Skip to main content
 
 
খেলনা হাতে স্টেশানে বসে। খেলনাটা নতুন না। ভাঙা। স্টেশানের আলোয় বাচ্চাটার গায়ের ছায়া পড়েছে টিকিট ঘরের দেওয়ালে। টিকিট কাটতে এসে কেউ কেউ অন্যমনস্ক হয়ে বাচ্চাটাকে দেখছে। বাচ্চাটা মন দিয়ে খেয়াল করছে সবাইকে। এদের অনেককেই সে চেনে, তাকেও চেনে মোটামুটি সবাই, জানে না।
       সন্ধ্যে হয়ে রাত গড়ালো। বাচ্চাটা প্রায় চারঘন্টা হল বসে। একই জায়গায় বসে। চলতে পারে না। অনেক ছোটোবেলায় দুটো পা কাটা গিয়েছিল এই সামনের রেললাইনেই। একটা কাপড় ভাঁজ করে মোটা করে রাখা তার আগে, পয়সা পড়েছে কিছু। বাচ্চাটার খেয়াল নেই। সে চারদিকের মানুষ আর নিজের খেলা নিয়ে ব্যস্ত।
       এক কিশোরী হুদ্দুড় করে কোথা থেকে এল। এসেই বাচ্চাটার সামনে রাখা পয়সাগুলো একটা নাইলনের ব্যাগে ভরে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। বাচ্চাটা বিনা প্রতিবাদে কোলে উঠে মেয়েটার কাঁধে মাথা রেখে চোখটা বন্ধ করল। ভীষণ ক্লান্ত সে। মেয়েটা স্টেশানের একটা মিষ্টির দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। অল্প কয়েকজন ক্রেতা ছিল। দোকানি এক যুবক। সে মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে খদ্দেরদের এটা সেটা দিতে লাগল। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে কাদা। মেয়েটা খেলনাটা ব্যাগে ভরে নিয়েছে। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে মেয়েটা আশেপাশের লোক দেখছে, ট্রেনের পর ট্রেনের অ্যানাউন্স হচ্ছে, ট্রেন আসছে যাচ্ছে, লোক উঠছে নামছে। মেয়েটা নিরুত্তাপ তাকিয়ে। কিছু খুঁজছে না।
       একটু পর দোকানি দুটো গজা একটা ঠোঙায় নিয়ে তার সামনে রাখল। মেয়েটা হাতের মুঠোয় ধরা পয়সা দোকানির সামনে রেখে গজাটা নাইলনের ব্যাগে ঢুকিয়ে, হাঁটতে শুরু করে দিল।
       শেষ গাড়ি চলে গেছে। দোকানপাট সব বন্ধ। ছেলেটা যেখানে বসেছিল সেখানে একজন মানুষ শুয়ে। মাথার কাছে দুটো কুকুর। এখন অনেকক্ষণ ট্রেন নেই। সিগন্যাল আপ-ডাউন দুদিকেই লাল। মেঘ ডেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কয়েকটা কুকুর ইতস্তত ঘুরছিল, দৌড়ে শেডের তলায় এসে চীৎকার হট্টগোল শুরু করল। ঘুমন্ত মানুষটা হুড়মুড় করে উঠে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখল এদিক-ওদিক। চোখ দুটো লাল। কিছুটা ঘুমের নেশায় কিছুটা কারণবারির জন্য। সামনের প্ল্যাটফর্মটা দেখা যাচ্ছে না, এত জোর বৃষ্টি, যেন জলের যবনিকা।
 
       একটা কাঠের টেবিল মত রাখা তার পাশে যার উপর সকালে কাগজ ম্যাগাজিন বিক্রি করে একজন। মানুষটা সেই টেবিলে পিঠ ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। কুকুরগুলোকে আর গায়ে এসে পড়া অবাঞ্ছিত বৃষ্টির ছাঁটকে গালাগাল করল। তারপর চোখ বন্ধ করে উদাত্ত গলায় গাইতে শুরু করল, ইয়ে দুনিয়া... ইয়ে মেহেফিল... মেরে কাম কি নেহি... গলায় সুর আছে। সুরে একটা ব্যথা আছে, অভিমানও আছে।
       কুকুরগুলো তারস্বরে চীৎকার করল। মেঘ ডেকে উঠল মাঝে মাঝে। গানটা থামল না।
       বেলা হল। বাচ্চাটা আবার বসে তার জায়গায়, এখন চঞ্চল, যেন উঠে দৌড়ে চলে যেতে চাইছে, কিন্তু লাইন নিয়েছে পা, শৈশব নিয়েছে...জানে না কে। দিদি আসেনি। ট্রেনে মায়ের সাথে ভিক্ষায় বেরিয়েছে। বাবা? কেউ জানে না। কোনো প্ল্যাটফর্মে গান গাইছে হয় তো মদের সুখে, কিম্বা পড়ে আছে কোনো ঝোপে। রাতে শুতে আসবে ছেলের উঠে গেলে আবার। মা বা দিদি খুঁজে নিয়ে আসবে, বা হয়তো খুঁজতেও যাবে না।