Skip to main content
বাঁক



---

চট করে আমি হ্যাঁ বলি না তো তুমি জানো, রীতা টিভিটা মুছতে মুছতে বলল। পল্লবী কিছু না বলে স্নানে ঢুকে গেল। কলেজে বেরোবে।
    উলুবেড়িয়ায় এসেছে ওরা বছর চারেক হল। আগে ঘুষুড়িতে থাকত। পল্লবীর বাবা যোগেন জোগাড়ের কাজ করত। অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না। তার ওপর রীতার হার্টের অসুখ। একবার টিবিও হয়েছিল। কোনো রকমে বেঁচে ফিরেছে।
    উলুবেড়িয়ায় রীতাদের দুঃসম্পর্কের এক মামা থাকতেন। বিয়ে করেননি। তিনি মারা যাওয়ার আগে এই বাড়িটা রীতার নামে লিখে গেছেন। বাড়ি বলতে তিনটে ঘর, আর সামনে একটু উঠোন। এখানে এসে যোগেন একটা মুদিখানার দোকানে কাজ পেয়েছে। মাস গেলে দেড় হাজার দেয়। পরে বাড়াবে বলেছে।
   পল্লবীর সেকেন্ড ইয়ার হল। টিউশান করে চালিয়ে নেয়। প্রদীপই যোগাড় করে দিয়েছিল টিউশানগুলো। প্রদীপের সাথে আলাপ কলেজেই। প্রদীপের জুলজি, ওর ভুগোল। প্রদীপকে তার ভাল লাগে। কিছু বলে না। বলতে নেই ওর। প্রদীপের বাবা এখানকার খুব নাম করা ডাক্তার, হিরণ্ময় মুখার্জী। প্রদীপের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক ভাল না। হিরণ্ময়বাবুর ইচ্ছা ছিল, প্রদীপ ডাক্তারী পড়বে। প্রদীপ চায়নি। এসবই পল্লবীর প্রদীপের মুখে শোনা। পল্লবী এও জানে, প্রদীপ তাকে পছন্দই করে। তবু...
    পল্লবী কলটা খুলে বালতি ভরতে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্যমনস্কভাবে নিজেকে দেখে। ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরের আলো তার শরীরের ওপর এসে পড়েছে। কিন্তু ঘুলঘুলিটা আজ যেন অনেকটা বড় লাগছে তার কাছে।



---

বান্টি ঘুষুড়িতে একটা ছোটখাটো গেঞ্জির কারখানায় কাজ করে। বয়সে পল্লবীর থেকে বছর ছয়েক বড় হবে। যোগেনের সাথে চায়ের দোকানে আলাপ। তারপর বাড়ি আসে একদিন। পল্লবীর প্রথম দিন থেকেই বিরক্ত লেগেছিল। কেন সেটা বুঝতে পারেনি প্রথম প্রথম। পরে বুঝেছিল, ওর দৃষ্টিটা আর হাঁটাচলার ভঙ্গীটা তার খুব ইঙ্গিতপূর্ণ মনে হয়েছিল।
     সে যে ঠিক, সেটা বুঝতে পেরেছিল চার-পাঁচমাস পরেই। সেদিন বাবা-মা কেউ বাড়ি ছিলনা। বাবা কাজে আর মা দক্ষিণেশ্বরে পূজো দিতে গিয়েছিল পাড়ার কতগুলো কাকিমার সাথে।
    বেলা এগারোটা নাগাদ হঠাৎ বান্টি এসে হাজির। পল্লবী ঢুকতে দিতে চায়নি। ভীষণ মাথা ধরেছে, এক কাপ চা খাওয়াবে, বলে বান্টি তার দিকে এমন তাকালো, এখনো তার ভাবতে গা শিউরে ওঠে। তারপর একরকম জোর করেই ঘরে ঢুকে, সোজা শোয়ার ঘরে এসে খাটে বসে পড়ে। পল্লবী চা বসায়, শুনতে পায় সে শিস দিয়ে একটা বাংলা সিনেমার গানের সুর ভাঁজছে। পল্লবীর বিরক্ত লাগে। মনে হয় এখনি গিয়ে ওকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেয়।
    পারবে না। সে নিজেও জানে সে পারবে না। বাবাকে এখন ধার দেওয়ার মধ্যে ওই এক বান্টি। তাই তার জোর করে ঢোকাকেও আটকাতে পারেনি, প্রাণের ভিতর থেকে চাইলেও।
   সে চা নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে বান্টি রীতিমত বিছানায় শুয়ে। জামা খুলে খাটের বাটামে রাখা। একটা নোংরা, ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে।
-তুমি কিছু মনে করলে না তো, আসলে যা গরম! ফ্যানটা এর থেকে আর জোরে হয় না, না?, বলে সে ইচ্ছা করেই একরকম পল্লবীর গা ছুঁয়ে সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল। পল্লবীর কান মাথা রাগে, অপমানে ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করছে। সে জানলার দিকে কঠিন মুখ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
    বান্টি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে খাটে বসে, পা দুলাতে দুলাতে বলল, তোমার মাই দুটো হেভি সুন্দর জানো।
   পল্লবীর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, ঘামছে, কাঁপছে, তবু কিছু বলার মত শব্দ মুখ থেকে বেরোল না।
-আমি তোমার মায়ের এ মাসের সব ওষুধের টাকা দিয়ে গেছি, সামনের মাসেও দেব, তুমি কিছু ভেবো না। হেভি ফিগার তোমার। আমার এক কাকা মডেলিং-এ ছবি তোলে। কিছু ছবি পাঠাতে পারবে? এসব পড়াশুনা করে কি হবে! নিজেকে বাজারে ছেড়ে দাও। তারপর দেখো....
   পল্লবীর আর বিশেষ কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, যাওয়ার আগে সে একবার তার পাছার একটা দিকে হাত বুলিয়ে চলে গিয়েছিল। ডান দিক না বাঁ দিক, মনে করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু মনে করতে পারে না। ব্যস আর কিছু করেনি সেদিন।
   প্রথমে ভেবেছিল মা'কে ঘটনাটা জানাবে। তারপর মাথাটা ঠান্ডা হওয়ার পর বুঝেছিল মা'কে বলে লাভ নেই। মানুষের অবচেতন মন অনেক কিছুর আভাস আগে থেকেই মনকে দিতে থাকে। সাবধান করে। তাকেও সাবধান করেছিল। তাই এত কিছুর পরেও তার মন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে। সে তো জানতই যেন এটা হবে।
   মা ফিরেছিল সন্ধ্যের একটু পরে।
-কি রে আলো জ্বালিসনি কেন? সন্ধ্যে দিসনি?, বলতে বলতে রীতা বারান্দার আলোটা জ্বালল।
-বান্টি এসেছিল।
   রীতার মুখটা এক মুহুর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কিন্তু সেটা চাপা দিয়ে, রীতা শাড়ি ছাড়তে শুরু করল, জানিস আজ দক্ষিণেশ্বরে কি কান্ড, তোর ফুলমাসির সাথে দেখা....
   পল্লবী শুনছিল না। ফুলমাসি দক্ষিণেশ্বরেই থাকেন। প্রতিবারই মায়ের সাথে দেখা হয়। এটা কোনো কথা না। সে রীতার বুকের দিকে তাকালো, বান্টি কি মাকেও বলেছে, কাকিমা আপনার.......



---

আজ বান্টি আসবে। মা আসতে বলে দিয়েছে। সেই বারের পর মায়ের দক্ষিণেশ্বরে যাওয়া বেড়ে যায়। বান্টির আসা শুরু হয় ফাঁকা বাড়িতে। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও পল্লবী মানিয়ে নেয়। সেই প্রথম সে নিজের চোখে কন্ডোম দেখে। বান্টির সেই কাকার কাছে যাওয়ার আগে, বান্টি তাকে নিজের পয়সা, সময় খরচ করে তৈরী করে নিচ্ছে, আর সেটা সব মেয়ের ভাগ্যে জোটে না, এই সৌভাগ্যটা সে মেনে নিয়েছে। কিন্তু তার অকৃতজ্ঞ মনের জন্য তার মায়ের মাথা হেঁট হয়ে যায় বান্টির সামনে। তাই নিয়ে মাঝে মাঝেই তুলকালাম চেঁচামেচি হয়। তারপর দুজনেই কাঁদে। যেন এই কান্নাটাই ঝগড়ার আসল উদ্দেশ্য।
    বাড়িতে আসবাব বাড়ে। সপ্তাহে চারবার করে মাছ, রবিবার করে মাংস হয়। রীতার চেহারাটা ফেরে, বুকের ব্যাথাটা হয় না এখন। যোগেনের নেশা করার হার বেড়ে যায়। ঘুষুড়ির জীবনটা এরকই ছিল শেষের দিকে।
   এরপর তারা হঠাৎ করে উলুবেড়িয়ায় চলে আসে। বান্টি অনেক বারণ করেছিল। সেই প্রথম পল্লবী খুব জেদি হয়ে ওঠে। সে যাবেই যাবে। কেউ না গেলে একাই যাবে। রীতাও জমি জায়গার লোভটা ছাড়তে পারে না। অগত্যা আসাটা হয় শেষমেশ।
   এতগুলো বছর বেশ চলছিল। পল্লবী ভেবেছিল বান্টি অন্য শিকার পেয়ে গিয়ে থাকবে এতদিনে। প্রথম প্রথম কয়েকদিন এসেছিল যদিও, কিন্তু নতুন জায়গার মোহেই হোক, বা কিছু পাওয়ার আনন্দেই হোক, যোগেন কাছে ঘেঁষতে দেয়নি বান্টিকে। রীতারও একটা সায় ছিল।
   কিন্তু মোহ বা উচ্ছ্বাস কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী নয়। যে জীবনযাত্রায় অভ্যাস করে দিয়েছিল বান্টি, সেটা ছেড়ে থাকাটা যে যোগেন আর রীতার কাছে অসম্ভব হয়ে উঠছে, তা টের পাচ্ছিল পল্লবী। ওই যে বললাম, মানুষের অবচেতন কিছুর একটা ইঙ্গিত আগে থেকে পায়। এবারও সে পেয়েছিল।
   বান্টি এবারে আসছে পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে। এতদিনে জানা গেছে তার কাকা নাকি মুম্বাইতে থাকেন। বান্টি এসে তাকে নিয়ে আজ রাতেই মুম্বাই মেলে রওনা হবে। মডেলিং-এ তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এমন মাল পেলে নাকি তার কাকা লুফে নেবে। অলরেডি মেলে ছবি দেখেই নাকি ৩০,০০০ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। কাজ ভাল হলে আরো দেবে। বাড়িতে সবাই খুব খুশী। শুধু তার অকৃতজ্ঞ মুখভঙ্গি দেখে তার মায়ের লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।


---

সব জানিয়ে সে একটা চিঠি প্রদীপের কাছে পাঠিয়েছে সমীরের হাতে।

প্রদীপ,

আমার হাতে বেশি সময় নেই সব কিছু বুঝিয়ে বলার। শুধু এটুকু বলি, ছোটবেলা থেকে দারিদ্রতার মাশুল আর লোভের যোগান দেওয়ায় আমাকে বহুবার একটা মানুষের কাছে নিজেকে বলি দিতে হয়েছে, যখন ঘুষুড়িতে ছিলাম। আমি কোনোদিন লজ্জায় বলতে পারিনি। আর এই জন্যই তোকে বুঝলেও আমি হ্যাঁ বলতে পারিনি সম্পর্ক গড়ে তোলার। সে যাক। এসব ভেবে চোখের জল ফেলার সময় বা রুচি কোনোটাই আমার নেই।

একটা দরকারে চিঠি লেখা। এত বছর পর সেই নরখাদকটা আবার জেগে উঠেছে। সে আসছে আমায় নিয়ে মুম্বাইতে তার কাকার কাছে বিক্রি করে দেবে বলে। তোর বাবার তো অনেক পরিচয়। আমাকে কোথাও একটা যে কোনো কাজে ঢুকিয়ে দিতে পারবেন না! আমি কোনো রকমে পড়াশোনাটা শেষ করতে চাই রে। তারপর একটা না একটা কিছু জুটিয়েই নেব। একবার কাকুকে বলে দেখ না।

পল্লবী

পুনশ্চ - আরেকটা কথা। যদি না পারিস, তবে নিজের অসুবিধা করে কিছু বলতে হবে না। আমায় নিয়ে আর ভাবিস না। আমাকে আমার ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিস। আর আমায় ক্ষমা করিস। আমি এতদিন সব বুঝেও কেন চুপ করেছিলাম, মেয়ে হলে বুঝতিস।

    বিকালবেলা বান্টির সাথে উলুবেড়িয়া স্টেশানে এসে দাঁড়াল। হাওড়া যাবে। ব্যাগ মা গুছিয়ে দিয়েছে। বাবা সকাল থেকে কোথাও চলে গেছে। মা বলল যদিও কাজে গেছে। পল্লবী বিশ্বাস করেনি।
   বান্টি কি সব বলে যাচ্ছে। সে কোনো কথা কানে নিচ্ছে না। তার চোখের সামনে সব স্থির। যেন তার বুক শ্বাসপ্রশ্বাস পর্য্যন্ত নিচ্ছে না। এখন যদি সে লাইনে ঝাঁপ দেয়? না, বাবা মা তার লাশ সহ্য করতে পারবে না। যেমনই হোক বাবা মা তো। হঠাৎ করে কেমন করুণা জাগল তার মায়ের মুখটা মনে পড়ে। মনে হল একবার ছুট্টে গিয়ে আবার দেখা করে আসে। একবার জড়িয়ে গালে একটা চুমু খেয়ে আসে। একবার হেসে বলে, মা, আমি আসলাম। বান্টির দিকে তাকায়। সে একটা মেয়ের বুকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বিড়ি টানছে একটু দূরে বসে। পল্লবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যাক গে, ভারতবর্ষে তো আর রেললাইনের অভাব নেই।
ট্রেনের অ্যানাউন্স হল। বান্টি বলল, চলো লায়লা গাড়ি আসছে।

    হঠাৎ একটা জলদগম্ভীর গলা শুনে ফিরে তাকাল, তুমি পল্লবী?
    পল্লবী হ্যাঁ না কিছুই বলল না। হঠাৎ তার মনে হল সব কিছু জীবন্ত হয়ে উঠছে তার সামনে, সে যেন বুঝছে তার সামনে কে, তবু বিশ্বাস করতে পারছে না।
-আমি ডাক্তার হিরণ্ময় মুখার্জী, ওই অপোগন্ডটার বাবা, সে দেখল কিছুটা দূরে প্রদীপ দাঁড়িয়ে, তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সন্ধ্যে হয় হয়। প্ল্যাটফর্মের পাশের বটগাছটাতে ঘরে ফেরা পাখিদের চীৎকারে কান ঝালাপালা। পল্লবীর মনে হল সে যেন অজ্ঞান হয়ে যাবে।
-গাড়িতে ওঠো, প্রদীপের মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

(ছবিঃ সুমন দাস)