Skip to main content

 

3.jpg

তার বাড়ির বাইরে ছিল বিষণ্ণতার মাঠ। বাইরে বেরোতে চাইত না। কিন্তু তাই বলে কি তার ঘরেও সুখ ছিল? একদম নয়। ঘরে তার পাগল পাগল লাগত।

একদিন রাতে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। সারা মাঠের বিষণ্ণতা তখন গুমরে গুমরে কাঁদছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। তাকে দেখে তাদের চমক লাগলেও, সেটাকে অগ্রাহ্য করে তারা তাদের মত কেঁদেই চলল।

এ আর কী করে। হাঁটতে হাঁটতে সারাটা রাত কাবার করে ফেলল। মাঠ শেষ হল। কিন্তু মাঠের শেষে রাস্তা কই? এ তো বিরাট পাহাড়। রাজ্যের বিষণ্ণতাকে কানের কাছে এসে বলতে লাগল, "বেশ হয়েছে....মর মর এবার! বাড়িতে থাকতে কী হয়েছিল? তেনার নাকি বাড়িতে পাগল পাগল লাগছিল......এইবার?"

এই বলে সবাই তার কানের কাছে উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল। বাড়ি যাবে? থাক। সে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। কিন্তু কী আশ্চর্যের পাহাড় বাপু এটা? এ তো যত চড়ে ততই উঁচু হয়ে যায়! সে চড়তে চড়তে হাঁপায়। বিশ্রাম নেয়। আবার চড়ে। চূড়া আর দেখা যায় না।

রাত নামল। পাহাড় ফুরালো না। সে পাহাড়ি ফল খেল। পাহাড়ি নদীর জল খেল। পেট ব্যথা হল। বমি হল। আবার সুস্থ হল। সহ্যও হল। হঠাৎ খুঁজে পেল একটা গুহা। সে গুহার সামনে এসে দাঁড়ালো। এত বালি বালি কেন? এ তো সেই বিষণ্ণতা মাঠের বালি। এখানে কী করে এল?

কিন্তু কিন্তু করে গুহায় ঢুকল। কী ভীষণ অন্ধকার। কয়েকটা হোঁচট খাওয়ার পর চোখ কিছুটা ধাতস্থ হল। হাঁটাচলাও। ও কে?

একজন বৃদ্ধ শুয়ে। উপুড় হয়ে। সে কাছে যেতেই বৃদ্ধ বলল, খবরদার! আর কিন্তু ফেরার রাস্তা নেই।

সে বলল, যাওয়ার রাস্তাও কি ফুরাবে না কোনোদিন?

বৃদ্ধ বলল, না। যেখানে পৌঁছে মনে হবে আর না এগোলেও চলবে… আর এগোলেও তোমার মনের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য হবে না… সেই স্থানই তোমার আস্তানা।

আপনি পেয়েছেন?

না। আমি নিজেকে ঠকিয়ে এইখানেই আস্তানা গড়েছিলাম। এখন প্রতি রাতে আমাকে বিষণ্ণতা এসে ঘুমের মধ্যে থেকে তুলে নিয়ে যায়। প্রতিটা ভোর বিষণ্ণতায় জাগি। তারপর এতটা রাস্তা হেঁটে হেঁটে আসি। ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে। যাও যাও। দেরি কোরো না।

সে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো। কিছুটা রাস্তা এগিয়েই দেখে আরেকটা গুহা। তার সামনেও বালি। বিষণ্ণতার বালি। সে ঢুকল। আবার এক বৃদ্ধ। সেও একই কথা বলল। এইরকম সে প্রায় বাহাত্তরটা গুহা পেরিয়ে গেল। সবক'টায় ঢোকেনি যদিও আর।

দেখতে দেখতে ছয় মাস পেরিয়ে গেল। তার মাঝে মাঝে অতীতের পাগলামোর জন্য মন খারাপ লাগে। আশ্চর্য হয়ে যায় যখন দেখে তার বিষণ্ণতার জন্যেও মন খারাপ লাগে। কিন্তু আস্তানা কই তার?

একদিন ভীষণ ঝড় উঠল। চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া বাতাস। হঠাৎ খেয়াল করল সারা আকাশ জুড়ে বৃদ্ধদের চুল উড়ছে। বাতাস বলল, সবাই ফুরিয়ে গেল…..

সে বলল, সব বৃদ্ধ একসঙ্গে চলে গেল? তার বুকের মধ্যে আতঙ্কের কাঠঠোকরা উড়ে এসে বসল। ঠক ঠক করে ঠুকতে শুরু করল দিনরাত। তারও কি একই পরিণতি হবে? না না না।

কত বছর কেটেছে? সে মনে করতে পারে না। এটা বুঝেছে কোনো আস্তানাই নেই কোনোখানে। থামলে মনে হয় চললে পাওয়া যাবে আস্তানা। আর চললে মনে হয় কোথাও যেন থেমে যাওয়ার ছিল। এখন সে আর আস্তানা খোঁজে না তাই। খালি ঘোরে। বিষণ্ণতা তাকে ভয় পায় এখন। তার পায়ের সঙ্গে লাগলে সে হয় জল। জলের বিষণ্ণতা নেই। সে প্রতিচ্ছবি আঁকতে জানে। আকাশের, মুখের, আকারের। প্রতি নিয়ত সে নানা আকার, নানা রঙে রঙিন।

ধীরে ধীরে তার বয়স হল। চামড়ায় ভাঁজ পড়ল। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হল। কিন্তু সে দুর্বল হল না। যত সুতোর বুনোটে নিজেকে বুনেছিল সব একে একে খুলে দিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুঝল, সঙ্গী আর কেউ না থাক, সময় থাকেই। সময় জীবন মরণের পারের সঙ্গী। সময়ের সঙ্গেই কথা বলে সে। অতীর, বর্তমান দুইই সময়ের আসল ছবি। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না সে। যা সময়ের গর্ভে জন্মায়নি তাকে কল্পনার গর্ভে জন্ম দিয়ে কী লাভ?

এখন সে ফকির। নকল ফকির না। আসল ফকির। নকলে আসলে গুলিয়ে গেলেই জল পরীক্ষা কোরো পাঠক। যার পায়ে লেগে বিষণ্ণতা জল হয়। যে জলে বিশ্বনিখিলের প্রতিচ্ছবি পড়ে, সেই আসল ফকির। বাকি সব নকল।