মন বলে কিছু হয় না। বাসনা জাগলে মন। ইচ্ছা জাগলে মন। তৃষ্ণা জাগলে মন।
গোঁসাই চাতালে বসে। চাতালে ধাক্কা খাচ্ছে জোয়ারের জল। এখন বিকাল। গরমের বিকাল। গোঁসাইয়ের একতারাটা গোঁসাইয়ের পাশে রাখা। গঙ্গার হাওয়ায় গোঁসাইয়ের পরনের কাপড়ের খুঁটো উড়ে উড়ে গিয়ে লাগছে একতারার গায়ে।
চোখের বাইরে কোনো সত্য নেই। চোখের বাইরে শুধু ঘটনা আর বস্তু। সত্য দেখে বুদ্ধি। মন দেখে ঘটনা আর বস্তু। শরীর মানে সময়। বুদ্ধি সময়ের সাক্ষী। মন সময় স্রোতের ঢেউ। স্মৃতি মানে মানুষের ইতিহাস। মানুষের পরিচয়।
একটা বক উড়ে এসে একতারার পাশে এসে বসল। আকাশে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঝড় উঠল। জলের ঢেউ দেখতে দেখতে চাতালের কয়েকটা সিঁড়ি ছাপিয়ে উঠতে চেষ্টা করল। স্পর্ধা। ঝড়ের আবেশে স্পর্ধা বাড়ে। মানুষেরও বাড়ে। বাসনার ঝড়। মোহ মেঘ। তৃষ্ণার বিদ্যুৎ। অহমিকার গর্জন – বাজ। অনেক কিছু পুড়িয়ে তছনছ করেছে।
“গাইবে না গোঁসাই?”
গোঁসাই গাইছে,
“বাদল দেখ ডরি হো শ্যাম ম্যায় বাদল দেখ ডরি
শ্যাম ম্যায় বাদল দেখ ডরি
কালি-পিলি ঘটা উমড়ি বরসো এক ঘরি
শ্যাম ম্যায় বাদল দেখ ডরি
জিত জাউ তিত পানি পানি হু ভোম হরি
শ্যাম ম্যায় বাদল দেখ ডরি
জাকা পিয়া পরদেস বসত হ্যায় ভিজু বাহর খরি
শ্যাম ম্যায় বাদল দেখ ডরি
মীরা কে প্রভু হরি অবিনাশী কিজো প্রীত খরি
শ্যাম ম্যায় বাদল দেখ ডরি”
ভীষণ বৃষ্টি। সমস্ত আকাশ যেন ভেঙে পড়বে। সমস্ত পৃথিবী যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। গোঁসাই তন্ময় হয়ে নিজের সুরে, নিজের হৃদয়ে। গোঁসাইয়ের মনের মধ্যে যে রাজ্য সে রাজ্যে প্রবেশের অধিকার নেই আমার। আমি চোখ বন্ধ করে দিলাম। আমার বন্ধ চোখে বর্ষা। মাথার মধ্যে শব্দের রাজ্য। বাসনার ফাঁদ। কত চাই মন তোমার? আর কত চাই? আর কি কি চাই? মন নিজেকে জানো? মন নিজেকে নিজে বোঝো? তুমিও বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছ, মীরার মত। তবে প্রেমের জন্য না, তুমি নিজের বাসনায় নিজেই নির্বাসিত নিজের হৃদয় থেকে। তোমার সুখ কোথায় মন? তুমি বুকের মধ্যে যাদের বসিয়েছ তারা তোমায় শান্তি দিল? তোমাকেই তাড়ালো। তোমার প্রীতম কোথায় মন? তোমার ভালোবাসা?
“সমস্ত পুড়বে যখন তখন কি কিছু বাকি থাকবে গোঁসাই?”
গোঁসাইয়ের তর্জনী আকাশের দিকে। আঙুল তুলে গোঁসাই বলল, ভাগ্যের ঘায়ে কাঁদবে? না ভাগ্যকে কাঁদাবে?
“ভাগ্যকে কাঁদানো যায় গোঁসাই?”
যায়, যদি ধরা দাও। যদি বলো, আমি রাজী। যদি বলো, এই তো আমি।
“আমি কি রাজী নই?”
না। তুমি ভাগ্যকে লুকিয়ে বাঁচো। মুখোমুখি হও না। মিথ্যা ভগবানের নাম জপ, ভাগ্যের সঙ্গে মিথ্যা ভগবানকে লড়িয়ে বাজি ধরো জীবনের। হয় না। বারবার হারো। বারবার পালাও।
“তবে কি অদৃষ্টবাদী হব?”
ভাগ্যকে প্রতিপক্ষ করতে বারণ করেছি, চালক করতে তো বলিনি।
“তবে কে হবে আমার চালক?”
সত্য।
“সত্য কি?”
যার অস্তিত্ব আছে। তাই যার সীমা আছে।
“তোমার ঈশ্বর যে অসীম গোঁসাই, সে কি সত্য নয় তবে?”
সমস্ত সীমা নিয়ে, সমস্ত সীমার মর্যাদার যিনি রক্ষাকর্তা তিনিই অসীম। সীমা হারিয়ে যে অসীমত্ব সে শুধুই অলীক।