পাহাড়ের চূড়ায় একটা প্রজাপতি বসেছিল। কেউ জানত না। তার ডানায় সূর্যের আলো ঠিকরে জ্যোতি বেরোচ্ছিল। কেউ দেখল না।
মেঘ করল। খুব বৃষ্টি হল। প্রজাপতি জলের তোড়ে ভাসতে ভাসতে নেমে এলো রাস্তায়। বৃষ্টির জলে ভেসে ভেসে এলো গ্রামে।
উঠল গা ঝাড়া দিয়ে একজনের বারান্দায়। বসল চুপ করে বাঁশের গায়ে। যে বাঁশের আগায় দাঁড়িয়ে বাড়ির ছাদ।
কেউ খেয়াল করল না তাকে। বৃষ্টি থামল দুদিন পর। মেঘ কাটল। রোদ উঠল। সে উঠল চালার পরে। তার ডানায় ঠিকরে আলো উঠল উজ্জ্বল হয়ে। যেন মণি।
গ্রামের লোক ভিড় করে এলো। কেউ কেউ ফাঁদ পাতল। কেউ কেউ পুজোর আয়োজন করল। কেউ কেউ ভাঁওতাবাজি বলে গাল পাড়ল। কিন্তু প্রজাপতি রয়ে গেল অধরা।
গ্রামে এক যুবক থাকত। পঙ্গু। বাপ মা মরা। মন্দিরে ভিক্ষে করে খায়। সে বলল, এ প্রজাপতি এখানে কি করে এলো? আমার বাপ মা মরল একে ধরতে গিয়েই, পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে। এ অভিশাপ। ঘোর দুর্দিন আসছে তবে গ্রামে।
এই বলে সে ঢিল ছুঁড়ল টিপ করে। প্রজাপতির গায়ে গিয়ে লাগল। তৎক্ষনাৎ মরল সে। জ্যোতি গেল হারিয়ে। ঘাসে এসে পড়ল। যেন মামুলি প্রজাপতি একটা।
সবাই ধন্য ধন্য করল। বাঁচালে গ্রামকে সে। সে কুড়িয়ে নিল। বাড়ি নিয়ে গিয়ে তার ডানা থেকে বার করল সোনার তার। বাজারে বিক্রি করল। তার হল বাড়ি, গাড়ি, জমি আর বউ।
সবাই বলল, হঠাৎ এলো কি করে এত টাকা?
সে বলল, আমার বাবা মায়ের অসম্পূর্ণ সাধনা করলাম শেষ। দেবতা দিলেন বর।
সবাই বিশ্বাস করল।
কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল, কি ছিল সেই সাধন?
সে বলল, ওই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দিতে হবে ঝাঁপ। পড়তে হবে মন্ত্র। ঝাঁপ দেওয়ার পর। শ্বাস করে রোধ। ১০৮ বার। পড়বে গিয়ে কুবেরের আঙিনায়। নাও, যত ধন নেবে। এক রাত্রি সময় দেবেন কুবের।
সংশয়বাদী বলল, তুমি তো পঙ্গু..তবে?
সে বলল, বাপ মা দিলেন অমোঘ মন্ত্র। সে মন্ত্র অসাধ্য সাধন করে। বাপ মা আমার ফিরবে না আর, ওই কুবেরের ঘরেই রাত্রিদিন বাস করে। নাও মন্ত্র। দাও না ঝাঁপ। এসো চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে।
মন্ত্র দিল। মন্ত্র পিছু নিল একশো আটটা স্বর্ণমুদ্রা।
গ্রাম মানুষ শূন্য হল। এখন সে একাই থাকে সেই গ্রামে। বাকি সবাই দিয়েছে সেই চূড়া থেকে ঝাঁপ মন্ত্রে ভর করে।
ছেলেটা এখন বৃদ্ধ হয়ে মৃত্যু শয্যায়। নাতি এসে বসল কোলের কাছে। বলল, উপদেশ দাও।
দাদু বলল, যা আছে হাতের নাগালে, মানুষকে বিশ্বাস করাবে সে আসলে তুচ্ছ, কিম্বা অভিশাপ। যা আছে বহুদূরে, সে-ই আসল, আশীর্বাদ।
নাতি জিজ্ঞাসা করল, মানুষ শুনবে কেন?
দাদুর উত্তর দেওয়া হল না। চোখ বুজল তার আগেই। সারাটা গ্রাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিল উত্তর, চিরটাকাল তা-ই তো শুনে আসছে মানুষ। লোভে অন্ধ। ভয়ে বধির। হাজার বাণী শোনাও। মানুষ চিরটাকাল সত্যে অ-স্থির।
সৌরভ ভট্টাচার্য
3 May 2022