Skip to main content

    মানুষটা চাইত তার ঘরের দেওয়াল জুড়ে থাকবে হালকা সবুজ একটা রঙ। ঘরের চারদিকে দুটো জানলা থাকবে, গুমোট গন্ধ হবে না ঘরে। সকাল-সন্ধ্যে হালকা একটা ধুপের গন্ধ ঈশ্বরের চরণের মত ধীরে ধীরে পা ফেলে তার এ ঘর সে ঘর ঘুরে যাবে। তার বাথরুমে থাকবে হালকা সাবানের গন্ধ, মেঝে থাকবে শুকনো। খাবার আয়োজন হবে না এলাহি। থাকবে স্বাদ, থাকবে মাত্রামত আয়োজন। খেতে খেতে শব্দ করবে না, অতিশব্দে ঢেকুর তুলবে না কেউ, হাই তুলবে না আওয়াজ করে - বিরক্তিকর!

    বাবা-মা বলত, সে বড্ড অভিমানী। শিক্ষকেরা বলত, কেমন যেন। ভালোবাসার মানুষ বলত - বড্ড তুমি অন্যরকম।

 
    আসলে সেকি অন্যরকম? মাছ বাজারে কাটা মাছের ছটফটানি দেখতে পারত না। ঝোলানো পাঁঠা, মুরগীর দোকানের মুরগীর শেষ আর্ত চীৎকার তার মাথার মধ্যে বাড়ি মারত। কেঁপে কেঁপে ওঠা প্রদীপের আলো করতে চাইত শান্ত পাখা বন্ধ করে, কিম্বা অনাহূত ঝোড়ো হাওয়াকে জানলা আটকে প্রতিহত করে। কাজের মানুষের নখকুনির পুঁজ তার অসহ্য লাগত, বিটাডাইন আর তুলো নিয়ে অপেক্ষা করত বাসন মাজা শেষ হওয়ার। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ যদি কাপড় বেঁধে যেত রেলিং-এ, চমকে উঠে পিছন ফিরত, যেন টেনে ধরল কেউ।

    মানুষটা অল্প শব্দে চমকে উঠত। অল্প ব্যথাকে প্রতিহত করতে চাইত নিজের অন্যের। পারত না। দ্বিগুণ জেদে ঈশ্বরকে বলত, ব্যথা কমাও। বধির ঈশ্বর আর অবাধ্য ব্যথার মাঝে পিষে যেত। লোকে বলত, বাড়াবাড়ি।

    আসলে সবটাই তার বাড়াবাড়ি। যখন আলো নিভত ঘরে, আদিম সুখের পর্ব সূচনার মঙ্গলশঙ্খ বেজে উঠত দেওয়ালে, ছাদে, বিছানায়, বালিশে, পাখার আওয়াজে, ঘামের গন্ধে, আঙুলের বিচলনে - সে চাইত পরতে পরতে খুলে যাক সে, পাপড়ির মত। আরো গভীরে নেমে যাক ধাপে ধাপে, জোয়ারের জলে ডোবা গঙ্গার সিঁড়িগুলোর মত। শরীরে শরীরে তন্ময় হোক হৃদয়। সিক্ত গুহায় প্রাণ জাগুক প্রাচীন অভ্যর্থনায়।

    হত না। আঁশবঁটির মত ভালোবাসা নামত অন্ধকার ঘরে। একটানে দু’ফালা হয়ে যেত সে আর তার শরীর। ছিন্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবত, এইটাই তাই বাস্তব। এমনই তো হওয়া উচিৎ। সিক্ততা হারানো রুক্ষ শরীরে অভ্যর্থনা কই, গুহার ভিতর আহত প্রাণীর আদিম চীৎকার। সঙ্গীর বুদ্ধি ভুল করত, বলত শীৎকার।

    তবু বেঁচে গেল। জীবনের কাছে হেরে গিয়েও বেঁচে গেল। সব জায়গায় হারতে হারতে ডাক পড়তে লাগল কম। তার চলাফেরার জায়গা হল সঙ্কুচিত। চুলে ধরল পাক। ত্বক হল কুঞ্চিত। পেশী হল শিথিল। সংসারে হল অনুর্বর। কিন্তু ওই বাড়াবাড়ি মন হয়ে উঠল আরো বাচাল, আরো দুরন্ত। কোকিল ডাকলে বলে, শুনলাম। ফেরিওয়ালা হেঁকে বলে, জেগে আছি। কুকুরের বাচ্চা লাথি খেয়ে কেঁদে উঠলে বলে, বুঝতে পারছি। মানুষের বাচ্চা মানুষ হওয়ার যাঁতাকলে পিষে কঁকিয়ে উঠলে বলে, আর একটু, পেরে যাবি। কেউ রুক্ষ কথা বললে, কথাগুলো দু’হাতে নিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে বলে, আরো আছে নাকি? রূঢ় ব্যবহারের গায়ে আলপনা আঁকতে আঁকতে বলে, মন তুমি কতরকম! নিজেকে দেখে অবাক হয়, এত শক্তি পায় কি করে সে? বধির অন্ধ ঈশ্বরের বুড়ো আঙুলে দুষ্টুমি করে চিমটি কেটে বলে, এই বুড়ো ঘুমালে নাকি? আমি যে বেঁচে আছি এখনও!

 
    একদিন বেঁচে থাকা ফুরিয়ে গেল। অল্প ভুগে। কিন্তু সেই প্রতিটা ভোগান্তির পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ সে দিতে পারত যদি কেউ জিজ্ঞাসা করত। কেমনভাবে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল বারবার, মাথার মধ্যে দার্জিলিং-এর কুয়াশা এসে জমত যখন তখন, অসাড় শরীরে দামাল যন্ত্রণা লুটোপুটি খেত কিভাবে অহর্নিশি। এক মুহূর্তে হঠাৎ সব কুয়াশা গেল সরে, কাঞ্চনজঙ্ঘার মত মৃত্যু দাঁড়ালো উজ্জ্বল হয়ে। সে মারা গেল।

    তাকে যখন শোয়ানো ঘরে। তীব্র ধুপের গন্ধ, গলা ফাটানো কান্নায় কেঁপে উঠছে জানলার কাঁচগুলো - তার ভুরুযুগলও যেন ঈষৎ কুঞ্চিত হয়ে বলতে চাইছে - এত কোলাহল? শান্ত হও না!

    কেউ শান্ত হল না। মানুষ বুক ফাটা কান্নার সুখে জীবনের যত না পাওয়া ক্ষোভ, অভিমান মনে করে বার করে দেয় এক লহমায়, এই সুযোগে। কেউ ছাড়ে না।


    শুধু জানলার বাইরে মাধবীলতা বাতাসে দুলে দুলে আকাশকে নিঃশব্দে প্রশ্ন করতে লাগল, সেকি গেল? সেকি গেল? সেকি এলো তোমার কাছে?