Skip to main content

ধরি মানুষটার নাম 'অতল'। মানুষটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে - সবটাই অভিনয়। ঘুম থেকে উঠে চায়ের দোকানে উনুনে আঁচ দেয় যে বাঁ হাতভাঙা বেঁটেখাটো লোকটা- সে থেকে শুরু করে, মাঝরাত্তিরে বাসটা গ্যারেজে রেখে ঝিমোতে ঝিমোতে ফেরা ড্রাইভার অবধি - সবাই অভিনয় করছে। বড়লোকদের আরো সুক্ষ্ম অভিনয়, লড়াই করে বাঁচা মানুষদের স্থুল। ছিরিছাঁদহীন।
        ফলে হয় কি, অতলবাবুর নিজের অভিনয়ে যদি কেউ ঠিকঠাক, মানে অতলবাবুর মনের মত রিয়্যাক্ট না করে, তিনি ভীষণ বিরক্ত হন, - "সব্বাই তো শালা সাধুগিরির অভিনয় মারাচ্চো, তা আমার অভিনয়টা এমন কি নীচুজাতের হল যে অমন ট্যারা চোখে তাকানো? একে তো শালা ভণ্ডের দল সব, আমার সাথে ভণ্ডামিরও জাত বিচার করবি? কেন রে গরীব বলে? দেখনদারির অভিনয়ও তো কম করি না চাঁদুরা! আধপেটা খেয়েও ব্র‍্যাণ্ডেড জিনিস ব্যবহার করি তোদের সাথে পাল্লা দিতে, তার বেলা?"
        এগুলো তিনি বলেন না অবশ্য। কারণ কোনো সঠিক মনের ভাবই তিনি ঠিক যেমনটা অনুভব করেন তেমনটা বলতে পারেন না। অভিনয়ের জগতে স্ক্রিপ্টের বাইরে যাওয়াটাকে নিতান্তই কাঁচাকাজ বলে গণ্য করে। স্ক্রিপ্টটা কে দিল? নিজেই বানিয়েছেন। চারদিক দেখে, কিছু নাটক নভেল পড়ে তার নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী একটা প্যারামিটার বানিয়ে ফেলেছেন। সেই অনুযায়ী চলার চেষ্টা করেন। যদিও বলা বাহুল্য মাঝেমধ্যেই সে স্ক্রিপ্ট ফেল করে আর তিনি গভীর হতাশা-রাগ-অভিমানে ডুবে যান।
        অভিমান - এই শব্দটার উপর তার যেন একচেটিয়া অধিকার। এরকম একটা ধারণা তার আছে। তার কারণ তার ধারণা ঈশ্বর, আর কিছু ভালোমানুষের মুখোশধারী চক্রান্তে তার আজ এই দুরবস্থা। সুবিচার আজও পাননি। পাবেন আশা রাখেন আবার রাখেনও না। কারণ তিনি ঈশ্বরের কাছে আকুল প্রার্থনা আর ঈশ্বরের নামে মিথ্যা - দুটোই সমান দক্ষতায় চালিয়ে যেতে পারেন। তিনি জানেন ঈশ্বর আরো বড় অভিনেতা। ঠগবাজ। ঘুষখোর। তেলখোর। আবার কখনও ভাবেন ঈশ্বর বোকা ক্ষমতাশীল একজন ইমোশনাল ব্যক্তি। মায়ের মত।

        এই হল মোটামুটি 'অতলবাবু'র পরিচয়। ও আরেকটা কথা বললাম না তো। তার প্রেমের কথা। অতলবাবুর প্রেম। তার রমণী দেখলেই আমাশার মত প্রেম পেয়ে যায়। কন্ট্রোল করা দায়। যেখানে যে মুহূর্তে পেল সেই মুহূর্তেই কোনো একটা স্টেপ না নিলে তার পুরুষত্বে লাগে। অতলবাবু নিয়েও থাকেন।


        কথা হচ্ছে, হঠাৎ আমি এই অতলবাবু নিয়ে পড়লাম কেন? কেস স্টাডি মশায়। কত রকম চরিত্তির দেখি। সেগুলো নোট করে না রাখলে আমি নিজে কোন গোত্তের বুঝব কেমন করে অ্যাঁ!? অন্যের আয়নাতেই তো নিজের ছবি পষ্টো পড়ে।
নিজের আয়নায় নিজের ছবি দেখা যায় নাকি?

        একদিন বাজারে অতলবাবুর সাথে দেখা। ভীষণ বৃষ্টি, একটা বন্ধ দোকানের সামনে ছাউনিতে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ অতলবাবু আধভেজা হয়ে এসে দাঁড়ালেন।

- কি ছাতা নেই?
মাথা নাড়লাম।
- অ। আমারটা আবার বাড়িতে। ভুল করে রেখে এসেছি। তখন এত মেঘ ছিল বলুন?
আবার মাথা নাড়লাম।
- আপনি কি খুব রোগা হয়েছেন?
মৃদু হাসলাম।

        অতলবাবু এগিয়ে গেলেন। সামনের বাঁকটা পেরোতেই পাড়ার সেক্রেটারি পরিতোষবাবুর সাথে দেখা। ছাতা মাথায় ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন। হাতে বাজারের ব্যাগ। দুমড়েমুচড়ে ধরা। যেন একরাশ বিরক্তি ওর উপর।

- কি স্যার বাজার?
        অতলবাবুর অর্ধচন্দ্র মৌখিক হাসি।
- না হে, সিনেমায় যাচ্ছি, যাবেন?
        এটা ব্যঙ্গ। অতলবাবু জানেন। অতলবাবু বেশ আনন্দ পান কেউ তাকে ব্যঙ্গ করলে, অপমান করার ইঙ্গিতমাত্র দিলেও- কারণ তা হলে অতলবাবু রাগ করতে পারেন, অভিমান করতে পারেন। তাতে খানিক স্বস্তি পান। এখনও পেলেন। মনের মধ্যে চিড়বিড়ানি অপমানের জ্বালার আমেজ নিতে নিতে বললেন, কি যে বলেন স্যার! আমি আর ছাতা নিয়ে বেরোলাম না। আপনার মত মানুষের মাথায় ছাতা মানায়। আমাদের মত মানুষ রোদে জলে....

- কাজ নেই?
        আরেকপ্রস্থ অপমান। প্রাণটায় তীব্র জ্বালাপোড়ার স্বাদ। এই তো জীবন! পাল্টা উত্তর খুঁজছেন অতলবাবু। পাচ্ছেন না। কোনোদিন পান না। মনের মধ্যে এতগুলো অন্ধকার গলি। তাতে এত প্রতিবেশীর বাস। সবার এত চীৎকার সারাদিন! একটাও ঠিকঠাক শব্দ বলতে পারেন না সময়ে!
        সেক্রেটারি এগিয়ে গেলেন। অতলবাবু কিছু বললেন না। চায়ের দোকানে বসলেন। মিনতি চা বানায়। দুই বড় বড় ছেলের মা। তবু কি বুকের গড়ন! অতলবাবুর খাঁটি অতলবাবু নড়েচড়ে বসল। এখন কল্পনা চলবে নিষিদ্ধ পথে। অতলবাবুর নিষিদ্ধপল্লী মনের বড় একটা অংশজুড়ে। নিষিদ্ধ না ভাবলেও চলে। তবু অতলবাবু ভাবেন। তাতে রস গেঁজিয়ে ওঠে বেশি।
        অতলবাবুর হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ। অতলবাবুর শরীর গরম হচ্ছে। মিনতির ইন্ধনে। মিনতির অজান্তে। অতলবাবুর শ্বাস দ্রুত। উষ্ণ। এখন অতলবাবু যেন পশু। উপমা অর্থে না। অতলবাবু নিজেকে এখন পশু ভাবেন। সমস্ত প্রাণীর যোনিকেই সম্ভোগ করার সম্ভাবনা খুঁজে পান। কুকুর, গরু, শুয়োর ইচ্ছা করলেই কল্পনায় এসে যায়। চিকিৎসা শাস্ত্রে একে বলে বিকৃতি। জানেন। কিন্তু এটাও জানেন, সব মানুষ অরিজিনালি শুধু কামার্ত আর ক্ষুধার্ত। বাকিটা অভিনয়। চারদিক শুধু অভিনয়। পশুরা অরিজিনাল। তাই খায়, ঘুমায় আর সারাদিন কামার্ত থাকে। অতলবাবুর মত। এটা অতলবাবুর গভীর বিশ্বাস। তিনি মিনতির দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হাসলেন। মিনতি চা ছাঁকছিল খেয়াল করেনি। কিন্তু অতলবাবু জানেন, মিনতি এখন সিক্ত হবেন। অতলবাবু চায়ের দাম মিটিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। বৃষ্টিটা ধরেছে। হাত উঁচু করে, মুখে একটা আওয়াজ করে আড়ামোড়া ভাঙলেন। কি করবেন এখন? আজ তো শালা অফিস ছুটি। একটা কবিতা লিখবেন। খানিক আগের অপমানগুলোর অনুভূতি মনে আনার চেষ্টা করলেন। এসে গেল। আরো তীব্রভাবে এসে গেল। এই তো সাব্জেক্ট। অতলবাবু ঘরে ঢুকে দরজা দিলেন।