ধ্যানেশ ভটচায্যি মশায় তামার বাটিতে গঙ্গাজল দিয়ে, দু ফোঁটা জিওলিন দিয়ে বসে আছেন ঘাটে। পনেরো মিনিট লাগবে জীবাণু মরতে। তাঁদের বংশে একটা পেটের অসুখের হিস্ট্রি আছে। তিনি চান না সে লিগ্যাসি ওদিকেও চলুক। তাই এই ব্যবস্থা।
ওদিকে পুরুত ঠাকুর অস্থির হচ্ছেন। "ধ্যানেশ তাড়াতাড়ি করো, আমার পেট আজ বড় চঞ্চল… যে কোনো সময়ে ডাক আসতে পারে…"
ধ্যানেশ নির্বিকার। এ সব ছল। ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে না ব্যাটার! হুম।
ধ্যানেশ বাঙালিদের এই দ্বিচারিতা মেনে নিতে পারে না। যে জল নিজের শত্রুকেও বিনা পরিশোধনে দেওয়া যায় না, সে জল ওঁদের দিস কি করে? আশ্চর্য না! অনেকবার মিউনিসিপালিটিতে আবেদনও জানিয়েছেন যে তর্পণের জলটা যেন পরিশোধন করে ঘাটে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তা কে শোনে কার কথা!
তর্পণ করলেন। পুরুত তাকে করিয়ে হুড়মুড় করে ছুটলেন। অন্য পার্টি আছে। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে ডাকল…. দাদু…
ধ্যানেশ দাঁড়ালেন। ছেলেটার বয়েস দশ-এগারো হবে।
বলল, আমায় তর্পণ করিয়ে দেবে? মায়ের জ্বর। মা আসতে পারেনি। বাবার জন্য মা পাঠালেন। করিয়ে দেবে?
ধ্যানেশ হতবাক হয়ে সিঁড়িতে বসে পড়লেন। এ হয় নাকি! তাছাড়া মা বাবা দুজনেই গেলে তখন করলেও তো হয় একমতে… এত তাড়া কিসের…. এতো সাবালকই হয়নি…..
ধ্যানেশ জিজ্ঞাসা করলেন তোমার ব্যাগে কি আছে….
ছেলেটা বলল, ধুতি, কুশ, তিল আর কোশাকুশি।
নাম?
অনীক রায়।
ব্রাহ্মণ?
হ্যাঁ
পৈতে?
হয়নি।
ধ্যানেশ কি করবেন বুঝতে পারছেন না। কিন্তু এমনভাবে তাকিয়ে ছেলেটা। যা হোক ধুতি পরালেন। প্যান্টের উপর দিয়েই। তার হাত ধরে ধীরে ধীরে গঙ্গার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবার কি হয়েছিল?
ছেলেটা বলল, করোনার সময় বাবার কাজ চলে গিয়েছিল। কলকাতায় একটা দোকানে কাজ করত। ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল যখন এখান থেকে সাইকেল চালিয়েও যেত। কিন্তু তারপর ওরাই ছাড়িয়ে দিল বাবাকে। দেরি হয়ে যেত।
ধ্যানেশবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। নামতে পারছেন না। চল্লিশ কিলোমিটার সাইকেলে! ছেলেটা গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে বলেই যাচ্ছে….
আমাদের তখন অনলাইন ক্লাস। কিন্তু আমাদের তো স্মার্টফোন নেই। আমি খুব জেদ করতাম। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিলাম। খুব বায়না করতাম।
ছেলেটা থামল।
ধ্যানেশবাবু বসে পড়েছেন। যেন কি হবে বুঝতে পারছেন।
ছেলেটা বলল, বাবা এই গঙ্গাতেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন একদিন রাতে। কাঁকিনাড়ায় বডি পাওয়া গেল চারদিন পর।
ধ্যানেশবাবুর দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা। গলা বুজে আসছে।
ছেলেটা বলল, দাদু, আমি বাবাকে সরি বলতে চাই… আসলে মা পাঠায়নি, আমি নিজেই এসেছি… এটা বাবার ধুতি….
ধ্যানেশবাবু তাকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। কান্না চেপে রাখতে ছোটোবেলা থেকেই পারেন না। এখনো পারলেন না!
ছেলেটা শক্ত হয়ে আছে। চোখে এক বিন্দু জল নেই। মুখটা শক্ত। কতটা শোকে মানুষ এমন পাথর হয়! এতো বাচ্চা!
ধ্যানেশবাবু চোখ মুছলেন। ছেলেটাকে নিয়ে নীচে নামলেন। তর্পণের মন্ত্র সব জানা। একে একে বললেন। ছেলেটাও বলল।
তর্পণ শেষ। ছেলেটা একটা দশ টাকার নোট বাডিয়ে বলল, নেবে?
ধ্যানেশবাবু মাথায় ঠেকিয়ে নিলেন। তার জামা কাপড় ছাড়িয়ে দিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, মায়ের কি জ্বর সত্যিই?
ছেলেটা বলল, হ্যাঁ। দু’দিন হল।
ধ্যানেশবাবু বললেন, রক্ত পরীক্ষা হয়েছে? খুব ডেঙ্গু হচ্ছে।
ছেলেটা বলল, না।
ধ্যানেশবাবু বললেন, চলো, তোমার মাকে দেখে আসি। স্টেশানের কাছে যে আরোগ্য ল্যাবটা আছে… ওটা আমাদের… এসো…
ধ্যানেশবাবু গাড়িতে উঠলেন। ছেলেটা পাশে বসল।
ছেলেটা বলল, বাবা কি আমার সরিটা শুনেছে দাদু?
ধ্যানেশবাবু বললেন, শুনেছেন, তুমি যত বড় হবে বাবাকে আরো বুঝতে পারবে… বাবা তোমায় কত ভালোবাসতেন….
ছেলেটা কাঁদছে। ভীষণ কাঁদছে।
ঝাপসা চোখে গাড়িটা পাশে দাঁড় করিয়ে চুপ করে বসলেন ধ্যানেশবাবু। এই তো আসল তর্পণ। কাঁদুক। প্রান হালকা করে কাঁদুক।