Skip to main content

বাবার চটি মানে মেঝের উপর রাখা নৌকা যেন। সামনের দিকে বুড়ো আঙুলটা ঢোকানোর জায়গা, যার উপর অর্ধেক গোল, তার থেকে কালো একটা ফিতে এসে চটির মাঝখানে, যেখানে নৌকার ছাউনির মত কালো একটা ছাউনি। পাশে রাখা আমার চটি, কত ছোটো! বাবার চটি বাবার মতই গম্ভীর, কেল্লার মত নিরাপত্তা। মাঝে মাঝে বাবার চটিতে পা গলালে আমার পায়ের অর্ধেকটাই ঢুকে যাচ্ছে নৌকার মত সেই ছাওনিতে। যেন চটিটা বলছে, এখনও সময় হয়নি তো।

বাবার চটি কত জায়গা ঘুরে এসেছে। আসে। আপিসে যায়, দেশ-বিদেশ যায়। আমার চটি তো স্কুলে যায়, এ পাড়া ও পাড়া যায়, মাঝে মাঝে মামাবাড়ি যায়, অথবা কোনো আত্মীয়ের বাড়ি। আমার চটির কত শাসন। বাবার চটির কোনো শাসন নেই। গেলেই হল। যত দূর রাস্তা, চটি চলে যায় ততদূর। আমার চটি পাশে রাখা, গল্প শোনে বাবার চটির কাছে, রাত হলে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে।

ক্রমে আমার পা বড় হল। বাবার চটিতে পা গলে গেল। পায়ের পিছনের দিকে আর চটি বাকি নেই, আগের মত। পায়ের গোড়ালি চটির সীমানা ছুঁয়ে। তবু কতটা বাকি। কত কিছুই যেন বাকি। সে বাকিতেই তখন আরাম। স্বস্তি।

ক্রমে বাবার চটি সীমাবদ্ধ হল। শোয়ার ঘর, বারান্দা… আর যায় কই? মাঝে মাঝে বাথরুমের চটির সঙ্গে ঘরের চটি যাচ্ছে গুলিয়ে। ঠিক করে দিয়ে আসছি। অশক্ত শরীরে, কাঁপা কাঁপা পায়ে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকছে। চেম্বারের বাইরে চটি রাখা থাকছে। চটি খুলতে পরতে কত সময় লাগে এখন। কাঁপা কাঁপা পায়ে চটির ছাওনিতে পা ঢুকতে কত ধৈর্য, অপেক্ষা। চেম্বারের বাইরে আমার চটির পাশে বাবার চটি রাখা। এখন আমার চটির বড় দায়িত্ব, আগলে রাখার। বাবার চটি দুষ্টুমি করে। তাকে শাসনে রাখা, তাকে জায়গায় রাখা, পরিষ্কার রাখা। যায় না বেশিদূর, তবু সামলে রাখা।

মায়ের শেষ চটিটা যত্ন করে তোলা। আর তো লাগবে না চটি। যেখানে গেলেন সেখানে তো চটি লাগে না। এখন ধুলোহীন সে চটি, প্লাস্টিকে মোড়া। বড্ড শান্ত। বড্ড বিষণ্ণ। রাস্তার ধুলো না লাগলে চটির বড্ড মন খারাপ হয়।

এক বাচ্চা এলো বাড়িতে। তার ছোট্টো চটি খুলল বারান্দায়। সে ঘুমালো। আমি তার ছোট্টো চটিটা হাতে নিয়ে আমগাছের তলায় এসে দাঁড়ালাম। বোল এসেছে। অল্প অল্প গন্ধ ছড়িয়েছে বাতাসে। ছোটো চটিটার নীচে ধুলো লেগে। দুষ্টুমি লেগে। কোথাও বাবার চটির মত।

মহাপুরুষদের ব্যবহার করা চটি দেখেছি কত যত্নে রাখা থাকে মিউজিয়ামে। রামকৃষ্ণদেবের, শিরডির সাঁইবাবার…. দেখেছি। তাঁদের কথা আলাদা। আমাদের কথা অন্যরকম। আমাদের ফেলে যাওয়া চটিগুলো পরকালের তরণী নয়, এ কালের চোখের জলের স্মৃতি। সে চটির কাছে আবদার আছে, ভালোবাসা আছে, স্নেহ আছে। যন্ত্রণা আছে। চরম দুর্ভাগ্যে ছোটো চটিও স্মৃতি হয়েছে। আলমারিতে লকারের মধ্যে রাখা, তাও তো দেখেছি। নরম তুলতুলে দুটো পাকে সে মনে রেখেছে। আর রেখেছে যারা তাকে ভালোবেসেছিল।

আমের বোল ঝুরেঝুরে মাটিতে পড়ছে। বাচ্চার চটিটা আবার যথাস্থানে রেখে দিলাম। অনেক চটি রাখা বারান্দায়। অনেকের। সব চটিতেই একটা মানুষের গল্প থাকে। জীবনের গল্প। নিজে ক্ষয়ে ক্ষয়ে সে সেই গল্পগুলো জমায়। হারিয়ে যাবে বললেই হারিয়ে যায় নাকি? যে শুনতে চায়, সে ঠিক শুনতে পায়।