সৌরভ ভট্টাচার্য
22 May 2016
রাজনীতি নিয়ে
লেখা সাধারণত আমি লিখি না। তার একটা বড় কারণ শেষ কয়েক দশক ধরে ভারতীয় তথা বঙ্গীয় রাজনীতিতে
যে মেরুকরণ, তর্কাতর্কি, অবস্থান শুরু হয়েছে, তাতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি না।
Black and White চিন্তনধারা সবক্ষেত্রেই উগ্রতা ও বিদ্বেষজনক। কিন্তু সদ্যপ্রকাশিত
বাংলার রায় ও তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ নানান আলোচনা, সমালোচনায় কিছুটা বিবশ হয়েই লিখতে
বসলাম। বা বলা চলে, মহাত্মাজী যাকে 'সরব চিন্তা' বলেন, তাই করতে বসলাম।
বিবেকানন্দ
মহাশয় তাঁর একটি পত্রে কোনো গুরুভাইকে বিদেশ থেকে লিখছেন, পৃথিবীটা উচ্চ দর্শনের জন্য
অপেক্ষারত নয়, সে চায় চরিত্র।
মানুষ চরিত্রানুগামী,
তত্ত্বানুগামী নয়। মানুষ ভোট দেয় মানুষকে, কোনো দলকে নয়। দলের প্রতিও যে আনুগত্য, বা
ভালোবাসা, বা সমর্থন- তাও সেই দলের কোনো প্রভাবশালী, সমর্থ কোনো জীবিত বা ভূতপূর্ব
দলনেতার কারণে। যাকে সে ভালোবেসেছে, বা প্রভাবিত হয়েছে, বা অনুগত হয়েছে।
বাম এবং ডান
যেদিন জোট বাঁধল, সেদিনই তাদের হারের পথ নির্ধারিত হল। বাম অনুগত বা ডান অনুগত বহুমানুষই
এই জোটের সার্থকতায় সন্দিহান হল। তার বড় প্রমান এই জোট ঘটানোর প্রধান চিন্তাকারীদের
হার। হার, অর্থাৎ অসমর্থন।
ভুলটা ছিল
অস্পষ্টতায়। একছত্র ৩৪ বছর শাসন করবার পর কোনো দলকে যদি কারোর সাহায্যে দাঁড়াতে হয়
জনমত পাওয়ার জন্য, তবে সেটা এটাই প্রমাণ করে যে সেই দলের আত্মশক্তি একেবারে নিঃস্বপ্রায়।
তা তখনই জনমনে ভ্রুকুটি জাগায়। প্রশ্ন আনে। সর্বোপরি অনাস্থা আনে। ফলস্বরূপ একদা জনপ্রিয়
নেতাদের হার। আসলে ওই যে শুরুতেই বললাম, মানুষ একটা চরিত্রকে চেনে, একটা মানুষকে চেনে।
শুধুমাত্র একদাচিন্তিত একটা দর্শনের শুষ্কপত্র আউড়িয়ে আর যা হোক, গতিময়তা থাকে কি?
যদি রাজ্যের শিরায় শিরায়, স্নায়ুতে স্নায়ুতে নিজের অস্তিত্ব না পৌঁছে দিতে পারি, তবে
বিরোধীর যত সুক্ষ্ম সমালোচনাই করি না কেন, তা অবশেষে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় প্রাপ্ত হাততালির
আওয়াজের সাথেই। সেই অস্তিত্বকে জাগ্রত রাখতে গেলে জোরের চেয়ে বেশি আত্মীয়তায় আসতে হয়।
সাধারণ মানুষের আত্মীয়তায় পৌঁছাতে পারলে তবেই গণতন্ত্রে টেকা যায়। জোর খাটিয়ে, কৌশলে
বাজিমাত করতে গিয়ে বহু বিচক্ষণ নেতারও পতন হয়েছে, গণতন্ত্রে এর সাক্ষী ইতিহাস। এখানে
বহু ভুলও গৌণ হয়ে যায় শুধুমাত্র এই 'কাছের মানুষ' বা 'ঘরের মানুষ' হওয়ার শক্তিতে।
ভারতবর্ষের
বর্তমান কেন্দ্রশাসিত দলটিকে কোনোদিনই বাংলা তার ঘরের লোক করে পায়নি। তাই তার সামনে
এখনো দীর্ঘ সংগ্রাম। সে ভারতীয়। দুরসম্পর্কের আত্মীয়। তাকে যেন দিল্লী, গুজরাটেই মানায়।
আমরা তাদের সাফল্যের গুণগান নিশ্চই করব, তবে যেন সেটা ভিন রাজ্যের, বা কেন্দ্রের জয়ে;
কখনোই এই রাজ্যে নয়। তাই বললাম, তাকে বাংলার ঘরের লোক হতে এখনো দীর্ঘপথ হাঁটতে হবে।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর
মধ্যে এই ঘরের লোকের ছবিটাই স্পষ্ট করে দেখেছে বাংলা। কার্যসূত্রে বাংলার বহু প্রত্যন্ত
গ্রামে বহুবার গেছি। তাদের সাথে কথা বলেছি। দেখেছি মুখ্যমন্ত্রীর ওপর তাদের একরকম আত্মীয়তার
আবদার। তারা সাইকেল বোঝে, ভাল রাস্তাঘাট বোঝে, জলের কল বোঝে, কিছু সুলভ প্রকল্প বোঝে।
জটিল সংখ্যাতত্ত্ব বোঝে না, জটিল অর্থনীতি বোঝে না। তাদের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে, ইংরাজীতে
যাকে Dynamic বলে, সেই রূপটা খুব প্রকটভাবে দেখেছে। বিশ্বাস করেছে। আস্থা রেখেছে।
তবে কি সব
ভালো হয়েছে? হয়নি। তবে কি, যারা চলতে চায় তারা পথের খানাখন্দ বাঁচিয়ে একটা সরুপথ খুঁজেও
চলতে চায়। আর যারা চলতে চায় না, তারা খানাখন্দের হিসাব করে, তুলনা করে ভাবে, আহা কি
তত্ত্বই না খাড়া করেছি!
প্রবল ঔদ্ধত্য,
অহংকার, Holier than thou মানসিকতা না ছাড়লে, আর যা হোক গণতন্ত্রের হাল পাওয়া শক্ত।
সবার মধ্যে এসে দাঁড়াতে হবে। সবার হয়ে দাঁড়াতে হবে। যে দিকগুলো শাসকদলের দৃষ্টিগোচর
হয়নি বলে বোধ হচ্ছে, তা নিয়ে শুধু খুঁত ধরে না বেড়িয়ে, আন্দোলনও করতে হবে। অবশ্যই তা
অস্বাস্থ্যকরভাবে না মোটেই। তবেই একটা উন্নয়নমূলক, প্রগতিশীল গণতন্ত্র গঠন করা সম্ভব।