সমুদ্রস্নান সেরে সে তীরে বসেছিল। ভেজা কাপড় শুকিয়ে নিচ্ছিল ভাগাভাগি করে, কিছুটা রোদ, কিছুটা হাওয়া। তার চোখের মণিতে যে সাগরের ঢেউ আছাড় খাচ্ছিল, সে সাগরের সাথে তার বুকের সাগরের কোনো মিল নেই, আবার আছেও। তার মনের মধ্যের সমুদ্র বাইরের সমুদ্রের সাথে কথা বলছিল। ভিতরের সমুদ্র কথা করল শুরু।
-তোর এত ঢেউ? কে যোগায়?
-বাতাস, তোর জল এত স্থির কেন?
-জানি না, তোর বুকের কাছে মুক্তা ঝিনুক আছে?
-আছে, তোর?
-ছিল। এখন নেই। আচ্ছা, শাঁখের মধ্যে যে শব্দ, সেকি তোর ঢেউ এর?
-জানি না রে। লোকে বলে। তোর বুকে শব্দ নেই কেন?
-জানি না রে। তবে ছিল এককালে।
-আমার বুকে কত ডিঙি দেখেছিস। ওই দেখ কত বড় বড় জাহাজ। কত উঁচু মাস্তুল দেখ!
-আমার বুকেও ভেসেছিল। এক নাবিক। তার ছোট ডিঙা উথাল-পাথাল করত আমার বুকের এমাথা ওমাথা।
-তারপর?
-তারপর এল ঝড়। কি অন্ধকার তোকে কি করে বোঝাই। ঝড় থামল। দেখি সে নাই। তার ভাঙা ডিঙি টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে এখানে ওখানে।
(ভিতরের সমুদ্রের কিছুটা জল, ছলকে এসে পড়ল বালিতে। বালি মুখ তুলে চাইল)
বালি বলল, পুড়েছো না খুব?
-ভিতরের সমুদ্র বলল, হ্যাঁ গো।
-আমিও পুড়ি। সে বাইরের সমুদ্রকে দেখিয়ে বলল, ওর এত জল, ও আসে আর আমার বুকের তাপ কিছুটা বুলিয়ে নিয়ে যায় সজল আঁচলে। আর কাজ কি বলো, আমি ওর দিকে চেয়ে আর ও আমার দিকে। এ ভাবেই কত যুগ কাটল।
(একটা সাদা চিলের পালক এসে পড়ল আমাদের গল্পের যে মেয়েটি, তার শাড়িতে। মেয়েটা সাদা পালকটা তুলে, আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ হাসল। বলল না কিছু)
মেয়েটার ভিতর থেকে সাগর বলল, তুমি জানো, সেই ডিঙির খবর কিছু?
-আকাশ বলল, অপেক্ষা করো।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। পূর্ণচাঁদ উঠল আকাশে। একে একে তারায় ভরল সারা আকাশ। মেয়েটা চোখ বুজল।
সেই চাঁদের আলো বেয়ে যেন কে আসছে তার বুকে। তার শরীরে ঢেউ লাগল। বুকের ভিতর দমকা বাতাস আসল। বালিতে বালিতে ছেয়ে গেল স্মৃতির তীর। তার মনে হল, সে যেন গলে গলে মিশে যাচ্ছে সব কিছুর সাথে। আকাশ, বালির তীর, বাইরের সমুদ্র- সবের সাথে সে যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে। সে ভুলে গিয়েছিল, তার পায়ে বাঁধা নূপুর জোড়া। সেটা বাজল - ছুন ছুন। তার মনে পড়ল তার দু'কানে দুটো হীরের দুল। তার আলো ঠিকরে পড়ল চাঁদের দ্যুতির গায়ে। সে দু'হাত তুলে বলল, তুমি এসেছো?
-এসেছি
-কোথায় ছিলে?
-সময়ের আড়ালে, তোমার স্মৃতির মহলে
-আসোনি কেন এতদিন?
-তোমার সেদিন কে, এতদিন বলে বোধ করানো হয়নি যে!
-তুমি আমায় নেবে এবার?
-তাই তো আসা
-নাও তবে!
-এসো
সকাল হল। সমুদ্রের তীরে পড়েছিল একজোড়া হীরের দুল আর নূপুর। সমুদ্রের জল তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরছিল, বালির সাথে, বাতাসের সাথে।
সৌরভ ভট্টাচার্য
3 October 2015