Skip to main content

সকালে বাবার ঘরে ঢুকতেই বাবা মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন। সে ক্ষণিক দৃষ্টিতেই বুঝলাম বাবার চোখে জল। মনে পড়ল, আজ 6th জুন। বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী। জিজ্ঞাসা করলাম না কিছু। ফিরে আসলাম নিজের ঘরে।
বছরের তিনশ তেষট্টি দিন মায়ের অভাব অনুভব করলেও, এই দিনটাই কিছু অন্যরকম লাগে। এইদিন যেন তিনি শুধু আমার মা নন, আরেকজন মানুষের চলার সাথী ছিলেন - এই পরিচয়টাই বড় হয়ে আসে মনের মধ্যে। শুনেছি বিয়ের দিন নাকি তুমুল ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। বিয়ের প্যাণ্ডেলই নাকি প্রায় পড়ো পড়ো হয়ে গিয়েছিল। মায়ের মুখে শুনেছি বহুবার সে গল্প। খুব মজা পেতেন গল্পটা বলতে গিয়ে মা। তার একটা বড় কারণ বোধহয়, সেই একদিনই তুমুল ঝড় হয়েছিল তাঁর বৈবাহিক জীবনে। আর হয়নি। তাই সে ঝড়ের গল্পে এত মজা ছিল, ক্ষোভ ছিল না।
হঠাৎ করে হাত ছেড়ে গেল, যে হাতদুটো ছাড়তে চাননি। যে মানুষটা সর্বান্তকরণে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়েও কোনো ঈশ্বরের কাছেই যেতে চাননি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত। বাবার কাছেই থাকতে চেয়েছিলেন। তাঁকেই সর্বস্ব জেনেছিলেন। সবটুকু ভালোবাসা, জীবনের সিংহভাগ বর্ষা-বসন্ত যে ঘর তৈরি করতে দিয়ে গেলেন, তাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাওয়া যায়?! তবু যেতে তো হলই। প্রাণের একটা গভীর বাসনা ছিল, বাবাকে রওনা করে নিজে যাবেন খানিক পরে। কারণ, "তোর বাবা একা থাকতে পারে না, ও নিজের খেয়াল রাখতে পারে না...." আজও কথাগুলো এ দেওয়াল সে দেওয়াল মাথা কুটে মরে। ব্যর্থ হয়ে ফেরে।
মানুষের জীবনে দুঃখের অন্ত নেই। যন্ত্রণার শেষ নেই। আজ যে মানুষটা একা রয়ে গেল, বয়সের ভার আর বিচ্ছেদ-যন্ত্রণার ভার যে অসহ অবহ করে তুলেছে তার বেঁচে থাকাটাকে, তার সান্ত্বনা কোথায়? কার কাছে? স্মৃতির ঝাঁপি সারাদিনের সাথী। একই কথা, একই গল্পের পুনরাবৃত্তিতে বুঝি, সেগুলো বাইরের বিশ্বের কাছে নিছক গল্প হলেও, তার অন্তলোকে তা গল্পের থেকেও অনেক বেশি, তার অবলম্বন।
মাঝে মাঝে মনে হয়, তার কি কোনো ক্ষোভ হয়, কিছু অদেয় রয়ে গেল কি? কিছু প্রতিজ্ঞা অপূর্ণ থেকে গেল কি? কিছু কথা বলা বাকি রয়ে গেল? চকিতে ঝোঁকের বশে করা কোনো রুঢ় আচরণ কি এখনও মনে পীড়া দেয়? দেয় হয়তো। বহুদিন আগে এমন একজনের কথা লিখেছিলাম। সেই বর্ষীয়ান মানুষটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাড়ির সবাই পুরী গেল, আপনি গেলেন না? বুঝিনি তার বুকের কোন দুর্বল তন্ত্রীতে অজান্তেই হাত দিয়ে ফেলেছি। সিক্তচোখে বলেছিলেন, "সংসার করেছি খুব দারিদ্র্যতায়, আমার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে এই সংসারের জোয়াল টেনেছিল। ছেলেমেয়েগুলো যখন মানুষ হল, দাঁড়িয়ে গেল, তার সময় ফুরিয়ে গেল। ওর বড় সাধ ছিল জানেন, পুরী যাবে, সমুদ্রে স্নান করবে, জগন্নাথ দর্শন করবে। হল না। পারিনি আমি নিয়ে যেতে। তাই সেদিন যখন বড় খোকা বলতে এল, বাবা পুরী চলুন আমাদের সাথে, বললাম তোরা যা বাবা, আমায় ছেড়ে দে।
আপনি বলুন, পারব আমি তাকে ছেড়ে জগন্নাথের সামনে দাঁড়াতে? পারব না। সে হয় না।"
সত্যিই হয় না। যদি হত তবে আমি ঈশ্বরের ঐশ্বর্যে হয়তো বা বিশ্বাস করতুম, মাধুর্যে না। যে ভালোবাসায় আমি-তুমি, হার-জিতের হিসাব থাকে, তাকে উৎকৃষ্ট মানের ব্যবসা বলতে আপত্তি নেই, তাকে ভালোবাসা বলি কোন মুখে? সে ভালোবাসা বাসতে না পারি, অন্তত তার উপর শ্রদ্ধাটা রাখি। সংসারে নারী-পুরুষ, কার কি রকম দায়িত্ব, কতটা মিল-অমিল - সে তর্কে যেতে চাই না। শুধু উপলব্ধি করি সংসারে নারীর ভালোবাসার ক্ষমতা বা ধারা, আর পুরুষের ক্ষমতা বা ধারা এক প্রকার না। তা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর দরকার নেই। নিজের মায়ের মুখটা মনে পড়লেই তা অনুভূত হয়। নারী সম্পূর্ণ নারী হোক, পুরুষ হোক সার্থক পুরুষ। একে অন্যের অনুকরণ করাকেই আধুনিকতা ও উন্নতি বলে চালানোটা নিতান্তই উত্তেজক আলোড়ন, অনুর্বর, নিষ্ফলা। যদি আগাছাকেও ফসলের মধ্যে ধরি তবে তা আলাদা কথা অবশ্য।
এসব তর্ক, যুক্তির বাইরে এসে যখন একা হই, তখন নিজের মনের মধ্যে তাকিয়ে দেখি একটা ভয়, আমারও বুকের কোণে আমারই সাথে চলেছে। যে মানুষটার সাথে হাতে হাত রেখে চলি, তার বিচ্ছেদ সইতে পারি এমন পাথরের আড়ত বুকে মজুত আছে কি? পরক্ষণেই সে ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মনকে বলি, না না, এসব ভাবনা না। বরং তাকে ভালোবেসে নিই, আরো আরো ভালোবেসে নিই, যাতে যেই আগে যাই না কেন, কোনো ক্ষোভ যেন না থাকে। ভালোবাসা পাওয়ায় কম হলে আপত্তি নেই, ভালোবাসা দেওয়ায় যেন কোনো ফাঁকি না থাকে। তবেই শান্তি।