে থাকি, বিদ্যালয়ে পড়াই, আর গবেষণায় ব্যস্ত থাকি। ওদিকে সব শেষ হয়ে গেল।'
- তাই তুমি এখানে?
- বাকিটা কাল বলব, আজ ভাগ, আমায় একটু বেরোতে হবে।
বল্টু কিছুটা গাঁইগুঁই করতে করতে ফিরে গেল। বিকট ওর যাওয়াটা দেখে ধীরে ধীরে পাহাড়ের শিব মন্দিরটার কাছে এসে বসল।
এর পরেরটা আর কি করে বলবে সে?
বিকট আর বিয়ে করল না। তার ভাই শকট রেলে চাকরী পেল। বিয়ে করল, বিকট নিজেই উদ্যোগ করে বিয়ে দিয়েছিল। বল্টু এলো।
ব্যস, সব পাল্টে গেল বিকটের জীবনে। বল্টুই তার ধ্যানজ্ঞান, নয়নের মণি। বল্টুও জেঠু বলতে অজ্ঞান। সব ঠিকই চলছিল, তবু কোথাও একটা কিছু কাঁটার মত বিঁধত বিকটের বুকে। ভাইবউয়ের ব্যবহারটা ঠিক ছিল না। তার মনে হত বল্টুকে সে কেড়ে নিচ্ছে তার কাছ থেকে। বল্টুকে নিয়ে রোজ রোজ অশান্তি শুরু হল। তবু সে সহ্যই করত, একদিন শকট বলল, 'তুমি এরকম করতে থাকলে কিন্তু দাদা আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। নেহাত কোয়াটার্সের যা ভাড়া তাই চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছি তোমার এ আদিখ্যেতা। তোমায় তো কেউ বিয়ে করতে মানা করেনি? কে কবে একটা সাপে কেটে মরেছিল, তুমি সারাটা জীবন বিবাগী হয়ে কাটিয়ে দিলে। এখন এই বাচ্চাটার মাথা চিবোচ্ছ আদর দিয়ে। পড়তে বসতে চায় না, ক্লাস টু হয়ে গেল! আরে তোমার মাথা ছিল তাই বেরিয়ে গেছো, এখন সে দিন নেই আর ওর সে মাথাও নেই...।'
বিকট কিছু বলেনি। চুপ করে গিয়েছিল। জুঁইয়ের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা করতে লাগল খুব তার সেদিন থেকে। আগেও হত, তবে সে গুরুত্ত্ব দিত না। আজ গুরুত্ব না দেওয়ার মত কিছু নেই তো! বিকট বিষ খেল। পুরীতে গিয়ে, যাতে বল্টু তার মরামুখ না দেখে।
শরীর ছাড়ল, কিন্তু স্নেহ ছাড়তে পারল না। বল্টুও কি করে জানি তাকে দেখতে পেত স্পষ্ট করে, এমন কি দিনের আলোতেও! ব্যস সেই থেকে সে এই জঙ্গলের পোড়োবাড়িতে।
বল্টু পরের দিন যখন এলো, তার জ্যাঠাকে কোত্থাও পেলো না। পেল একটা চিরকুট।
স্নেহের বল্টু,
আগামী কয়েক বৎসর আমাদিগের দেখা হইবেক না। কারণ যে কাহিনীটি শুরু করিয়াছি, তাহা সম্পূর্ণ করিবার সামর্থ আমার আপাতত নাই। তুমি বড় হও, সব বুঝিতে পারিবে। মানুষ তাহার কৃতকর্ম বেশিদিন লুকাইয়া রাখিতে পারে না, বিশেষ করিয়া তাহা যদি অশুভ হইয়া থাকে। শিবশম্ভুর চরণে তোমার জন্য প্রার্থনা জানাই, তুমি মানুষ হও, হৃদয়কে কদাপি মরিতে দিও না, তাহা হইলে ঈশ্বরের আসিবার পথ রুদ্ধ হইবে। বাঁচিয়াও মরিয়া থাকিবে। দুঃখ পাও ক্ষতি নাই, নিজেকে অপমানিত করিও না ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে মাথা নুয়াইয়া।
যেদিন তুমি সব বুঝিবে, সেদিনই আবার আমায় দেখিতে পাইবে।
ইতি আশীর্বাদান্তে,
জেঠু
একফোঁটা বড় চোখের জল চিঠির উপর পড়ল। কেউ যেন বাতাসে ফিসফিসিয়ে বলল, 'বাড়ি যাও বল্টু, আমি সব সময় তোমার জেঠুর কাছে থাকব, জেঠুর কথা জানাব, তোমার কথাও জেঠুকে জানাব। জেঠু আবার সঠিক সময়ে ফিরে আসবে...।'
(ছবিঃ সুমন)