Skip to main content
The Autumn of Patriarch

        ঠিক কি ভাবে লিখি বলুন তো? গতকাল থেকে ভেবে চলেছি...কি ভাবে লিখি...কি ভাবে লিখি...মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, না লিখলে হয় না? কে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে আমায় লিখতেই হবে? আর না লিখলেই বা কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে? তবু খচখচ করেই যাচ্ছে মনটা, এত ভালো একটা বই, বলব না সে বইয়ের কথা? অগত্যা লিখতে বসা। 
        শ্বাস ছাড়া, জল ছাড়া বাঁচা যেমন দুষ্কর, তেমন বই ছাড়াও, এ যে কোনো নেশাখোর মানুষই জানবেন। ভাগ্যে কলেজস্ট্রিট আর ইবুক বলে দুটো মরুদ্যান সংসারে আছে, নইলে কি যে অবস্থা হত? অগত্যা লোলচক্ষু নিয়ে চষে চষে বেড়ানো, দাদা নতুন কি আছে? আজ যে বইটা নিয়ে বলতে বসেছি তার নামটা ছবিতে দেখে নিয়েছেন নিশ্চয়, The Autumn of Patriarch, লেখক - গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। বলা হয় এটা ওনার কঠিনতম লেখা। এই তথ্যটা যদি আমি আগে জানতাম তবে নিশ্চই এই বৈশাখ মাসে শুরু করতাম না। বইটা লিখতে প্রায় সাত বছর নিয়েছিলেন। পাতার সংখ্যা ২২৯। এমন কিছু বড় নয় মোটেই। যদিও ছাপার গুণগত মান ভালো নয়। পেঙ্গুইনের বই। দাম, ২৯৯। Infibeam এ ২২৫ টাকায় পেলাম। এই সাইটে বই বেশ সস্তায় মেলে মাঝেমধ্যে। 
        এবার আসি পাঠ-প্রতিক্রিয়ায়। বিষয়ে যাওয়ার আগে বইটার লেখার আঙ্গিক নিয়ে একটা কথা বলি। বইটা পুরোপুরি দাঁড়িয়ে আছে কমা(,) উপরে। পুরো বইটাতে ৫০/৬০ টাও দাঁড়ি বা ফুলস্টপ আছে কিনা সন্দেহ। পাতার পর পাতা একটাই বাক্য চলেছে তো চলেছেই। তার উপরে অনুচ্ছেদ শেষ হলে নতুন অনুচ্ছেদে কোনো শিরোনাম দূরের কথা সংখ্যা পর্যন্ত দেওয়া নেই। আমার পড়ার মধ্যে যখন কোনো কারণে উঠতে হচ্ছিল, পেন্সিলে একটা দাগ দিয়ে উঠছিলাম, কারণ কোথায় থামব? যতিচিহ্নর অপেক্ষায় বসে থাকতে হলে তো আরো একটা গোটা পাতা পড়ে উঠতে হবে তো! 
        বিষয়ে আসি। এক কাল্পনিক দেশ। এক কাল্পনিক ডিক্টেটর। যার চরিত্রে পৃথিবীর সব ডিক্টেটরের ছায়া মার্কেজ দেখিয়েছেন। ভাষা নিয়ে কি বলব? কেমন ডিক্টেটর? না যার দেশের মুদ্রায় দুদিকেই তার ছবি থাকে। কেমন ডিক্টেটর? না যিনি শত শত বাচ্চাকে সুদূর কারাগারে রাখেন। তারা বহুদিন পর যখন কারগার থেকে বেরোয় তখন সেই সূর্যের আলো না পাওয়া রুগ্ন, শেওলা ধরা, বাচ্চাদের সারিটা দেখে মনে হয় যেন একটা সরীসৃপের মত প্রাণী জেগে উঠেছে। ওদের নির্বাসনে পাঠানো হয়। ডিক্টেটর তাদের সেখানে পাওডার পাঠায় যাতে ক্ষেতের পোকায় গায়ে সংক্রমণ না হয়, এই তো তার মানবিক দয়াবান দিক, নিজেই নিজে খুশী হয়ে যায়। তারপর কোনো একদিন বাচ্চাগুলোকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেন, দশজন জেনারেলকে বলেন ওদের মেরে ফেলো। তারা মেরে এসে খবর দেয়। ডিক্টেটর অসন্তষ্ট হয়ে তাদেরও মেরে ফেলেন, কারণ সব নির্দেশ তারা মানে কেন? অর্থাৎ এই শিশ্যহত্যার দায় তো তাদেরই, না? খাতায় কলমে সব বাচ্চাগুলো স্কুলে পড়তে যায়। ডিক্টেটর তার মাকে অসম্ভব ভালোবাসে। মায়ের পিঠে একটা ঘা। মারা যাবেন। তিনি প্রতিদিন মাকে জড়িয়ে এক বিছানায় শোন। মা মারা গেলে তাকে সন্ত উপাধি দেওয়ার জন্য পোপের কাছে আবেদন জানান। খারিজ হয়ে যায়। তিনি নিজের থেকেই মাকে স্বদেশেই সন্ত বানানোর ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেকেই পয়সা পায়, যারা কবরে মিছিমিছি মরে শুয়েছিল, তারপর এক মুখ মাটি নিয়ে বেরিয়ে আসে, যারা মৃতসন্তান প্রসবের অভিনয় করেছিল যারা নাকি তার মায়ের দৈবসত্তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। ডিক্টেটরের বিরাট হারেম। তিনি সঙ্গমের সময় পোশাক খুলতে পছন্দ করেন না। তিনি যখন তার হারেমের কারোর সাথে চূড়ান্ত লীলায় ব্যস্ত তখন তার মা প্রাসাদের সব পশুপাখিদের খুঁচিয়ে দিয়ে চীৎকার করাতে বাধ্য করেন যাতে কোনো অবাঞ্ছিত শব্দ বাইরে না যায়। তবুও ডিক্টেটরের পুরুষত্ব নিয়েও একটা সংশয় আসে। তার এক অণ্ডকোষ আবার হার্নিয়ায় আক্রান্ত। একজন নিঃসঙ্গ ডিক্টেটর যে ধুমকেতু দুবার দেখে নিজের জীবনে। মানে প্রায় নাকি দুশো বছর শাসন করেছে। একবার শেষ ধুমকেতুটা যখন আসে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। পরে মাথাটা যখন খারাপ হয়ে যায় তখন তার মনে হয় তিনি জীবনে একশোটার বেশি ধুমকেতু দেখেছেন, তিনি অমর। শেষ ধুমকেতুটার লেজের এত ধুলো রাস্তায় পড়েছিল যে শহরের সব ঝাড়ুদারদের প্রায় সারাদিন লাগে সেই তারার টুকরোর ধুলোগুলো সরাতে। ডিক্টেটর সে অর্থে লিখতে পড়তে পারত না। আর লিখিত আইনি ব্যবস্থার উপর তার আস্থাও ছিল না। সে তো একটা জড়পদার্থ। আইন হবে সচল। তার মুখে মুখে। 
        বইটা শুরু হয় এই ডিক্টেটরের মৃত্যুর দৃশ্য দিয়ে। যেখানে নাগরিকদের বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে তিনি মারা গেছেন। মারা গেছেন? না মারা যাওয়ার অভিনয় করছেন? তাকে ছাড়া চন্দ্রসূর্য যে উঠতে পারে সে বিশ্বাসও নাগরিকদের নেই প্রায়। তাকে ছাড়া চলবে কি করে সব? দিন রাত হবে কি করে?
        একজন শাসকের সবচাইতে ভয়ংকর দিক হল সে নিজেকে অপরিহার্য্য ভাবিয়ে তোলে শাসন ব্যবস্থার চেয়ে। ব্যক্তি বড়, আইন নয়। এমন একটা ভাবমূর্তি যখন বাসা বাঁধতে শুরু করে নাগরিক চেতনায়, তখন একটা একনায়কতন্ত্র গড়ে ওঠেই। এমনকি গণতন্ত্রের ছদ্মবেশেই গড়ে ওঠে। তার উদাহরণ খুঁজতে ইতিহাসের ধুলো ঝাড়ার দরকার আছে কি?
        মার্কেজের ভাষা নিয়ে কিছু বলতে যাওয়া মূঢ়তা। কি অসামান্য শব্দ চয়নে এই নিদারুণ অমানবিক ছবিটা এঁকেছেন তা বিস্ময়ের সীমা রাখে না। লিখতে লিখতে কখন পাঠক অতীতে, কখন বর্তমানে, একটু অসচেতন হলেই সুতো ছিঁড়বে। আরেকটা মজার হল বক্তা। মাঝে মাঝে সেও বদলে বদলে যাবে। যে ‘আমি’ টা বলছে, সে নাগরিক, না ডিক্টেটরের অন্তরাত্মা, না অত্যাচারিত মেয়েটা? পাঠককে বুঝতে হবে। ও হ্যাঁ, এর মধ্যে তিনি প্রেমেও তো পড়েছিলেন, বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু প্রেমটা সুগন্ধ ধরে রাখতে পারল কই? ঈশ্বরের মত স্বার্থপর, অবুঝ, অধরা একগুঁয়ে ভালোবাসার সাথে কতটা সমঝোতা করা যায়? তাও একজন এমন একনায়কের? তবু নিঃসঙ্গতা তো রাজাকেও ছাড়ে না, না? নিঃসঙ্গতা, নিষ্ঠুরতার সাথেও পাল্লা দিয়ে তাকে শেষ করে দিয়ে যেতে পারে। শকুনেরা অপেক্ষা করে। 
        আমি মুগ্ধ, বিস্মিত বলার চাইতে বলা যেতে পারে আমি আবেশিত, আক্রান্ত – মার্কেজে। কারণ মার্কেজ মানবিকতার প্রদীপটার চরম নিভুনিভু অবস্থাতেও হাল ছাড়েন না। বুদ্ধি আর আবেগের এমন বুনট সত্যিই বড় দুর্লভ। আর সব ছাপিয়ে একটা স্বর্গীয় সরলতা। বইটা সুখপাঠ্য হয়ত নয়, কিন্তু বইটার শেষে পাঠক রিক্ত হাতে ফিরবেন না। মার্কেজ রিক্ত হাতে ফেরান না। ট্রেকিং করার সুখ ট্রেকাররাই জানে, খোলা মাঠে হাওয়া খাওয়াতে আর সে মজা কই?


 

Category