Skip to main content

দুঃখের আত্মসম্মান বোধ আছে। ক্ষোভ অভিমানী। শোক মাটির কাছাকাছি, নিরহংকারী, বৈরাগী।

       শোক জীবনকে বলে, এত ছুটো না। শোক মৃত্যুকে বলে, আমি প্রস্তুত। শোক অনন্তকে বলে, আমারও অস্তিত্ব আছে, তোমায় চিনেছি নিজের শরীরের মধ্যে, বাতাসকে যেমন ত্বকে, আলোকে যেমন চোখে, শব্দকে যেমন কানে। ওগো অনন্ত, ওগো অসীম, তুমি আমায় ঘিরে সাড়া জাগাও। আমি চেতনাকে জাগিয়ে এনেছি উঠানে, মধ্যরাতে, তারা ভরা আকাশের দিকে তাকাতে বলেছি, আর বলেছি তোমার ওই ঘরটুকুর বাইরে এতবড় জগতকে উপেক্ষা করবে শুধু? চেতনা বিহ্বল হয়ে কেঁদে উঠেছে; ভয়ে আনন্দে। অবশেষে ভয় মিলিয়ে গেছে অন্ধকারের মত আনন্দের উন্মোচনে। ওগো অসীম, ওগো অনন্ত, আমি সেই শোক যে শোকের তল নেই, যে বিরহে রাধিকা, যে বৈরাগ্যে মহাদেব, যে আত্মত্যাগে খ্রীষ্ট, যে মাধুর্যে কৃষ্ণ। আমিই সেই শোক। আমার জন্ম শ্মশানে। আমার অস্তিত্ব প্রতিটা সংসারের আনাচে-কানাচে। আমায় এড়িয়ে চলা সংসারের প্রথম প্রহরের সুর, আমার কাছে ধরা দেওয়া শেষ প্রহরের নিয়তি। আর যে না ডাকতেই আসে, তার পায়ের কাছে লুটিয়ে সৌভাগ্যের হাতছানি, দুর্ভাগ্যের যন্ত্রণা - সে এ সবের পারে, সে আমার সন্তান।
       ওগো অসীম, ওগো অনন্ত, তুমি আমায় সংসারে রেখেছ তোমার দ্বার রূপে। আমায় এড়িয়ে কারোর নিস্তার নেই, আমায় এড়িয়ে কেউ নয় সার্থক মহাকালের ক্ষমায়, মহাকালের প্রসন্নতায়। প্রাণের সমস্ত ক্ষোভ, দুঃখ, যন্ত্রণা অবশেষে যদি আমাতে না মেশে তবে তা অর্থহীন - উন্মত্ত দাবানলের মত, উত্তপ্ত লাভাস্রোতের মত। যুগ যুগ ধরে নরনারীর প্রাণের কোটরে বন্দী আমি। আমিই তীর্থযাত্রীর পথপ্রদর্শক। আমিই উদয়ের পথে আহ্বান জানাই দিশাহীন প্রাণের রথীকে, বলি আমার দিকে ফেরো, বলি, কোরো না আমায় অস্বীকার, আমায় স্বীকার করো, আমায় বরণ করো, সুখের মিথ্যা কুহককে কোরো না পরিণতি তোমার, মূঢ়, জাগো, শোকের মধ্যে জাগো, মরীচিকার মধ্যে শুষ্ক প্রাণের অন্ধের মত মৃত্যুবরণ কোরো না।
       প্রাণ জিজ্ঞাসা করল, তবে তুমি কি দুঃখ নও?
       শোক বলল, না, দুঃখের অন্ত আছে, দুঃখ ঢেউ এর মত আসে যায়, আমি সাগর, আমার কূল নেই, আমার অন্ত নেই। আমি চিরকালের।
       প্রাণ বলল, কিন্তু আমি যে তোমায় মনে প্রাণে ঘৃণা করি!
       শোক বলল, সে তুমি আমায় ভয় পাও বলে।
       প্রাণ বলল, তবু....
       শোক বলল, কতদিন?
       প্রাণ বলল, আমার সব কিছু অবশেষে তুমিই নেবে?
       শোক বলল, আমি নিই না, আমাতেই সব কিছু।
       তবে এত যন্ত্রণা কেন? প্রাণ বলল।
       শোক বলল, তোমার বুদ্ধিতে যদি পরিমাপ করতে যাও আমায়, আমার তল খোঁজো, আমার থেকে ত্রাণের পথ খোঁজো - তবে তুমি নৈরাশ্যবাদী, তুমি বিকৃতির পথে হাঁটবে। আর যদি সমস্ত হৃদয় দিয়ে স্বীকার করো আমায় তবে দেখবে আনন্দ। বুদ্ধের শিক্ষায় এই শূন্যতার বোধ, এই নির্বাণের আনন্দ।
       প্রাণ বলল, তবে যে আমার বিশ্বাস তুমি আনন্দের বিপরীতে...
       শোক বলল, তুমি সুখকে বলো আনন্দ, তাই এই ভ্রম। আমার অনুচর হল ভয়। যতদিন তুমি আমার থেকে চাইবে ত্রাণ, যতদিন তুমি খুঁজবে এড়িয়ে যাওয়ার পথ, ততদিন ভয় থাকবে তোমার পেছনে পেছনে। তুমি সুখ পাবে ভয়ের মুখে মুখোশ পরিয়ে, আত্মপ্রতারণায়, কিছু সময়ের জন্য। তারপর? তারপর নিজের প্রবঞ্চার জালে পড়বে নিজেই ধরা, কাঁদবে, অভিশাপ দেবে, ক্ষুব্ধ হবে। আবার শুরু হবে নতুন পথের অন্বেষণ, নতুন আত্মপ্রবঞ্চনার খেলা। একেই তুমি বলো জীবন। হায়!
       প্রাণ বলল, আমি আসি তবে, আমি এখনও নই প্রস্তুত।
       শোক বলল, এসো, আমি প্রস্তুতির জন্যে দিই পুনঃ পুনঃ জীবন, পুনঃ পুনঃ মরণ।