১
এই চড়াইটার জন্য বুকুর অনেকবার অঙ্ক ভুল হয়েছে, ইংরেজি বানান ভুল হয়েছে, ইতিহাসের সাল গোলমাল হয়েছে। হবে না? যখন তখন ক্লাসের সময় এসে ক্লাসরুমের জানলার উপর বসবে, আর বকর বকর করেই যাবে, করেই যাবে।
এই তো লক ডাউনের আগের শুক্রবার, স্যার অঙ্ক দিয়েছেন করতে, চড়াইটা এসে বলতে শুরু করেছে, এই বুকু, শুনেছিস, একজন বিজ্ঞানী আমাদের গুনতে এসে মাত্র চারশো আঠাশ জনকে পেয়েছে। এত কম, ভাবতে পারিস! এখানে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেই নাকি পাঁচ হাজার চারশো আটানব্বইটা চড়াই ছিল। কোথায় গেল বল তো সবাই?
বুকু বলল, এখন কথা কেন বলছিস, আমার অঙ্ক ভুল হয়ে যাবে, ক্লাস থ্রি’র অঙ্ক কত কঠিন জানিস? আমি কি কেজি ওয়ান, কেজি টু’তে পড়ি?
বুকুর বসার জায়গাটা একদম ক্লাসের জানলা ঘেঁষে। চড়াইটা আরো একটু বুকুর কাছে এগিয়ে এসে খাতার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ওঃ... ভারি তো ওইসব অঙ্ক! তুই তো যোগ আর বিয়োগ করে যাচ্ছিস খাতা ভরে। একবার আমাদের আগের সংখ্যাটা থেকে এখন যত চড়াই আছি আমরা সেই সংখ্যাটা বিয়োগ দিয়ে দেখ তো কতজন চলে গেছে?
বুকু বলল, ওরে বাবা! অতবড়ো যোগ আমি করতে পারব না, তুই কাল সকালে আসিস, বাবার মোবাইল থেকে করে দেব।
চড়াইটা উড়ে গেল। দুটো যোগ আর তিনটে বিয়োগ ভুল হল। বুকুর মনটা খচখচ করতে লাগল, তাই তো! এত চড়াই কমে যাবে কেন?
বুকু ক্লাস থেকে বেরোচ্ছে, এমন সময় বিজ্ঞানের স্যার বাইকে চড়ে স্কুল থেকে বেরোচ্ছেন। বুকু তাড়াতাড়ি দৌড়ে স্যারের বাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
স্যার বাইকের স্টার্টটা বন্ধ করে বুকুর দিকে মাথাটা নীচু করে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে পারমিতা?
বুকু বলল, আচ্ছা স্যার, কেন চড়াই পাখি কমে যাচ্ছে এত?
স্যার মাথা নেড়ে বললেন, আমিও ঠিক জানি না। পরে জানাব, এখন আসলে আমরা সবাই কোরোনা ভাইরাস নিয়ে খুব ভাবনায় আছি তো। চড়াই নিয়ে ভাবতে পারছি না তাই। তোমার গাড়ি এসে গেছে?
বুকু দেখল স্কুলের গেটের কাছে বিশুদাদু গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। তার পাশে মৈত্রী, শুভ, পটকা, ভোম্বল সবাই হাত নাড়ছে। সবাই তারা একই গাড়িতে যায়। মারুতি ওমনিতে।
বুকু গাড়ির দিকে দৌড় দিল। আজ তার বিশুদাদুর পাশে বসার দিন। ড্রাইভারের পাশে কে বসবে এই নিয়ে একটা নিয়ম বানিয়ে দিয়েছে বিশুদাদু, সেই নিয়ম অনুযায়ী আজ বুকুর বসার দিন।
বুকু বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল বিশুদাদু, তারপর একবার বুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, আজ কিন্তু তোমায় একটু পর পিছনে বসতে হবে পারমিতা, আমার দাদা হাস্পাতাল থেকে উঠবে, ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল, দেখানো হয়ে গেছে, ওকে নিয়ে নিতে হবে।
বুকু বলল, কি হয়েছে তোমার দাদার, কোরোনা?
বিশুদাদু হেসে বলল, না না একটা অন্য অসুখ, প্রস্টেটের, তুমি বুঝবে না।
বুকুর মনটা একটু খারাপ হল, পিছনে বসতে হবে? সে যাক, বিশুদাদুর দাদাকে আগেও দেখেছে বুকু, অত বুড়ো মানুষ কি করেই বা বাড়ি যাবে।
গাড়ি হাস্পাতালের সামনে এসে দাঁড়ালো। বিশুদাদুর দাদা রাস্তাতেই দাঁড়িয়েছিল। রোগা মানুষ। লাল রঙের একটা জামা পরা।
গাড়ি থামতেই বুকু নেমে গিয়ে পিছনের দিকে যেতে গেল, বিশুদাদুর দাদা তার হাত ধরে বলল, তুমি আমার পাশেই বসে যাবে, হয়ে যাবে, হবে নারে বিশু?
বুকু দেখল বুড়ো মানুষটা তার হাত ধরে রয়েছে, তার রোগা হাতটা থরথর করে কাঁপছে। বুকু একবার একটা শালিক পাখির বাচ্চা ধরেছিল। তার বুকের ভেতরটা এমন ধড়ফড় ধড়ফড় করে কাঁপছিল। বুকু বিশুদাদুর দিকে তাকালো, বিশুদাদু বলল, বেশ, তোমরা দু’জনেই সামনে এসো তবে। তারপর বুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, কি পারমিতা, তোমার অসুবিধা হবে না তো?
বুকু মাথা নাড়ল। তারপর গাড়িতে উঠে একটু চাপাচাপি করে বসে পড়ল।
বিশুদাদুর দাদা বলল, আমায় তুমি বুড়োদাদু বলতে পারো, কেমন?
বুকু সামনের দিকে তাকিয়েই বলল, তোমার নাম কি?
সে বলল, রতন।
বুকু বলল, তোমায় তবে রতনদাদু বলব। বুড়োদাদু নাম হয় নাকি কারো? দাদু মানেই তো বুড়ো।
রতনদাদু হো হো করে হেসে বলল, তাও তো! তা তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
থ্রি।
আচ্ছা, বলে রতনদাদু সিটের হেলান দেওয়ার জায়গাটার সাথে মাথাটা লাগিয়ে চোখটা বন্ধ করল।
বিশুদাদু একবার আড়চোখে দাদাকে দেখে বলল, তোর কি কষ্ট হচ্ছে রে? দাঁড় করাবো গাড়িটা?
রতনদাদু চোখটা বন্ধ করেই বলল, না না, চল। একটু গা-টা গুলাচ্ছে হালকা।
বুকু রতনদাদুর দিকে তাকিয়ে বলল, কি হয়েছে যেন তোমার?
রতনদাদু চোখটা খুলে বুকুর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, ক্যান্সার গো দিদিভাই। ডাক্তার বলেছে আমি নাকি আর দেড় বছর বাঁচতে পারি বড়জোর।
বিশুদাদু বলল, আহা, কি যে বলিস না তুই... আরে ওরকম কিছু হবে না।
বুকু রতনদাদুর দিকে তাকালো ভালো করে। তার লাল জামাটা ময়লা। উপরের দুটো বোতাম নেই। বুকের পকেটে অনেক কাগজে ভর্তি। হাতে একটা সাদা প্লাস্টিক ছিল গাড়িতে ওঠার আগে, এখন পায়ের কাছে রাখা, একটা কালো প্যান্ট পরা। চশমাটার একটা ডাণ্টি ভাঙা, গার্ডার দিয়ে লাগানো, কাঁচটা ভীষণ ঝাপসা। দেখে কি করে?
বুকু বলল, তোমার ভয় করছে?
রতনদাদু বলল, একটুও না। ও তো আমার পুজোর ছুটির মত। বেশ বেড়াতে যাব, সারাদিন আর এই শরীরটার মধ্যে ঢুকে ঘুরে বেড়াতে হবে না, বেশ হবে না?
বুকু কথাটা ভালো করে বুঝতে পারল না। বুকু বলল, তুমি জানো চড়াইপাখি কত কমে যাচ্ছে?
রতনদাদু বলল, হুম জানি তো। আগে আমাদের বাড়ির উঠোনে কত চড়াই আসত, এখন একটাও দেখা যায় না।
কেন বলো তো?
রতনদাদু সামনের কাঁচটার ভিতর দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর বলল, মানুষেরা বড় স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে, শুধু নিজের কথা ভাবে, তাই হয় তো, কিম্বা হয়তো ওরা অন্য কোনো গ্রহে চলে যাচ্ছে সবাই। সেই গ্রহটা হয় তো আমাদের পৃথিবীর থেকেও সবুজ, আরো ভালো পরিষ্কার বাতাস, অনেক অনেক ভালোমানুষ, সবাই খেতে পায় পেট পুরে, কেউ কাউকে খারাপ কথা বলে না, এমন কোনো গ্রহ হয়তো আছে কোথাও, থাকতে পারে না পারমিতা? আমিও সেখানেই যাব ঠিক করেছি, যেতে পারব না?
বুকু বলল, হুম... হবে হয় তো।
বুকুকে বাড়ির সামনে বড় রাস্তায় নামিয়ে বিশুদাদু চলে গেল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রতনদাদু হাত নেড়ে গেল। বুকুর খুব ভালো লাগল রতনদাদুকে।
বুকু খাওয়া-দাওয়ার পর অনেক রাত অবধি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করল। চড়াই সংখ্যা দুটো যেন কি কি বলছিল? মনে পড়ছে না। কাল বেলায় যখন ছাদে আসবে চড়াইটা, তখন হিসাবটা করে নিতে হবে। বাবাকে বলেছে কাল একবার তার মোবাইলটা দিতে। অঙ্ক করতে হবে একটা। কঠিন বিয়োগ। কিন্তু চড়াইটা এলোই না, এক সপ্তাহ হয়ে গেল চড়াইটা আসার আর নাম নেই।
ইতিমধ্যে হুব্বা এসে গেছে বুকুর বাড়িতে। হুব্বা বাচ্চা হনুমান একটা। কি করে সে বুকুর বাড়িতে এসে গেছে সে গপ্পো তো আগের গল্পে আছে - "বাঘের গল্প বাঘের মুখে"। যারা জানো না পড়ে নিতে পারো। নইলে এ গপ্পোটা বুঝতে পারবে না।
তো সেই হুব্বা পাশের খাটে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। তার জন্যে আলাদা একটা খাট বানিয়ে দিয়েছে মা। হুব্বা এখন বাড়ির লোক। কত কাজ সারাদিন তার। মায়ের সাথে ছাদে কাপড় মেলতে যায়। ছাদে বড়ি দিলে পাহারা দেয়। বাবাকে কাগজটা বারান্দা থেকে শোয়ার ঘরে দিয়ে আসে। ঠাকুমার পানের বাটা এনে দেয়। ঠাকুর্দার মাথায় বিলি কেটে দেয়। আর বুকু বাড়ি থাকলে সারাদিন বুকুর ছায়া হয়ে থাকে। বুকুর ছোটোবেলার সব জামা তার গায়ে হয়।
বুকুর রীতিমতো চিন্তা হচ্ছে চড়াইটাকে নিয়ে। যতই বিরক্ত করুক ক্লাসে সে, কিন্তু বন্ধু তো হাজার হলেও। বুকু কি করবে বুঝতেই পারছে না।
একদিন রাতে বুকু টয়লেটে উঠেছে। ডাইনিং রুমে খাবার টেবিল থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে যেই জল খেতে যাবে হঠাৎ শোনে কে তার নাম ধরে ডাকছে, বুকু... বুকু... এই বুকু।
বুকু চারদিকে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। আর পাবেই বা কি করে? যা অন্ধকার। বুকু আলোটা জ্বালিয়ে দেখে গ্রীলের কাছে একটা চামচিকে। বুকু তার কাছে এগিয়ে গেল। হুব্বাও এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। চামচিকেটা বলল, আমায় রাজামশায় পাঠালেন জঙ্গল থেকে। তোমাকে ওনার এক ভাইয়ের কথা বলেছিলেন না যাকে সার্কাসে ধরে নিয়ে গেছে, সেই ভাই তোমাদের পাশের শহরে গত দশদিন ধরে আটকে পড়ে আছে। লক ডাউন তো, তাই যেতে পারছে না। তোমায় রাজামশায় বলেছেন, তুমি যদি ওকে ছাড়িয়ে জঙ্গলে দিয়ে আসতে পারো তো খুব ভালো হয়।
বুকু ঘাবড়িয়ে গেল। সেকি আবার স্বপ্ন দেখছে? নিজের গায়ে একটা চিমটি কাটল। জিভটা দাঁত দিয়ে চাপ দিল। না তো! স্বপ্ন তো নয়! তবে?
বুকু বলল, সে তো অনেক শক্ত কাজ, আমি কি করে পারব?
চামচিকে বলল, রাজামশায় তোমায় ভাবার জন্য তিনদিন সময় দিয়েছেন, তুমি ভেবে জানাও। আর রাজামশায় বলেছেন যা লাগবে তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন।
বুকু বলল, কিন্তু আমাদের তো লক ডাউন। আমি রাস্তায় বেরোলেই পুলিশ বকবে তো!
চামচিকে বলল, আরে সে তো শুধু মানুষের জন্য, আমাদের জন্য তো নয়। আমরা সবাই তো আসব তোমায় সাহায্য করতে। রাজামশায় বললেন, তুমি তো আমাদের জঙ্গলের একজন এখন থেকে। আর এতগুলো পশুপাখির সাথে একজন মানুষ ছাড় আছে। তুমি ভেবো না। আমি যাই তা হলে, তুমি ভাবো, তিনদিন পরেই আসব, ঠিক এই সময়ে।
চামচিকে চলে গেল। বুকু আলো নেভাতে যাবে, হঠাৎ একজন কেউ বলে উঠল, কি জ্বালায় পড়লে বাবা তুমি! বেটাগুলো জঙ্গলে থেকে থেকে বুদ্ধিগুলো জংলী হয়ে গেছে। আমাদের মত শহরের তো নয় যে পাকাবুদ্ধি হবে!
বুকু দেখল ভালো করে তাকিয়ে, একটা মোটা টিকটিকি টিউবলাইটের তলা থেকে মাথা বার করে তার দিকে তাকিয়ে এই সব বলে যাচ্ছে।
পাশ থেকে আরেকটা টিকটিকি এসে বলল, আর না তো কি দিদি, এই একটা বাচ্চা মেয়েকে কেউ অমন বাঘের খাঁচায় পাঠায়? জঙ্গলের বাঘ অত চালাকচতুর হয় না, তাই বুকু সে যাত্রায় বেঁচে ফিরেছে। কিন্তু খাঁচার বাঘ, সে তো এইটুকু বাচ্চাকে হাতের কাছে পেয়ে এ কথা, সে কথায় ভুলিয়ে টক্ করে মুখে পুরেই দিতে পারে, কি বলো দিদি, পারে না?
মোটা টিকটিকিটা বলল, পারে না আবার? আমি তাই বলি, কি সমস্যায় পড়লে এখন বলো দেখি? যাও এখন ঘুমিয়ে পড়ো গে যাও। আমি ও চামচিকি তিনদিন পরে এলে বুঝিয়ে বলে দেবখন, যে তুমি এত বড় রিস্ক নিতে পারবে না। বুঝেছ, যাও শুয়ে পড়ো।
বুকু সাথে সাথেই বলল, না না, একদম না বলছি, তোমরা একদম কিচ্ছু বলবে না। আমি যা বলার ভেবে বলব। তোমরা কিচ্ছু বলবে না।
মোটা টিকটিকিটা বলল, বেশ তুমি যদি বলো বলব না, সে আমরা তোমার ভালোর জন্যেই বলছিলাম।
বুকু আলো নিভিয়ে শুতে চলে গেল, পিছনে পিছনে হুব্বা। বুকুর মাথার মধ্যে হাজার একটা চিন্তা এখন, একে রাজা বাঘ, তারপর সার্কাসের বাঘ, ওদিকে চড়াইটার জন্য ভাবনা।
২
সকালে উঠে মুখে ব্রাশটা নিয়ে বুকু বাড়ির পিছনে পুকুরধারে গেল। চারটে হাঁস জলে সাঁতার কাটছিল। বুকুকে দেখে বলল, তোমাদের স্কুল বন্ধ বুঝি?
বুকু বলল, হ্যাঁ।
একটা হাঁস বলল, তবে তুমি এসো না, আমরা খেলা করি, কতদিন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলি না আমরা? আসবে?
বুকু বলল, বেলায় আসব, মা আজ লুচি করবে বলেছে, খেয়ে আসব। আগে বলো তোমরা চড়াইটার কোনো খোঁজ জানো?
একটা হাঁস বলল, যে তোমায় স্কুলে বিরক্ত করে বলছিলে?
বুকুর কথাটা শুনে খারাপ লাগল। তাই তো! মিথ্যা মিথ্যা সে চড়াইটার দুষ্টুমির কথা সবাইকে বলে বেড়িয়েছে। দুষ্টুমি সে করে। কিন্তু বুকুকে যে ভালোবাসে না তাও তো নয়! বুকু কলপাড়ে গিয়ে মুখটা ধুয়ে ব্রাশটা ফ্রকের একটা পকেটে ভরে বাগানে ঘুরতে লাগলো এলোমেলো। একটা জবাগাছের কাছে এসে দাঁড়ালো, ঠাম্মা এখনও ফুল তুলে নিয়ে যায়নি, কত ফুল ফুটে আছে! কেন যে মিছিমিছি ঠাম্মা ফুলগুলো তুলে নেয়, ঠাকুর তো এইখানে গাছে এসেও ফুলগুলো দেখে যেতে পারে, কেন তুলে ঠাকুরের সামনেই রাখতে হবে? ভাল্লাগে না ছাই!
একটা কেন্নো জবাগাছের গা বেয়ে উঠছে। বুকুকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর খুব আস্তে আস্তে বুকুকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা বুকু, আর কতটা উঠলে মগডাল গো?
বুকু বলল, তা তুমি যা স্পিডে হাঁটছ মনে হচ্ছে আরো একঘন্টা লাগবে। কেন? মগডালে উঠে কি করবে?
কেন্নো বলল, এমনিই উঠব, ওখান থেকে আকাশটা কি স্পষ্ট দেখা যায়! আমার গায়ের রঙ লাল, আকাশের নীল। কি দারুণ না! লাল আর নীল? আমার কি ইচ্ছা হয় জানো? আমি আকাশের গায়ে হেঁটে হেঁটে বেড়াই। মেঘের মধ্যে দিয়ে যাই। চাঁদের পরিধি বরাবর গোল হয়ে ঘুরি। তোমার ওরকম ইচ্ছা করে না?
বুকু একটু ভেবে বলল, জানি না, ভাবিনি কোনোদিন।
কেন্নো বলল, আমায় কি সুন্দর দেখাবে বলো? একটা লালরঙের কেন্নো নীলরঙের আকাশের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। কিম্বা সাদা চাঁদের উপর দিয়ে একটা লালরঙের কেন্নো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি দারুণ হবে না?
বুকু বলল, সে হবে। তবে পড়ে গেলে খুব লাগবে, তাই না?
কেন্নো বলল, না না, সে আমি আগেই ভেবে রেখেছি, মাঠের যেখানে ঘাস ঘাস তার উপর যে আকাশ, সেখানে যখন চাঁদ উঠবে তখন উঠব, তবে পড়লে লাগবে না।
হঠাৎ বুকু খিলখিল করে হেসে উঠল। কেন্নো একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, তুমি আমায় বোকা ভেবে হাসছ?
বুকু বলল, আরে না। ভাবো তুমি চাঁদের গায়ে হাঁটতে হাঁটতে চাঁদের বুড়ির গায়ে উঠে পড়েছ। তখন হয় তো চাঁদের বুড়ি ঘুমাচ্ছিল। যেই না গায়ে সুড়সুড়ি লেগেছে, অমনি সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে, আর চাঁদটা কেঁপে গিয়ে আকাশের একটা দিকে হেলে গড়িয়ে পড়েছে, আর তুমি টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে ধপাস...
বুকু হাসতে হাসতে মাটিতে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ে বিষম খেয়েটেয়ে একাক্কার অবস্থা। কেন্নোটা বলল, ধুর, খালি আমায় নিয়ে মজা করা... আমায় কে আকাশে নিয়ে যায় তার নেই ঠিক, আমি নাকি আকাশে উঠব...
বুকু একটু ধাতস্থ হয়ে যেই বাড়ির দিকে এগোতে যাবে অমনি চড়াইটা এসে তার কাঁধে বসল। বুকুর প্রাণটা হুস্ করে নেচে উঠল ওকে দেখে। বুকু বলল, অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি?
চড়াই বলল, আর বলিস না, কি পেট খারাপ হয়েছিল!
কেন? কিছু ভুলভাল খেয়েছিলি বুঝি?
হুম তো, একটা চুইনগাম কেউ খেয়ে মাঠে ফেলে রেখে গিয়েছিল। আমি অতশত না বুঝে গিলতে গেছি, ব্যস... গেছে গলায় আটকে। দম আটকে ছটফট করে মরছি, শেষে একটা বাবুই ওর ঠোঁটটা আমার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে বার করে। নইলে আমার সাথে আর দেখা হত না তোর। তারপর সেই চুইনগামের কিছুটা তো পেটে ঢুকেই গিয়েছিল। তাই থেকে পেট খারাপ।
বুকু বলল, আমি আমার বন্ধুদের ওইজন্যেই বলি চুইনগাম, প্লাস্টিক যেখানে সেখানে ফেলতে নেই...
বলতে বলতেই পাশের থেকে একটা ছাগল বলে উঠল, হুম তো। আমার সেজদা একবার একটা আস্ত মুড়ির প্লাস্টিক গিলে সাড়ে তিনদিন অজ্ঞান হয়েছিল। দম আটকে। আমাদের পরিবারের সবাই ভেবেছিল আর বোধহয় সে ফিরবে না। তারপর একটা বক এসে বার করে দিল। তবে আমার সেজদা বেঁচেছিল।
চড়াইটা বলল, সে তোমাদের হতে পারে ভাই, লোকে বলে ছাগলে কি না খায়... তাই বলে কেউ শুনেছে যে চড়াইয়ে কি না খায়...
অমনি ছাগলটা বলে উঠল, না গো না, ওই কথাটা গ্রামের কথা... গ্রামে সবধরণের শাকসব্জী খেয়ে ফেলি তো আমরা, তাই, প্লাস্টিকের কথা ওর মধ্যে ধরলে কি চলে? তাই ওরকম একটা কথা চালু আছে... এখন অবশ্য গ্রামেও প্লাস্টিক খেয়ে আমার কত আত্মীয় অসুস্থ হয়ে যায় খবর পাই….
বুকু বলল, সে থাক, তুমি আপাতত ঘাস খাচ্ছ, খাও, আমরা একটু ছাদে যাই।
ছাগলটা এগিয়ে এসে খুব আহ্লাদের সাথে বলল, আমায় একবার ছাদে নিয়ে যাবে বুকু? আমার একবার ছাদে চড়ে রাস্তার গাড়ি দেখার খুব শখ।
বুকু বলল, সে না হয় নিয়ে যাব। কিন্তু গাড়ি দেখবে কি করে? এখন তো লক ডাউন চলছে। রাস্তায় খালি পুলিশের গাড়ি।
ছাগল বলল, তাই দেখব।
বুকু বলল, আচ্ছা, দুপুরে সবাই যখন ঘুমাবে তখন হুব্বা তোমায় ডেকে নিয়ে যাবে।
হুব্বার নাম শুনেই ছাগলটা কেমন মুষড়ে পড়ল। বুকু বলল, কি হল তোমার? তুমি কি হুব্বাকে ভয় পাও?
ছাগলটা হঠাৎ করে চলে যেতে শুরু করল। বুকু ডাকল, আরে? কি হল? চলে যাচ্ছ যে! ছাদে উঠবে না?
ছাগলটা বলল, না বাবা তোমাদের ছাদ তোমাদেরই থাক। আমার সেখানে উঠে কাজ নেই। বলতে বলতে ছাগলটা পাশের ঝোপে মিলিয়ে গেল।
বুকু আর কথা বাড়ালো না। ব্রাশটা জায়গায় রেখে চড়াইকে নিয়ে ছাদে চলে এলো। হুব্বা ছাদেই ছিল, একটা কলা খেতে খেতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। বুকু গিয়ে বলল, তুই আজ আমার সাথে পুকুরের দিকে যাসনি কেন?
হুব্বা কিছু না বলে একটা কাগজের টুকরো বাড়িয়ে দিল।
বুকু কাগজটা নিয়ে পড়ে দেখল,
বুকু,
আমায় তিনদিনের মধ্যে এই সার্কাসের খাঁচা থেকে বার করে নিয়ে যাও। আমার দাদাকে তুমি চেনো। এরা বলছে একটা খুব খারাপ লোক নাকি এসে আমায় মেরে ওর বাড়িতে আমার ছালটা ঝুলিয়ে রাখবে। ওর নাকি শোয়ার ঘরে বাঘের ছাল ঝোলানোর অনেকদিনের শখ। আমাদের মালিক এই লকডাউনের সময় কাজ পাচ্ছে না, তাই রাজি হয়ে গেছে। আমায় খেতেও দিচ্ছে না। আমি মরে গেলে নাকি লোককে বলবে, আমি রোগে ভুগে মরে গেছি। আমায় বাঁচাও বুকু।
ইতি,সার্কাসের বাঘ
বুকুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। যে শহরে ওরা আছে সেটা এখান থেকে সাড়ে আট কিলোমিটার, বুকু বাবার মোবাইলে দেখেছে। কিন্তু যাবে কি করে? ওখানে নিশ্চয় অনেক পাহারাও আছে।
বুকুর কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে চড়াই পড়ল। তারপর ‘চিঁ চিঁ’ চীৎকার করে বলল, আরে না না, একে বাঘ, তায় অ্যাদ্দিন খায়নি। তোমায় খাঁচার ভিতর দেখলেই ওর মাথার ঠিক থাকবে না, তোমায় খেয়ে ফেলবে বুকু।
বুকু কিছু বলল না। এ সব সে ভাবছে না। সে ভাবছে কি প্ল্যান করা যায়? কার সাথে কথা বলা যায়? সারস যদি একবার আসত, সে অনেক বুদ্ধি রাখে। রাজা তো জঙ্গল ছেড়ে আসতে পারবে না, আর এলেও লোকে তাকে জ্বালিয়ে মারবে। তবে?
চড়াই চুপ করে ছাদের কার্ণিশে বসে বুকুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হুব্বাও তার মুখের দিকে তাকিয়ে। বুকুর মনটা খুব অস্থির লাগছে। কি করা যায়?
বুকু হঠাৎ করে চড়াইকে বলল, আচ্ছা তুই একবার আমার জন্যে জঙ্গলে যাবি? ওখানে গিয়ে সারসকে খুঁজে বার করবি। বলবি বুকুকে চেনে যে সারস সে কোথায়, তোকে দেখিয়ে দেবে। তাকে একবার আসতে বলবি? আমার মনে হয় আমাদের যা করতে হবে কালকেই। রাতে গিয়ে করতে হবে। ওদিকে রাজামশায় এত কিছু জানেন না নিশ্চয়। তবে আমায় তিনদিন সময় দিতেন না ভাবার।
চড়াই বলল, কিন্তু সার্কাসে বাঘ জঙ্গলের দাদাকে না জানিয়ে তোমায় জানাচ্ছে কেন?
বুকু বলল, সে তো সোজা কথা, ওর দাদা হয় না? তাই তার এই বিপদ শুনে সে যদি নিজেই চলে আসে শহরে, তখন এরা ওকে ছেড়ে দেবে নাকি? ওকেও মেরে ছাল ছাড়িয়ে নেবে। ওদের বাবা-মা’র সাথে তাই হয়েছিল।
চড়াই ভয় পেয়ে গেল। সে বলল, আচ্ছা তাই হবেখন। আমি এখনই যাচ্ছি, তুমি দেখো না নীচে গিয়ে যদি একটু মুড়ি আর ছোলা ভেজানো আনতে পারো।
বুকু বলল, আমার ঘরের রাস্তার দিকের জানলায় রাখা আছে যা, আমি রোজ সকালেই বানিয়ে রাখি তোর জন্যে, তুই তো... যাক গে যা, তাড়াতাড়ি কর... আমাদের হাতে সময় নেই আর।
চড়াই বলল, সে যাচ্ছি, আসলে এতটা রাস্তা তো, কোথায় খাবার পাই না পাই। এমনিতেই সব হোটেল বন্ধ চারদিকে। আমাদের খাবারের যা অসুবিধা হচ্ছে না। আমাদের, কাকেদের, কুকুরদের, বেড়ালদের। যাক গে... খেয়েই যাচ্ছি আমি...
চড়াই চলে গেল। বুকু হুব্বার কাছে এসে ওর গলা জড়িয়ে বলল, তুই কি ভাবছিস আমি জানি। তুই ভাবছিস, এক, আমার যদি কোনো বিপদ হয়, আর দুই, তোকে আবার যদি ওরা জঙ্গলে নিয়ে যেতে জোর করে, তাই তো?
হুব্বা মাথা নেড়ে বুকুর কাঁধে মাথা রাখল। তার চোখে জল। বুকু ওকে কোলে নিয়ে, হুব্বার মুখটা নিজের মুখের কাছে এনে বলল, আচ্ছা বলতো তুই কি ছাগলটার পিছনে লাগিস?
হুব্বা, মুখটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। বুকুর খুব হাসি পেল। সে আবার হুব্বার মুখটা জোর করে নিজের মুখের দিকে ঘুরিয়ে বলল, কি করিস বল, আমি বকব না।
হুব্বা তখন বুকুর কোল থেকে নেমে, ছাদে রাখা একটা চেয়ারের পিছনের পা দুটো উপরে তুলে ইশারা করে দেখালো সে এরকমভাবে ছাগলটার পিছনের পা-দুটো ধরে তুলে দেয়।
বুকু হো হো করে হেসে বলল, আর ছাগলটা তখন কি করে?
হুব্বা হাতদুটো সামনে ছোঁড়াছুঁড়ি করে দেখালো ছাগলটা কি করে...
এর মধ্যে চড়াই নীচ থেকে খেয়ে এসে গেছে, সে বলছে, হাসছ কেন?
বুকু তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রকটা ঝেড়ে নিয়ে বলল, শোন, সে কথা পরে হবে। তুই সারসকে নিয়ে বিকালের মধ্যে আমাদের পুকুরের পিছন দিকে যে বাঁশঝাড়টা আছে সেদিকে চলে আসবি। যা করতে হবে আমাদের কালকে রাতেই করতে হবে, মনে থাকে যেন। বুঝেছিস?
নীচ থেকে বুকুর মায়ের ডাক এলো — বুকু, নীচে চলে এসো, লুচি ভাজা হয়ে গেছে...
চড়াইটা ঘাড় কাত করে শুনে বলল, ইয়ে মানে একটা লুচি খেয়ে গেলে হত না?
বুকু চোখ পাকিয়ে বলল, একদম না, ক’দিন আগেই না তুই হেগে মরছিলি...???
চড়াই বলল, থাক থাক... কি ভাষা... আমি চললাম... বাঘে খেলে ভূত হয়ে তোর ঘাড়ে বসে থাকব দেখবি...
বুকু চড়াইয়ের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে মাথাটা নীচু করতেই দেখে হুব্বা কাকে একটা ভ্যাঙাচ্ছে...
বুকু ছাদের ধারে এসে দেখে ছাগলটা নীচে একটা সন্ধ্যামালতী গাছের পাশে বসে কি একটা চিবাচ্ছে আর হুব্বা ওকে ভ্যাঙাচ্ছে...
আবার নীচ থেকে মায়ের ডাক — বুকু...!!! একবার ডাকলে কথা কানে যায় না রে...
বুকু হুব্বার কান ধরে টানতে টানতে নীচে নিয়ে যেতে যেতে বলল, চ... চ... নিজেও মার খাবি... আমাকেও খাওয়াবি...
৩
দুপুরে খাওয়ার পর বুকু ঘুমালো না। কোলবালিশ জড়িয়ে এমনভাবে শুয়ে থাকল, যাতে বাড়ির সবাই ভাবে সে ঘুমাচ্ছে। তারপর বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, বাইরের পেয়ারা গাছ থেকে ঘুঘু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, বুকু আসতে আসতে উঠে গ্রীলটা খুলে বাগানে এলো। ছাগলটা একটা আমগাছের তলায় বসে প্রায় অর্ধেক চোখ বুজে কিছু একটা চিবাচ্ছে। বুকু কাছে গিয়ে বলল, কিরে ছাদে যাবি?
ছাগলটা কিছু একটা ভাবছিল। বুকুর গলার আওয়াজ শুনেই চমকে উঠল। তারপর বলল, ছাদে? তাই বললে?
বুকু বলল, হ্যাঁ, ছাদে... ছাদে যাবি?
ছাগলটা বসে বসেই একবার ঘাড় উঁচু করে চারদিকটা দেখল। বুকু বলল, হুব্বা ছাদেই আছে।
ছাগলটা মাথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, তবে থাক, আমার আর ছাদে উঠে কাজ নেই।
বুকু বলল, আচ্ছা ভীতু ছাগল তো রে বাবা, চ, আমি তো আছি, হুব্বা কিছু বলবে না।
ছাগলটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, তবে যাই চলো, ছাদ থেকে রাস্তার গাড়ি দেখা আমার কতদিনের শখ।
বুকু বলল, আস্তে আস্তে উঠবি কিন্তু, ফুর্তির চোটে না তো চিল্লামিল্লি করবি, না বেশি লাফালাফি করবি। তবে বাড়ির লোক উঠে তোকে আমাকে একসাথে বাড়ির বাইরে বার করে দেবে। বুঝলি?
ছাগলটা মাথা নেড়ে দিল। মানে ‘বুঝলাম’।
বুকু আর ছাগলটা ধীরে ধীরে ছাদে উঠল। ছাদের কার্ণিশের কাছে এসে বুকু ওকে সামনের পা’দুটো তুলে কার্ণিশে রেখে দাঁড় করিয়ে দিল। ছাগল মুগ্ধ। একবার আড়চোখে হুব্বাকে দেখে নিয়ে বলল, তোমরা নিজেদের মত থাকো, আমি রাস্তা দেখি। আমি কাউকে বিরক্ত করব না। আচ্ছা ওই রাস্তাটা সোজা জঙ্গলের দিকে গেছে না? আমি কোনোদিন যাইনি, শুনেছি। আচ্ছা, দূরে ওই পাহাড়ের উপর ওটা মন্দির না? আচ্ছা, ওই যে হলুদ রঙের বাড়িটা, ওর পাশ দিয়ে যে সরু রাস্তা, সেই রাস্তার শেষে একটা বড় মাঠ আছে না? কি কচি কচি ঘাস গো? আমার এক দূর সম্পর্কের জ্যাঠা থাকত। মারা গেছে। কে যেন কাউকে না বলে জ্যাঠাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কেটে খেয়ে ফেলেছে।
বুকু ছাগলের কথা মন দিয়ে শুনছিল না তেমন। হুব্বাকে বুকু নিজের কাছছাড়া করছে না। পাশেই রেখেছে। বুকু বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে, এতক্ষণে তো চড়াইয়ের চলে আসার কথা সারসকে নিয়ে।
হঠাৎ দেখে হুব্বা তার কাছ ছেড়ে ছাগলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বুকু গিয়ে কার্ণিশের পাশেই দাঁড়ালো, কে জানে কখন কি করে বসে।
একটা কাক কোত্থেকে এসে বলল, তোমরা ছাদে, ভালোই হয়েছে, আমায় একটু জল খাওয়াবে?
বুকু ইশারা করল। হুব্বা দৌড়ে নীচে নেমে গেল। কাক বলল, কি অবস্থা না চারদিকে? লোকজন সব ঘরে ঢুকে গেছে, জানো আমার কাছে একটা খবর আছে, তোমার কাজে লাগলেও লাগতে পারে।
বুকু বলল, কি?
কাক বলল, আগামীকাল রাতে একটা চালভর্তি লরি আমাদের শহরের থেকে ওই সার্কাসের পাশ দিয়ে অন্য শহরে যাবে। তুমি চাইলে ওই লরিটায় যেতে পারো।
বুকু বলল, তুমি জানলে কি করে?
কাক বলল, লরির কথা না সার্কাসের বাঘ ছাড়ানোর কথা?
বুকু বলল, দুটোই।
কাক বলল, চড়াই যখন জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিল তখন আমার সাথে দেখা হয়েছিল, তখন প্রথমটা শুনলাম। পরেরটা আমি ওই চালের আড়তের দিকে গিয়েছিলাম যদি কিছু খুচরো চাল পড়ে থাকে খাওয়ার জন্য, সেইখানেই আলোচনা হচ্ছে শুনলাম।
হুব্বা একটা ছোটো জলের বোতল আর একটা বাটি নিয়ে এসে কাকের সামনে রাখল। বোতল খুলে জল বাটিতে ঢেলে একপাশে সরে দাঁড়ালো। কাক একসাথে অনেকটা জল খেয়ে তারপর বলল, আমি আসি তবে। একটা খুব বড় কাজ করতে যাচ্ছ বুকু। আমরা সবাই খুব গর্বিত তোমার জন্য।
কাক উড়ে গেল। ছাগলটা এতক্ষণ কিছু বলেনি। এইবার সে পা’দুটো কার্ণিশের উপর থেকে নামিয়ে বুকুর দিকে ফিরে বলল, তুমি কি ওকে এই বাড়িতে এনে রাখবে?
বুকু বলল, কাকে?
বাঘকে।
বুকু বলল, আরে ধুর, তাই হয় কখনও? ও জঙ্গলে চলে যাবে ওর দাদার কাছে।
ছাগল বলল, বাঁচালে, নইলে আমাকেও জ্যাঠার মত কখন সাবাড় করে দিত কে জানে।
বুকু দেখল দূর থেকে সারসকে দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয় চড়াইও সাথে আছে, দূর বলে দেখা যাচ্ছে না হয় তো।
দেখতে দেখতে সারস সামনে চলে এল। চড়াইকেও দেখা যাচ্ছে। ছাদের কার্ণিশে এসে বসল দু’জনে। বুকু বলল, এখানে না, চলো আমরা আমাদের বাগানের পিছন দিকে যাই। ওদিকে কেউ যায় না তেমন, নইলে এখনিই ঠাকুর্দা ঘুম থেকে উঠেই ছাদে চলে আসবে ব্যায়াম করতে।
বুকু, হুব্বা, ছাগল সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে বাগানে এল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে যখন বাগানের পিছন দিকটায় যাচ্ছে হঠাৎ শুনল কেন্নোর গলার আওয়াজ।
“বুকু কাজটা ভালো করছ। কিন্তু আমায় নামিয়ে দিয়ে যাবে প্লিজ?”
বুকু তাকিয়ে দেখল, কেন্নোটা একটা বড় পাতার ধারে এসে ঝুলছে।
বুকু বলল, পড়ে যাবে তো, এভাবে কেউ ঝোলে?
কেন্নো বলল, আসলে আমি নামার ডালটা ঠিক করতে পারছিলাম না। তাই আর কি...
বুকু কেন্নোকে নামিয়ে হাতে ধরে বলল, কোথায় রাখব তোমায়?
কেন্নো বলল, আপাতত তোমার কাঁধে রাখো, আমি শুনব তোমরা কি ভাবছ। আমি যদি কোনো কাজে লাগতে পারি।
বুকু ‘আচ্ছা’ বলে কেন্নোকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই দেখল সামনে প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে হাঁসের দলও তাদের সাথে সাথে চলেছে। বুকু বলতে যাচ্ছিল, তোমরা?
একজন হাঁস তার আগেই বলল, কি ঝুঁকির কাজ বুকু! আমরাও যাই, হাজার হোক আমরা প্রতিবেশী তো বলো? আমাদেরও তো একটা দায়িত্ব আছে। কি না?
বুকু বলল, তা তো আছে।
বুকু বাগানের পিছনে গিয়ে দেখল সারস, চড়াই তো আছেই। সাথে বারো-চোদ্দোটা ব্যাঙ, হাঁড়িচাঁচা ডজন খানেক, শুয়োর ছ-সাতটা, বক ইত্যাদি আরো কত কত পশুপাখি জমায়েত হয়ে বসে আছে গোনা তো যায়ই না, সবাইকে ঠাহরও করা যায় না।
বুকু যেতেই সব হইচই করে বলে উঠল, এই যে তুমি এসে গেছ, আমরা তো কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি। বক ঘাড় নেড়ে বলল, এতদিনে একটা কাজের মত কাজ হচ্ছে। মানুষগুলো কি গা, আমাদের বন্দী করে, আমাদের নিয়ে মস্করা করা? না না, এর একটা বিহিত করতেই হবে।
সবাই একসাথে বলে উঠল, ঠিক ঠিক, এর একটা বিহিত করতেই হবে। করতেই হবে।
বুকু একটা গাছের নীচু ডালের উপর বসল। তারপাশে হুব্বা। সারস এগিয়ে এল বুকুর দিকে। সবাই যার নিজের মত কথা বলছে। কেউ কারোর কথা শুনতেই পাচ্ছে না। বুকু দু-একবার চীৎকার করে থামাতে গেল। কেউ শুনতেই পেল না। হঠাৎ একটা হুঙ্কার, সবাই চুপ। বুকু তাকিয়ে দেখল একটা বড়সড় ষাঁড়। সে সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, বলো বুকু। আমাদের কি করতে হবে।
বুকু সারসের দিকে তাকালো।
সারস বলল, দেখো, আমাদের বেশ ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। কালকের রাত্রের মধ্যে বাঘকে না ছাড়ালে ওকে মেরে ফেলবে। তোমরা সবাই শুনেছ তো?
সবাই একসাথে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি। বক আবার রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল। একটা প্রজাপতি ওর ঠোঁটের উপর বসে বলল, থামো না দিদিভাই, বুকুদিদি কি বলছে আমরা শুনে নিই আগে।
বুকু বলল, আগে আমরা সারস মায়ের কথা শুনে নিই, তারপর আমি যা বলার বলব।
সারস পাশের বটগাছের উঁচু একটা ডালে উঠে গেল। সেখান থেকে বেশ জোরে জোরেই বলতে শুরু করল -
আগামীকাল রাতে আমরা সবাই একজোট হয়ে শুধু বাঘ না, যত পশুপাখি আটকে রয়েছে, সবাইকে আমাদের ছাড়াতে হবে। কেউ যাতে আর কষ্ট না পায়। কি করতে হবে শোনো। এখন মানুষদের একটা লক ডাউন চলছে। তোমরা শুনেছ কিনা জানি না সারা পৃথিবীতে সব পশুপাখি মানুষের বানানো রাস্তায় হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। তারা এখন আর ভয় পাচ্ছে না। কারণ মানুষ নিজেই অনেক ভয়ে আছে এখন। তারা আমাদের সবাইকে আমাদের জায়গা থেকে তাড়িয়েছে। আমাদের জঙ্গল কেটে কেটে খালি খালি নিজেদের ঘরবাড়ি, কলকারখানা বানিয়েছে। এ সব কি উচিৎ বলো?
সব্বাই হইহই করে বলে উঠল, একদম না, একদম না।
একটা গরু ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আমার বাচ্চাগুলো যে একটু কচি কচি ঘাস খেয়ে ঘুরে বেড়াবে, এমন একটা মাঠও বাঁচিয়ে রাখেনি ওরা। সব বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি বাড়ি বানিয়ে রেখেছে।
সারস বলল, ঠিক ঠিক। আচ্ছা শোনো। আমরা কাল সবাই বুকুদের এই বাগানে রাত আটটা নাগাদ জড়ো হবো। তারপর হাঁটতে শুরু করব। কারণ এখন আমরা রাস্তায় বেরোলে কেউ কিচ্ছু বলছে না আগেই বলেছি তোমাদের ভাইসব। এখন কথা হচ্ছে বুকু কি করে যাবে? এতটা রাস্তা তো সে হেঁটে যেতে পারবে না। আর আমাদের কারোর পিঠে চড়ে রাস্তায় গেলে কারোর চোখে পড়লেই ওকে তুলে নিয়ে বাড়ি দিয়ে যাবে। কি করা যাবে?
বুকু ইস্কুলে টয়লেটে যেতে গেলে যেমন করে হাত তোলে তেমন করে হাত উঁচু করল। সারস নিজের জায়গা ছেড়ে নেমে এসে বুকুর পাশে বসে বলল, এখন বুকু কি বলে শোনো সবাই।
বুকু একটা গাছের উঁচু খাঁজে দাঁড়িয়ে, দুই হাতে পাশপাশি দুটো ডাল ধরে বলতে শুরু করল, দেখো, কাল রাতে একটা লরি ওই সার্কাসের পাশ দিয়ে যাবে। লরিটা চাল নিয়ে যাবে। আমায় কাক বলল...
অমনি কাক ভিড়ের ভেতর থেকে বলল, ঠিক ঠিক, আমিই বলেছি, একদম পাক্কা খবর, কাক কখনও বেকার খবর দেয় না।
বুকু বলল, এখন কথা হচ্ছে আমি ওই লরিতে চড়ব কি করে?
সবাই আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল। আবার একটা হইচই পড়ে গেল। আবার ষাঁড় চীৎকার করে সবাইকে থামিয়ে দিল।
ষাঁড় বলল, শোনো, আমার বয়েস হয়েছে, আমি তোমাদের সাথে ওই অতদূর হাঁটতে পারব না। কিন্তু এতবড় একটা কাজে আমার নিজের কিছু অবদান তো রাখতেই হয়। তাই আমি আর আমার শালা, দু’জনে মিলে রাতে রাস্তার উপর শুয়ে থাকব। ঠিক বুকুদের বাড়ির সামনে। যেই না লরিটা আসবে, অমনি আমাদের দেখেই থেমে যাবে। আমাদের রাস্তা থেকে ওঠাতে চাইবে। তখন আমাদের প্যাঁচা বন্ধুরা বুকুর উপর নজর রাখবে। যেই না বুকু লরিতে উঠে যাবে, অমনি আমাদের একটা ডাক দেবে, আমরা ধীরে ধীরে রাস্তা ছেড়ে দেব। ঠিক?
ষাঁড়ের কথা শেষ হতে না হতেই বাগানের কোথাও থেকে দু’বার প্যাঁচা ডাকার আওয়াজ শোনা গেল।
ষাঁড় বলল, ও এখন আলো আছে বলে বাইরে আসছে না। তবে আমাদের কথা সব শুনতে পাচ্ছে।
সারস বলল, তবে আমাদের সভা এখানেই সমাপ্ত। বনের সব পশুপাখিদের তরফ থেকে তোমাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। ওরাও এতক্ষণে মিছিল করে আসতে শুরু করে দিয়েছে। জঙ্গলের ধারে অপেক্ষা করবে সবাই কাল সারাদিন। কাল রাত হলেই তোমাদের সাথে দেখা করে একসাথে আমরা মিছিল করতে করতে যাব। আমাদের দেখা হবে, ওই শহরে ঢুকতেই যে একটা বড় শিমূলগাছ আছে, ওর তলায়। কারণ ওর থেকে আর এক কিলোমিটার মত গেলেই জঙ্গলের শুরু। আমরা সব ওখান থেকেই আসব। শুধু রাজামশায় আর তার সেবার জন্য কয়েকজন জঙ্গলে থেকে যাবে। আজ আসি তবে?
হইহই করে সভা ভঙ্গ হল। বুকু আর হুব্বা যখন ঘরে ফিরল তখন ঠাকুমা তুলসীতলায় প্রদীপ দিচ্ছে। বুকু ঘরে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়েই পড়তে বসে গেল। হুব্বা জানলার ধারে গিয়ে বসল। এক-একবার দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকাচ্ছে, কি করে বেরোবে বাড়ি থেকে এটাই ভাবনার।
৪
ঘুম থেকে উঠে বুকু আজ বাইরে গেল না। বই নিয়ে পড়তে বসে গেল। হুব্বা ছাদে চলে গেল, আজ বুকুর মা বড়ি দেবেন। তাকে পাহারা দিতে হবে।
বুকু অঙ্ক বই খুলে বসেছে। বাবা খুশী হন অঙ্ক বই দেখলে। একটা খাতা বার করে কয়েকটা আগে করা অঙ্ক আবার করতে শুরু করেছে। মনটা বড্ড লাট্টুর মত ঘুরছে আজ। বুকু কি করবে বুঝতেই পারছে না। হঠাৎ চড়াই পাখিটা জানলায় এসে বসল। গ্রীলের ওদিকে। বসেই বলল, আমি জানি তুই কি ভাবছিস। কি করে বাড়ি থেকে বেরোবি তাই তো? আমি তোকে একটা উপায় বাতলাতে এসেছি। আসলে আজ সকালে আমার পটিটা খুব ভালো হয়েছে তো তাই আমার মনটাও বেশ ভালো।
বুকু আস্তে আস্তে বলল, সক্কালবেলা ফের যদি তুই তোর হাগুর গপ্পো বলতে এসেছিস...
বুকু একবার দরজার দিকে তাকিয়ে নিল। ঠাকুর্দা আসছে এদিকে। বুকু তাড়াতাড়ি ইংরাজি বইটা বার করে নিল। ঠাকুর্দা আবার ইংরাজি পড়লে খুব খুশী হয়ে যান।
বুকু অঙ্কের পাতাটাকে উল্টে দিয়ে ইংরাজি লিখতে শুরু করল। চড়াইটা বলল, তুই একটু আগে অঙ্ক করছিলি না? তোর কি আজ সকালে পরিষ্কার হয়নি? তুই এইসব ছাইভস্ম এটা ওটা পড়ে মরছিস কেন?
বুকু উত্তর দেওয়ার আগেই ঠাকুর্দা ঢুকে গেল ঘরে। চড়াইটাও বেগতিক দেখে পাশের একটা জবাগাছে বসে দূর থেকে বুকুর উপর নজর রাখতে লাগল।
ঠাকুর্দা বুকুকে বললেন, ইংরাজি পড়ছ বুঝি? বাহ্ বাহ্... ইংরাজি না পড়ে কেউ বড়ো হয়েছে কোনোদিন?
অমনি চড়াইটা বলল, ইংরাজি না পড়ে কেউ বুড়ো হয়েছে কোনোদিন?
বুকু দাঁত চেপে বলল, বুড়ো না হতচ্ছাড়া, বড়ো...
চড়াই বলল, সে ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করলে, পেট পরিষ্কার করে সময়মত পটি করলে এমনিই যে কেউ বড়ো হয়ে যাবে! বলি জঙ্গলের হাতিগুলো কি ইংরাজি ডিকশনারি খেয়ে খেয়ে বড় হয়, না গাছপালা খেয়ে খেয়ে আর গোল গোল তাল তাল হাগু করে, থুড়ি, পটি করে হয়? তোর সাথে মিশে মিশে আমার ভাষা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বুকু। তুই একটু বাংলা বইটা খোল দেখি।
অবশ্য বাংলা বইটা খুলতেই হত, কারণ ঠাকুমা ঘরে ধুপ দেখাতে আসছেন। পুজো হয়ে গেছে। ঠাকুমা বাংলা পড়তে দেখলে খুব খুশি হন।
বুকু তাড়াতাড়ি বাংলা বইটা হাতে নিয়ে একটা কবিতা পড়তে যাবে, ঠাকুমা একটা হাতে ধুপ ধরে, আরেক হাত বুকুর মাথায় বুলিয়ে বলল, বাংলা পড়ছ দিদিভাই? পড়ো পড়ো, নিজের মাতৃভাষা না শিখলে অন্যকিছু কি করে ভালো করে শিখবে?
চড়াই আবার গ্রিলের বাইরে এসে বসেছে। সে ঠাকুমাকে অত ভয় করে না। বুকুকে বলল, তোদের বাড়ির কি সবারই এমন কচুপোড়া বুদ্ধি রে? মাতৃভাষা কি কেউ বই পড়ে শেখে? সে তো আপনিই শিখে যায়। অন্যের ভাষা শিখতে কত কি লাগে। এই যেমন ধর না, আমার বাসার নীচে একটা ব্যাঙ আর তার পরিবার ছিল। ছিল মানে আছে এখনও। তা তারা বর্ষাকাল হলেই সে কি ডাকাডাকি করে রে বাপু! একবার বাবা ব্যাঙ তার ছেলেদের একটা কবিতা মুখস্থ করাচ্ছিল সকালবেলা। আমিও বাড়ি থেকে বেরোইনি, প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে সেদিন। মন দিয়ে ওদের পড়া শুনছি। তা শুনতে শুনতে আমার কি খেয়াল হল বুঝলি, আমি ওদের মত গলা করে ডাকব ঠিক করলাম। বাসার ভিতরে গিয়ে যেই না কয়েকবার ডেকেছি, অমনি গলা গেল বসে। ব্যস? কি অবস্থা। ভোর হয় ডাকতে পারি না। সন্ধ্যা হয় ডাকতে পারি না। ব্যাঙ কি আর সকাল-সন্ধ্যা ডাকে বল? আমি তো কেঁদেই মরি। অমন কান্না আমি কোনোদিন কাঁদিনি রে বুকু। তারপর এক হাঁড়িচাচার ওষুধ খেয়ে আমার গলা ঠিক হয়। সে আমায় সেদিন একটা ভালো কথা বলেছিল রে বুকু, যার ভাষায় প্রাণ নেই, তার ভাষা শুকনো বেল। গলায় আটকে প্রাণ যায়। আর যার ভাষায় প্রাণ আছে, তার ভাষা পাকা আম। খেলে প্রাণে বল হয়, মনে আনন্দ হয়। তাই নিজের প্রাণের ভাষাতেই কথা বলতে, গান গাইতে হয়। বুঝলি?
ঠাকুমা বললেন, চড়াইটা অমন কিচিরমিচির কেন করছে রে বুকু? এই বাতাসাটা ওকে দিয়ে দে তো।
তাই তো! ঠাকুমার হাতে বাতাসা ধরা দেখেনি তো বুকু এতক্ষণ! সে বাতাসাটা নিয়ে গ্রিলের বাইরে চড়াইকে দিল। ঠাকুমা ঘর থেকে চলে গেলেন। চড়াই বলল, খাসা বাতাসা রে। শোন, কাজের কথাটা বলে নিই, আবার কেউ এসে পড়বে নইলে।
এই বলে চড়াই ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। বুকুর কাঁধের উপর চড়ে বলল, আজ যেই না সাড়ে সাতটা বাজবে, তুই বাইরের দরজাটা খুলে দিবি। কয়েকটা হনুমান হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে। ঘরের মধ্যে এক্কেবারে হুলুস্থুলু বাধিয়ে দেবে। তার মধ্যে হুব্বা গিয়ে মেন সুইচটা দেবে অফ্ করে। ব্যস, তুই রেডিই থাকবি। এর মধ্যে লরিটা এসে যাবে, আর শালা-জামাইবাবু ষাঁড়েরাও রাস্তায় বসে পড়বে। ব্যস... টুক্ করে উঠে পড়বি লরিতে।
বুকু বলল, হনুমানগুলো আমার বাড়ির লোককে খিমচে-টিমচে দেবে না তো?
চড়াই বলল, আরে না না... তা কেন হবে, ওরা সব আমাদের পাড়ার হনুমান। শিক্ষিত। কেন ওসব করবে? চড়াই বলল, আর আমি বসতে পারব না বুঝলি, তুই সাবধানে থাকবি। ঠিকঠাক থাকবি, হালকা কিছু খাবি... যাতে পেটে...
বুকু বলল, উফ্... তুই যাবি...
বুকুর সত্যি সত্যিই পেটটা একটু মোচড় দিল। একবার যেতে হবে। এটা ভয়ে হচ্ছে। বুকুর অঙ্ক পরীক্ষার দিন সকালেও এরকম হয়। বুকু গিয়ে কমোডে বসল।
একটা টিকটিকি বুকুর সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর সে আরেকটু নেমে এসে বলল, কি দরকার বাপু তোমার নিজেকে এসবের মধ্যে জড়ানো। আমরা শিক্ষিত হই কি করতে? নিজেকে সুখে রাখতে তো? এত বইটই পড়ে মানুষ তাই তো শেখে? তা তুমি এমন আহাম্মকি কাজ কেন করছ বাপু? এত বীরত্ব দেখাতে গিয়ে যদি প্রাণটা যায়? একবার কি হবে ভেবে দেখেছ?
বুকু বলল, তুমি একটা হুমদো, এসব বুঝবে না। পোকা খেয়ে খেয়ে তোমার বুদ্ধিটা পোকার মত এইটুকু হয়ে গেছে। আরশোলার মত বিচ্ছিরি গন্ধ তোমার বুদ্ধিতে। স্বার্থপর।
বুকু আরো কিছু টিকটিকিটাকে বলত, হঠাৎ একজন কেউ পিছন থেকে বলে উঠল, তা বাপু আমাদের তো তোমাদের মত ডিও-মাখা গা নেই। তাই আমাদের গায়ে ওরকম গন্ধ।
বুকু দেখল তাদের সিস্টার্নের পিছন থেকে একটা আরশোলা শুঁড় বার করে কথা বলছে।
অমনি টিকটিকিটা বলে উঠল, তা আর বলতে... তোমাদের গায়ে যা সুন্দর গন্ধ... আহা..., বলতে বলতে সে কয়েক পা এগিয়ে যাচ্ছিল আরশোলাটার দিকে।
বুকু তাড়াতাড়ি মগে জল নিয়ে বলল, খবরদার, এগোবে তো গায়ে জল ঢেলে পুরো ভিজিয়ে দেব কিন্তু... আর নইলে বককে ডেকে সামনে ছেড়ে দেব তোমাকে। বকের পেটের মধ্যে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিও।
টিকটিকিটা অমনি কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, হাত তুলে কথার খোঁটা দাও কেন? আমি কি বলেছি আমার হাত আছে? আমাদের তো সবই পা। আর আমি কি ওকে খেতে যাচ্ছিলাম? আমি তো শুধু একটু যাচ্ছিলাম ওর সাথে আলাপ করতে...
আরশোলাটা বলল, ঢং...
বুকু বলল, তোমরা যাও এখন, তোমাদের কথার জন্য আমার হচ্ছে না...
বুকু স্নান করে একবার পুকুরধারে গিয়ে আবার দাঁড়ালো। হুব্বা ছাদে আছে। আজ আর নামবে না। ওকে ছাদেই খেতে দিয়ে আসতে হবে গিয়ে। হুব্বা ছাদ থেকে বুকুর দিকে হাত নাড়ল। বুকুও হাত নাড়ল।
বুকু পুকুরধারে একটা সিঁড়ির উপর বসে পড়ল। একটা হাঁস এসে বুকুর পাশে বসল।
বলল, তুমি কিছু ভেবো না বুকু। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখো, আমরা ডাঙায় তো বেশিক্ষণ হাঁটতে পারি না, নইলে আমরাও যেতাম।
বুকু বলল, জানি।
তারপর হাঁস আর সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। একটা শুঁয়োপোকা বুকুর পায়ের কাছে এসে মাথাটা তুলল। বুকুর মনে হল ও কিছু বলতে চায় হয়তো। পাশে একটা শুকনো কাঠি পড়েছিল। সেই দিয়ে শুঁয়োপোকাটাকে তুলে নিজের মুখের কাছে আনল।
সে বলল, শোনো বুকু। আমরা সবাই তৈরি। আমাদেরকে পাতার ঠোঙায় করে নিয়ে যাবে চিলের দল।
বুকু বলল, পাতার ঠোঙা? সে কিরকম?
শুঁয়োপোকা বলল, দেখবেই চলো না, বলে সে বাগানের পিছনের দিকে ইশারা করল।
বুকু কাঠিটায় বসিয়ে শুঁয়োপোকাকে নিয়ে বাগানের পিছনের দিকে এলো। এসেই তাজ্জব! সার দেওয়া শুঁয়োপোকার দল বসে চারদিকে। বাবুই পাখির দল ঠোঙা সেলাই করছে আর শুঁয়োপোকারা তার মধ্যে নিজেরাই গিয়ে ঢুকে পড়ছে। বুকুকে দেখে সবাই বলে উঠল, আমরা সবাই রেডি গো। আর শোনো একটা দরকারি কথা। আমাদের পিঁপড়েরা বলেছে আজ মাঝরাতের দিকে নাকি বৃষ্টি হতে পারে। তুমি একটা রেনকোট নিয়ে নিও বুঝলে?
বুকু মনে মনে ভাবল, রেনকোট? আচ্ছা, নিয়ে নিলে হবে। কিন্তু কোথায় রাখা আছে সে তো মনে পড়ছে না। এখনিই যেতে হবে তা হলে। সে শুঁয়োপোকাকে নামিয়ে দিয়ে হুড়মুড় করে দৌড়ালো ঘরের দিকে।
গিয়েই সোজা মায়ের কাছে গেল বুকু। বুকুর মা তখন স্নান করে সদ্য বেরিয়েছেন। বুকু বলল, মা আমার রেনকোটটা কই?
বুকুর মা উঠানে ভিজে শাড়ি মেলতে মেলতে জিজ্ঞাসা করলেন, আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই, এই সময়ে তুই রেনকোট নিয়ে কি করবি?
বুকু হুট করে বলে দিল, আমার একটা রেনকোটের ছবি আঁকার ইচ্ছা হচ্ছে যে।
বুকুর মা বললেন, পাগলী... তুই খেতে বোস। অনেক বেলা হল। আমি রেনকোট বার করে রাখছি।
৫
সন্ধ্যেবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে বুকু। তারপাশে হুব্বা। মা সব বড়ি তুলে নিয়ে গেছেন। তাও ছাদের গা থেকে যেন বড়ি বড়ি গন্ধ। বুকু দেখল সন্ধ্যাতারা উঠল। দূরে কোথাও কোনো গাছে ‘পিউ কাঁহা’ ডেকে যাচ্ছে। আসলে সে বুকুকে জানাচ্ছে সব ঠিক আছে। বাগানের পিছনের দিকটা অন্ধকার। ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবে অল্প অল্প গাছপালা নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে সবাই একে একে জড়ো হচ্ছে। ওদিকে নিশ্চয় জঙ্গলের দলটা এতক্ষণে জঙ্গলের ধারের দিকে এসে জড়ো হয়ে গেছে। একটু পর সব একে একে আসবে ওই শিমূল তলার দিকে।
হুব্বা বুকুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। একটু ভয় পাচ্ছে। জানে বুকু। রাস্তার উপর আলোগুলো জ্বলে গেছে। হঠাৎ একটা প্যাঁচা এসে বুকুর সামনে কার্ণিশে বসল। বুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা সব রেডি আছি, তুমি নীচে গিয়ে একটু তোমার ঘরের জানলার পাশে যাও। একজন অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে।
বুকু তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে এল। আলো জ্বালা হয়নি। এ ঘরটা বুকুর। বুকু আলো জ্বেলে জানলার কাছে যেতেই একটা কুকুর সামনের পা’দুটো জানলার গায়ে তুলে দাঁড়ালো। বুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, শোনো, আমি আমাদের পাড়ার, আমাদের আশেপাশের পাড়ার সবাইকে নিয়ে যাচ্ছি। শুধু তাই নয়, যার বাড়িতে যে যে শক্তিশালী কুকুর আছে সবাই যে যার মত ফাঁক পেলেই বেরিয়ে আসবে। ডোবারম্যান, অ্যালশেশিয়ান অনেক জাতের কুকুর আসছে। আমরা কালকে মিটিং-এ আসতে পারিনি কিছু মনে কোরো না। আসলে লকডাউন চলছে তো, তাই আমাদের অনেকেই খেতে পাচ্ছে না ঠিকঠাক। তাই নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা মিটিং ছিল।
বুকু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সামনের নিমগাছ থেকে একটা কাঠবেড়ালি ছুটে নেমে এসে জানলায় উঠে বলল, হনুমানেরা রেডি, তোমায় জানাতে বলল। তুমি ব্যাগ গুছিয়ে নাও, তারপর কথামত বাইরের দরজাটা কিন্তু খুলে রাখবে। আর একটা কথা, হুব্বা জানে তো কি করে মেন সুইচ অফ করতে হয়?
বুকু মাথা নাড়ল। কুকুর আর কাঠবেড়ালি চলে গেল। হুব্বা খাটের একটা কোণে বসে। বুকু তাড়াতাড়ি স্কুলের ব্যাগটা নামিয়ে ফেলল। কাঁচি, দড়ি, টর্চ, স্ক্রু-ড্রাইভার, লঙ্কার গুঁড়ো, হাতুড়ি, ছুরি, রেনকোট, আর এক প্যাকেট বিস্কুট নিল।
সন্ধ্যে সাতটা। বুকু দরজার কাছটা একবার ঘুরে এল। বন্ধ আছে। এখনই খুলে রাখা যাবে না, তা হলে আবার কেউ এসে বন্ধ করে দেবে। মা ম্যাগী বানিয়ে দিল। বুকু নিজে খেয়ে, হুব্বাকে চারটে কলা আর কমপ্ল্যান খাইয়ে দিল বড় এক মগ। কখন খেতে পায় আবার কে জানে।
দরজাটা খুলতে যাবে হঠাৎ একটা বেড়াল এসে পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, কি হুজ্জুতি করো বাপু।
বুকু বলল, চুপ। অলস কোথাকার!
বেড়াল বলল, বেশ। আমি না হয় অলস, তুমি কোন কাজটা বুদ্ধিমানের মত করতে যাচ্ছ শুনি? যেই না বলেছে এই কথা বেড়াল, অমনি দেওয়াল থেকে দুটো টিকটিকি বলে উঠেছে, ঠিক ঠিক ঠিক।
ওদিকে পিউ কাঁহা জোরে জোরে ডাকছে। মানে হনুমানেরা এসে গেছে। বেড়াল বলল, আমি কিছুতেই হনুমানদের ঢুকতে দেব না, আমায় আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দেবে ওরা ঘরে ঢুকলেই।
বুকু পড়ল মহামুশকিলে। বেড়ালটা বলল, তুমি এগোলেই আমি বিকট চীৎকার করব, সবাই এসে যাবে কিন্তু। বুকু বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল দূরে কোথাও বিদ্যুৎ চমকালো খুব জোর। দেখতে না দেখতেই ঝড় শুরু হয়ে গেল তুমুল জোরে। সাথে সাথেই কারেন্ট অফ। বুকু প্রথমে ভাবল বুঝি হুব্বা বন্ধ করেছে আলো। কিন্তু রাস্তার দিকে তাকিয়ে বুঝল, না কারেন্ট গেছে, রাস্তার সব আলো অফ। বুকু দরজার দিকে এগোতেই বেড়ালটা চীৎকার করতে যাবে হঠাৎ তাকে কেউ ছোঁ মেরে তুলে নিল। বুকু দেখল হুব্বা। বুক দরজাটা দিল খুলে। অমনি হুড়মুড় করে কয়েকটা ষণ্ডামার্কা হনুমান ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। একটা হনুমান হুব্বার হাত থেকে বেড়ালটাকে নিয়ে জোরে পুকুরের দিকে ছুঁড়ে দিল। বেড়ালটা জলে গিয়ে পড়ল ঝপাস করে। বাইরে তুমুল ঝড়। অন্ধকারের মধ্যেই ঘরে একটা প্রায় তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল।
ঠাকুর্দা নিজের ঘরে টর্চ জ্বালতেই দেখে সোফার উপর একটা হনুমান একটা পা আরেকটা পায়ের উপর তুলে জুলজুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠাকুর্দা ‘ওরে বাবা রে’ বলে একটা পেল্লায় হাঁক পেড়ে দরজার দিকে যেতে গিয়ে দেখে দুটো হনুমান স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে, তার দিকে তাকিয়ে, দরজা আগলে।
বাড়িতে হইচই পড়ে গেছে। বুকু পিঠে ব্যাগটা নিয়ে, হুব্বাকে কাঁধে নিয়ে দৌড় বড়রাস্তার দিকে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বড়রাস্তায় পৌঁছে দেখে দুটো বিরাট শরীরের ষাঁড় রাস্তার উপর শুয়ে। বুকু আসতেই একটা ষাঁড় বলল, গুড ইভিনিং বুকু।
বুকু একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, গুড ইভিনিং।
আগের দিনের ষাঁড়টা বলল, আমার শালা আবার খুব ইংরাজি বলে। কাশীতে বড় হয়েছে তো। ওখানে মেলা বিদেশী। ওদের কাছে শিখেছে। তারপর তো আমাদের এই বাংলায় চলে এলো। ওখানে বাঙালী ষাঁড়ের কদর নেই তেমন আর। সবাই হিন্দীতে কথা বলতে বাধ্য করে। তা আমার শালা বলল... কি বললে বলো না হে...
অমনি শালাবাবু ষাঁড় বলল, আই সে, আই নো হিন্দী বোলেগা, মাদার টাং বাংলা হ্যায়, আই গো টু বাংলা, বাংলা বোলনে কি লিয়ে।
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল শালাবাবু ষাঁড়, এমন সময় হঠাৎ করে একটা লরি প্রায় ঘাড়ের উপর এসে পিষে দিচ্ছিল শালা-জামাইবাবুকে। আসলে রাস্তাঘাট অন্ধকার তো। হেডলাইটেও ভালো জোর নেই।
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে বলল, এই উঠো, ইহা কিঁউ শোতা হ্যায়, দেখতা নেহি এই হাইরোড হ্যায়...
শালাবাবু শুয়ে শুয়েই বলল, এখানেও হিন্দী... ওরে মুখপোড়া... হাম নেহি উঠেগা...
ড্রাইভার বলল, কেয়া ঘড়ঘড় করকে ডাকতা হ্যায় রে?
বুকু লরির পিছনে উঠতে উঠতে বলল, ডাকতা নেহি রে, বোলতা হ্যায়...
হুব্বা আর বুকু লরির মধ্যে ঢুকে পড়ল। ভিতরে ভর্তি চাল। ছাদ ঢাকা, আর পিছনেও একটা পর্দা দেওয়া।
লরির মধ্যে ঢুকতেই প্যাঁচারা তারস্বরে চীৎকার শুরু করে দিল। লরি একটু পর ছেড়ে দিল। পর্দাটা একটু ফাঁক করে বুকু দেখল বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, দুটো ষাঁড় তাদের দিকে তাকিয়ে।
হঠাৎ শোনে লরির মধ্যে কিচমিচ আওয়াজ। সাথে সাথেই টর্চটা জ্বালল বুকু। বাপ রে! এত ইঁদুর? সবাই ভিড় করে বুকুর দিকে তাকিয়ে। বুকু লরির মধ্যে বসে পড়ল। একটা ইঁদুর এগিয়ে এসে বুকুর হাতে চুমু খেয়ে বলল, আমরাও চলে এলাম। আমরা এই লরিওয়ালাদের চালের আড়তে থাকি। এতবড় একটা কাজে আমরা কি চুপ করে বসে থাকতে পারি বলো? তাই সবাই চলে এসেছি।
আর একটা ইঁদুর এগিয়ে এসে বলল, তুমি নাকি বাঘ দেখেছ নিজের চোখে? সত্যিই গো?
বুকু বলল, হুম। এসব কথা নিজের মুখে বলতে তার লজ্জা লাগে।
তার কি আমাদের থেকে অনেক বড় শরীর গো?
বুকু বলল, হুম।
একজন বলল, তোমার মত?
তার চাইতেও বড়।
তাই?
আরেকজন বলল, এই চালের বস্তার থেকেও বড়?
বুকু বলল, ওই দুটো চালের বস্তা জোড়ালে যত বড়, তত বড়।
আরেকজন বলল, বড় বড় দাঁত?
বুকু বলল, হুম
অনেক বড় লেজ?
বুকু বলল, হুম
এরকম কথা চলতে চলতে হঠাৎ মনে হল চালের বস্তার পেছনে যেন আরেকজন মানুষ কেউ, বুকু টর্চ জ্বালল। কেউ নেই তো!
বুকু যেই আলো নেভালো অমনি আবার মনে হল কেউ যেন বস্তার পেছনে দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে আলোর মত একটা শরীর এসে বুকুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি রতনদাদু গো... বলেছিলাম না আমার শরীর থেকে ছুটি হয়ে যাবে? দেখো আমার আর কোনো কষ্ট নেই।
বুকু হতবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আলোর শরীরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি অন্যগ্রহে যাবে না?
আলো বলল, যাবো দিদিমণি। তবে কি জানো আমি শরীর থেকে বেরোবার ঠিক আগে বুঝলাম, আমাদের এই পৃথিবীর আড়ালেই সেই সুন্দর পৃথিবীটা আছে। আমাদের পৃথিবীর বাইরেই যা ময়লা পড়েছে, ভিতরটা যেমন তেমনই সুন্দর আছে।
বুকু বলল, তবে তুমি আমাদের সাথে থাকবে?
রতনদাদুর আলো বলল, না গো, আমায় কাল ভোরেই চলে যেতে হবে, তবে আজ রাতটা তোমাদের সাথে থাকব। তুমি খুব সাহসী বুকু। আমি তোমার কাজে গর্বিত। তুমি খুব বড় হবে।
বুকু বলল, তুমি জানলে কি করে আমাদের এই যাওয়ার ব্যাপারটা?
রতন দাদুর আলো বলল, আহা সে আবার শক্ত কথা কি। আমার শরীর ছাড়ার পর আমি একবার তোমায় দেখতে আসছিলাম। তখন দেখি তুমি একটা কুকুরের সাথে কথা বলছ। আমি সবটা শুনে নিলাম। কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না। তারপর কুকুরকে জিজ্ঞাসা করতে সে সব আমায় বুঝিয়ে বলে দিল।
বলতে না বলতেই গাড়িটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল।
বুকু বলল, আমরা এসে গেছি।
সে লাফ দিয়ে লরি থেকে নামতেই চক্ষু চড়কগাছ। চারদিকে থিকথিক করছে পশুপাখি। লরির ড্রাইভার সিটে বসেই কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে এত পশুপাখি দেখে। একটা হনুমান তার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে আর বলছে, আরে ভয় পেয়ো না, তুমি জানোও না তুমি কত বড় কাজে সাহায্য করলে... কেঁদো না... সব ঠিক হয়ে যাবে...
ওদিকে ড্রাইভার হনুমানের কাঁধে মাথা রেখে কেঁদেই যাচ্ছে আর বলছে, রামজি কসম, মুঝে মত খরুচিয়ে... মুঝে মত কাটিয়ে... মুঝে পুরা হনুমান চালিশা আতে হ্যায়... শুনাউ?
এই বলে ড্রাইভার হনুমান চালিশা গাইতে শুরু করেছে, জয় হনুমান জ্ঞানগুণ সাগর... জয় কপিশ তিঁহু লোক উজাগর...
বুকুকে দেখেই সব পশুপাখি উল্লাসে ফেটে পড়ল। চারদিকে হই হই রই রই লেগে গেল। সবাই মিলে এবার মিছিলের মত লাইন দিতে হবে। বুকু সবার আগে এগিয়ে গেল। কাঁধে হুব্বা। তার পাশে হনুমান আর বাঁদরের দল... তার পিছনে শিম্পাঞ্জীর দল... তার পিছনে গণ্ডারের দল... তার পিছনে হরিণ, তার পিছনে ভাল্লুক, তার পিছনে ভোঁদড়, ইঁদুর, খরগোশ, কুকুর, সবার পেছনে জিরাফের দল, আরো কত কত পশু সে বলে শেষ করা যায় না।
বুকু শুনতে পাচ্ছে ড্রাইভার তখনও গেয়ে যাচ্ছে, রাম দুয়ারে তুম রাখবারে... হোত না আজ্ঞা বিনা প্যায়সারে...
বুকু বলল, চলো সব...
সবাই হাঁটা লাগালো। মাথার উপর হাজার হাজার পাখি একসাথে কিচমিচ করে উঠল... সব জন্তুরা একসাথে হুঙ্কার দিয়ে উঠল...
হঠাৎ সারস বুকুর আরেক কাঁধে এসে বসল, বলল, রাজামশায় বলেছেন তোমার এ ঋণ রাজামশায় জীবনে ভুলবেন না।
বুকু বলল, দাঁড়াও গো, এখনি তো কিছুই করিনি...
সারস বলল, যারা যুদ্ধে জেতে তারা তো শুধু জয়ী হয়, যারা বিনা শর্তে যুদ্ধে এসে দাঁড়ায় তারা শুধু জয়ী হয় না, তারা পরমবীর হয়, তুমি পরমবীর বুকু, এই বলে সারস বুকুর গালে একটা চুমু দিল।
বুকু বলল, তোমাদের সাথে মানুষ এত বছর ধরে ঠিক করেনি। এই লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে। আমি মানুষ হলেও আমি তোমাদের পক্ষে। তোমাদের সব তোমাদের ফিরিয়ে দিতেই হবে।
সারস বলল, তুমি নিশ্চয় পারবে।
বুকু দেখল তার সামনে সামনে একটা আলো চলেছে। বুকু জানে রতনদাদু।
৬
খুব জোর জোর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রেনকোটের উপর বৃষ্টির জল চড়চড় করে পড়ছে -- বুকু শুনছে। সারা শরীর শক্ত বুকুর। প্রচণ্ড সাহস বেড়ে গেছে তার। একবার পিছনে ফিরে দেখল, শেষ দেখা যাচ্ছে না এত সৈন্য তার, যেন সমুদ্র। একবার রতনদাদুর দিকে তাকালো। আলোর দাদু সামনে সামনে হাঁটছে তার এখন। আর কিছুটা এগিয়েই ডানদিকে যেতে হবে। একটা বিশাল মাঠ পড়বে। সেই মাঠের শেষে নাকি খাঁচায় করে করে পশুপাখিদের রাখা। মাঝখানের সব চাইতে বড় খাঁচাটা নাকি বাঘের।
সামনেই মাঠটা। রাস্তা, মাঠ -- সব অন্ধকার। বুকু তবু দেখতে পাচ্ছে। তার চোখ যেন তার সঙ্গীসাথীদের মতন জ্বলজ্বল করছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বুকু দাঁড়ালো। অন্ধকারে দূরে মাঠের ওদিকে খাঁচাগুলোর সারি দেখা যাচ্ছে আবছা আবছা। কয়েকবার জোরে বিদ্যুৎ চমকিয়ে গেল যখন তখন স্পষ্ট দেখা গেল। কিন্তু মাঠটা এত বড় বুকু ভাবেনি। বিশাল বড় মাঠ। যেন দুটো ফুটবল খেলা একসাথে হয়ে যাবে।
হঠাৎ একটা হুঙ্কার শোনা গেল মাঠের ওপাশ থেকে। বাঘের হুঙ্কার, বুঝতে বাকি থাকল না বুকুর। এদিকে বুকুর পিছন থেকে সব পশুপাখি একসাথে চীৎকার করে উঠল। মনে হল যেন আকাশের সব মেঘ ভয়ে উড়ে যাবে এমন আওয়াজ শুনে।
বুকু মাঠে পা দিল। কয়েক পা এগোতেই একটা তাজ্জব ঘটনা ঘটে গেল। হঠাৎ করে মাঠের দু’পাশ থেকে দুটো বিরাট ফ্লাড লাইট জ্বলে উঠল। বুকু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাঠটা মুহূর্তে আলোয় আলো হয়ে গেল। পিছনে একটা চাঞ্চল্য অনুভব করল বুকু সবার মধ্যে। বুকু কিছু বলতে যাবে ইতিমধ্যে পাঁচজন ষণ্ডামার্কা লোক বুকুদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে মুখোমুখি দাঁড়ালো। তাদের হাতে স্টেনগান। মধ্যের লোকটা একটা মাইক মুখে নিয়ে বলল, সাবধান... সাবধান... বুকু ও তোমার সৈন্যদের বলছি, যদি আর এক পা-ও এগিয়েছ, ঝাঁঝরা করে দেব সবাইকে গুলি চালিয়ে।
বুকু থমকে দাঁড়িয়ে। রতনদাদুর আলোটাও নড়ছে না। ওপাশ থেকে লোকটা গম্ভীর মোটা খ্যারখ্যারে গলায় আবার বলল, ভালো চাও তো যে যার জায়গায় ফিরে যাও। আমি কাল রাতেই তোমাদের মিটিং নিয়ে সব জেনে গেছি, আমার খবরি আমায় সব জানিয়ে দিল।
বলেই লোকটা অন্ধকারে আকাশের দিকে মাথা তুলে, আ যা... আঃ আঃ... খবরি আ যা..., বলে মাইকে আওয়াজ করল।
দেখতে দেখতে একটা বাজপাখি এসে লোকটার কাঁধে বসল।
বুকু নিজের সাহস আবার ফিরে পেয়েছে। সে চীৎকার করে বলল, কিন্তু তুমি বাঘকে মারতে পারো না...
লোকটা শুনতে পেল না। সে পাশের লোকটাকে ইশারা করল। সে একটা মাইক ছুঁড়ে দিল বুকুর দিকে। বুকু মাইকটা তুলে নিয়ে মুখের কাছে এনে বলল, তুমি বাঘকে মারতে পারো না।
লোকটা বলল, পারি না মানে? কসাই এসে বসে আছে। কাল কাটা হবে। ছাল ছাড়ানো হবে। আমায় একজন কত লাখ টাকা দিয়ে গেছে তুমি জানো? সে তার ড্রয়িংরুমে সাজাবে। এই বাঘকে বাঁচিয়েই বা কি হবে? ও জঙ্গলে গেলে এমনিতেই মরে যাবে, ও কি শিকার করতে জানে? জানে না। আমরাও বা কেন আর খেতে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখব ওকে? ভালো করে খেলাও দেখাতে পারে না আজকাল।
বুকু বলল, তাও তুমি মারতে পারো না কাউকে।
সারস বুকুকে বলল, ওকে বলো যে বাঘ কি করে জঙ্গলে থাকবে সে আমরা বুঝে নেব।
বুকু তাই বলল। লোকটা হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বাজপাখিকে বলল, তুই সব পশুদের বল তো, এই বাঘকে নিয়ে গেলে তাদেরই খেয়ে শেষ করে দেবে। মূর্খ বলেই ওরা বাঘকে ছাড়াতে এসেছে।
বাজপাখি তাই বলল চীৎকার করে।
অমনি সব পাখিগুলো আকাশে গোল হয়ে উড়ে উড়ে বলতে শুরু করল, তুই একটা বেইমান... বেইমান... ছি ছিঃ... বেইমান... বেইমান...
বাজটা কুঁকড়ে গিয়ে লোকটার কাঁধে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল আবার।
বুকু মাইক তুলে হুঙ্কার দিল, রাস্তা ছাড়ো শয়তানের দল... আমরা এগোবো... ওদের পৃথিবীতে ওরা নিজেদের মত বাঁচুক... আমরা ছেড়ে দেব ওদের...
সব লোকগুলো স্টেনগান তুলে তাদের দিকে তাক করল।
বুকু বলল, ছি ছি, কতগুলো অস্ত্রহীন জীবকে মারবে? লজ্জা করে না ভীতুর ডিমেরা?
যে লোকটা কথা বলছিল সে আবার ইশারা করল। একটা লোক মাঠের পিছনে গিয়ে একটু পরে আরেকটা স্টেনগান নিয়ে বুকুর কাছে এসে ওর হাতে দিয়ে চলে গেল।
বুকু ভালো করে দেখল। কিন্তু এটা তো টিভিতে দেখেছে, চালায় কি করে? হঠাৎ হুড়মুড় করে কেউ একটা তার পায়ের কাছে এসে পড়ল। আরে! এ যে সেই ড্রাইভার! সে উঠে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বলল, গোলি মত চালাইয়ে বেটিয়া..., লোকটা কাঁদছে কেন?
বুকু বলল, তুমি যাওনি চাল নিয়ে?
লোকটা আবার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল, হামি বহুত গলত কাম করছিলাম বুকুরাণী... ওই চাওল লক ডাউনমে গরীব আদমি লোগো কে লিয়ে থা। ম্যায়নে উসকো বেচ নে কে লিয়ে যা রহ্ থা... ম্যায় লালচি হো গেয়া...
বুকু বলল, বেশ বেশ... এসব আর কোরো না...
হাঁ তুমকো দেখ কর অচানক ইয়ে মেহেসুস হুয়া... ইয়ে তো ঠিক কাম নেহি... তুম কিতনা বড়া কম কর রেহি হো ইতনি ছোটি উমর মে... ঔর ম্যায়...
লোকটা আবার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। আবার পায়ে পড়ে গেল। আবার উঠল। ওদিকে ওপাশের পাণ্ডা লোকটা মাইকে চীৎকার করে ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, এর মধ্যে তুই কে সিনে ঢুকে পড়লি বাবা শান্তিগোপাল?
বুকু কিছু বলার আগেই সব পশুগুলো, পাখিগুলো অদ্ভুত আওয়াজ করে চীৎকার করে উঠল... যেন মানুষের মত বলছে -- হা রে রে রে...
সেকি আওয়াজ! বুকু দেখল মাঠের ওদিকের অন্ধকারের দিক থেকে একপাল ষাঁড় লেজ তুলে লোকগুলোর পিছন দিক থেকে ছুটে আসছে... সেকি দৌড়...!!!
লোকগুলো আওয়াজ পেয়ে পিছনে ঘুরে তাদের দিকে স্টেনগান তাক করার আগেই ষাঁড়েরা হামলে পড়ল তাদের উপর। ফুটবলের মত শিং-এ করে লোফালুফি খেলতে শুরু করল লোকগুলোকে নিয়ে। কুকুরের দল তাদের ঘিরে বিকট ডাকতে লাগল। যেই ওরা মাটিতে পড়ে গেল অমনি কুকুরেরা গিয়ে তাদের হাত কামড়ে স্টেনগানগুলো নিয়ে হনুমানদের দিয়ে গেল। তারপর একগাদা বাঁদর তাদের মাটিতে শুইয়ে আচ্ছা করে কাতুকুতু দিতে শুরু করল। তারপর পাখিরা পাতার ঠোঙায় ভরা শুঁয়োপোকা তাদের গায়ে ছেড়ে দিতে শুরু করল। লোকগুলো প্রাণপণে ছটফট করতে করতে বলতে শুরু করল, আর করব না রে... আমাদের ছেড়ে দে রে... ওরে অ বুকু... আমার প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে খাঁচার সব চাবিগুলো নিয়ে যা রে... শুধু আমায় ছেড়ে দিতে বল...
তারা এই বলে একবার হাসে, একবার কাঁদে, একবার উঠে বসে, আবার শুয়ে পড়ে। সে কি কাণ্ড!
বুকুর ইশারায় হুব্বা গিয়ে লোকগুলোর পকেট থেকে চাবির গোছা নিয়ে চলে এল। বুকু চাবির গোছা মাথার উপর তুলে, চলো বন্ধুরা.বলে মাইকে হুঙ্কার ছাড়ল...
সব পশুপাখি ছুটল বুকুর পিছু পিছু খাঁচাগুলোর দিকে। প্রথমেই বাঘের খাঁচায় গেল। বাঘের খাঁচার চাবিটা সবচাইতে বড়। তাকে খাঁচা থেকে বার করল। সব পশুপাখি আবার ফুর্তিতে চীৎকার করে উঠল। একে একে ভাল্লুক, অনেকগুলো হনুমান, নানারকম পাখি, একটা হাতি --- সব ছাড়া পেল।
বাঘ স্থির চোখে বুকুর দিকে তাকিয়ে। তার চোখে জল। বুকুর চোখেও জল। বুকু কত কি বলবে বাঘকে এই দু'দিন ধরে ঠিক করেছিল মনে মনে, কিচ্ছু বলতে পারল না সে। বাঘের ঘাড় জড়িয়ে ধরে শুধু তাকে একটা চুমু খেল।
মাঠে তখন সে কি আনন্দ। হঠাৎ রতনদাদু এসে বলল, বুকু, আমার ভাই, মানে তোমার বিশুদাদু গাড়ি নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাও নইলে এরপর সবাই থানায় চলে যাবে তোমায় খুঁজতে। একটা বিপদ হবে।
বুকু ভাবল সত্যি। সবাই যদি এখানে চলে আসে আবার একটা গণ্ডগোল হতে পারে। বুকু কাউকে কিছু না বলে ধীরে ধীরে মাঠের বাইরে এসে দেখে সত্যিই বিশুদাদু দাঁড়িয়ে। সে গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় সারস তার কাঁধে এসে বসল। বলল, তোমার কাছে আমরা সবাই ঋণী হয়ে থাকলাম বুকু।
বুকু সারসের ঠোঁটে একটা চুমু খেল। সারস বলল, তুমি ভীষণ সাহসী, বন্দুক দেখেও ভয় পেলে না?
বুকু বলল, বা রে, আমি না লিডার, আমি ভয় পেলে চলে?
রতনদাদু হেসে বলল, বেশ বেশ গাড়িতে ওঠো এবার।
বুকু আর হুব্বা গাড়িতে উঠল। বুকু রতনদাদুকে বলল, আমাদের সাথে বাড়ি অবধি চলো প্লিজ, তারপর চলে যেও।
রতনদাদু বলল, বেশ।
গাড়ি চলতে শুরু করল। বুকু তার ভিজে রেনকোট আর পিঠের ব্যাগটা পাশে সিটে রেখে দিয়ে বলল, আচ্ছা দাদু, ওই ড্রাইভারটা কোথায় গেল?
রতনদাদু হো হো করে হেসে বলল, আরে আমিই তো ওকে ওইসব শিখিয়ে তোমার সামনে পাঠিয়েছিলাম। ও তো আমাদের পিছনে পিছনেই আসছিল। সব দেখে খুব মজা পেল। তারপর ওদের হাতে বন্দুক দেখেই আমার মাথায় এই বুদ্ধিটা খেলে গেল। আমি ষাঁড়গুলোকে বললাম, যা তোরা এই ফাঁকে পিছনের দিকে চলে যা। আমি ইশারা করলেই তোরা দৌড় লাগাবি।
বুকু বড় বড় চোখ করে বলল, তাই?
বুকুর বাড়ি চলে এল। সবাই গাড়ি থেকে নামল। বুকু রতনদাদুকে ছুঁলো। বিশুদাদু রতনদাদুকে বলল, ‘দাদা যাস না রে...’, বলে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। বুকু বিশুদাদুকে জড়িয়ে বলল, তুমি কেঁদো না দাদু, ওনাকে যেতে দাও। আমার দাদুও বলেছে, যেতে দিতে হয়। নইলে কষ্ট হয়। আমরা সবাই তো তোমার জন্যে থাকলামই বলো?
বিশুদাদু বুকুকে জড়িয়ে কাঁদল। বুকুও কাঁদল। তারপর ‘ভালো থেকো পারমিতা’, বলে বিশুদাদু চলে গেল। রতনদাদুও মিলিয়ে গেল।
ভোরের আলো ফুটছে। হুব্বা আর বুকু ঘরে ঢুকে দেখে সব হনুমানগুলো মেঝেতে বসে আছে আর বাবা, মা, ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, পিসি -- সবাই খাটে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। বুকু ভিজে রেনকোট আর ভিজে ব্যাগটা মেঝেতে রেখে দিল।
তারা ঢুকতেই একটা হনুমান লাফ দিয়ে এসে বুকুর সামনে স্যালুট ঠুকে বলল, আমরা আসি ম্যাডাম। কিছু দরকার লাগলেই বলবেন। এই বলে সব হনুমানগুলো টুক টুক করে বেরিয়ে যেতে লাগল। শেষের হনুমানটা হুব্বার কাছে গিয়ে যেই না বলতে গেছে, এই যাবি আমাদের সাথে? অমনি হুব্বা বলে উঠেছে, দূর হ মুখপোড়া!
বুকু চমকে গিয়ে হুব্বার দিকে ফিরে বলল, তুই কথা বলতে পারছিস?
হুব্বা নিজেও অবাক। সে আনন্দে বুকুর গলা জড়িয়ে বলল, তাই তো...! তাই তো...!!
অমনি বুকুর মা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুই কি মেয়ে মোগলি হয়ে গেলি রে বুকু? তারপর বুকুর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানতাম এত কার্টুন দেখার ফল মেয়ের ভালো হবে না... ওগো আমাদের কি হবে গো...
কাঁদতে কাঁদতেই মা দেখল বুকু আর হুব্বা মেঝেতেই ঘুমিয়ে কাদা।
সমাপ্ত
[ছবিঃ সুমন]