Skip to main content
 
 
        নদীটা কতদিন হল মাঠের পাশে পড়ে আছে আকাশও জানে না। একটা পাখি আমগাছটার মগডালে বাসা বেঁধেছে। কি পাখি কে জানে। পাখিটা শহরে যায়। গ্রামে যায়। আস্তাকুঁড়ে যায়। শ্মশানে যায়। দিনের শেষে সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসে আমগাছটায়। তার নীড়ে সে একাই থাকে। তার উপরের ডালে থাকে একটা কেন্নো, আর কয়েকশো পিঁপড়ে গাছ ফুটো করে। একটা কাঠবেড়ালি কয়েক বছর হল বাসা বেঁধেছে এই আমগাছটায়। এদিকটায় মানুষ সেরকম কেউ আসে না। গাছটার দুই দিকে প্রায় পাঁচ ছয় কিলোমিটার গেলে পর দুটো গ্রাম। পুবে মুরলী, পশ্চিমে চরকাকাটা। আমগাছটার কাছে কেউ আসে না। আসা বারণ। এই গাছটায় একটা অভিশাপ আছে।
 
 
        সে অনেক যুগ আগের কথা। মুরলী গ্রামের মৌ'র সাথে চরকাকাটা গ্রামের বীরেনের ভালোবাসা ছিল। কিন্তু ওদের জাতে মেলেনি বলে মৌয়ের বিয়ে হয় কৃষ্ণনগর শহরে। এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার হবে। বীরেন বিবাগী হয়ে যায়। বাউল হয়ে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ায়। আর মৌ সংসার করে। মৌ'রা ছিল ব্রাহ্মণ আর বীরেনরা ছিল নমশূদ্র। এই নিয়েই সমস্যা। বছর ঘোরে। কিন্তু মৌ'র আর সন্তান হয় না, ওদিকে বীরেনও গুরুলাভ করেও সিদ্ধিলাভ করতে পারে না। তখন হত কি, এই দুই গ্রামের লোকেরা মিলে প্রত্যেক কার্তিক মাসের প্রথম পূর্ণিমাতে একটা বড় করে হোম-যজ্ঞ করে পূজো করত এই আমগাছটার তলায়। গ্রামের দেবতা, লোকে বলত কার্তিক, কিন্তু অনেকে বলে ধর্মঠাকুর নাকি। সে যাই হোক। তো মৌ'র বাড়ির লোক বলে তুই এই গ্রামে এসে একটা পূজো দিয়ে যা, দেখ যদি কিছু হয়, আর অন্যদিকে বীরেনের গুরুদেব বলেন, তুমি গ্রামে গিয়ে আগে তোমাদের গ্রাম্যদেবতাকে তুষ্ট করে এসো তবে হয়ত সিদ্ধিলাভ হবে। তারা একসাথেই গ্রামে আসে। আবার দেখা হয়। গ্রামে এই নিয়ে খুব অশান্তি হয়। দু'পক্ষের প্রায় হাতাহাতি লেগে যায়। এ বলে এটা এর ষড়যন্ত্র, সে বলে তার। এমন সময় প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। পূজো পণ্ড হয়। যজ্ঞের আগুন যায় নিভে। তার ওপর পোড়া কাঠের উপর একটা মড়া কাকের বাচ্চা এসে পড়ে। যজ্ঞ অশুদ্ধ হয়। এর কয়েক মাস পরে দেখা যায় বীরেন গলায় দড়ি দিয়েছে এই আমগাছেই, আর মৌ বিধবা হয়ে গ্রামে ফেরে। তার বরকে সাপে কেটেছিল। সেই থেকে পূজোপাঠ উঠে যায়। গাছটার শ্রীও কেমন হারিয়ে যায়। আমের বোল হয়, আম হয়, কিন্তু কেউ পূজোয় নেয় না, পাড়ে না।
        হঠাৎ একদিন লোকে শুনল ওই গাছটার তলায় কোন এক সন্ন্যাসী নাকি কুটির তৈরি করেছে। দুই গ্রামের লোকই দেখতে এলো। তারা দেখল সাদা ধুতি আর গায়ে সাদা চাদর জড়ানো শীর্ণ একটা মানুষ। দাড়ি সাদা পাকা, মাথায় চুল ঘাড় অবধি নেমে এসেছে। সে সন্ন্যাসী প্রসন্ন হেসে দুই গ্রামের লোককেই অভ্যর্থনা জানালো। যদিও সবাই সন্দেহের চোখেই দেখল, তবু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলল। আসলে চলতে ফিরতে একটা অমঙ্গলে গাছকে আর কে সহ্য করে? এই সন্ন্যাসী এসে যদি গ্রহের দোষটা কাটায় তবে দোষ কি?
        দুই গ্রামের লোকেদের মধ্যে ঠিক হল মুরলীর লোকেরা কৃষ্ণপক্ষে সাধুসেবার ভার নেবে আর চরকাকাটা গ্রামের লোকেরা শুক্লপক্ষের। সাধু অনেক আপত্তি করার চেষ্টা করল। কপট রাগ দেখানোরও চেষ্টা করল। কিন্তু সব বৃথা। দুই দলের লোক চলে গেল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুই গ্রামে নানান কথা শুরু হল। গুজব আর কি। এখন সন্ন্যাসী থাকবে অথচ গুজব থাকবে না তাই কি হয়? যেমন সন্ন্যাসীর গা দিয়ে নাকি শুক্লপক্ষে লাল জ্যোতি বেরোয় আর কৃষ্ণপক্ষে নীল। সন্ন্যাসী নাকি পূর্ণিমাতে দেড়হাত বড় হয়ে যায় আর অমাবস্যাতে নাকি তার মাথার দু'পাশে দুটো শিং গজায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যে কথাটা সব চাইতে আলোড়ন তুলল দুই গ্রামেই সে হল সন্ন্যাসীর সাথে নাকি একজন যুবতী আর একজন যুবককে দেখা যায়। এখন কথা হচ্ছে, মৌ আর বীরেনের গল্প তো কত যুগ আগের। কিন্তু এই আমগাছটা আর মরে না, আর তাদের গল্পও দুইগ্রামে ফুরায় না। এক প্রজন্ম তার পরের প্রজন্মকে গল্পটা উত্তরাধিকারসূত্রে দিয়ে যায়, সাথে দুই গ্রামের মধ্যে একটা শত্রুতার মনোভাবও। তো গ্রামের লোক বুঝে নিল এই দুই পুরুষ নারী নিশ্চই মৌ আর বীরেনই হবে। তারা সাধুকে জিজ্ঞাসা করেছে ঠারেঠোরে, কিন্তু সাধু এড়িয়ে গেছে।
        এই দুই গ্রামে বিজন আর গোপাল বলে দুই সাহসী যুবক থাকত। তারা মনে মনে ঠিক করল সাধু যখন নদীতে স্নানে যাবে তারা গিয়ে ঘরটা ভালো করে দেখবে। সত্যিই কি কোনো রহস্য আছে না পুরোটাই গুজব। তারা যে এটা ভাবছে তারা নিজেরাই শুধু জানত। কিন্তু ঘটনাচক্রে তারা দু'জনেই একইদিনে সাধুর স্নানে যাওয়ার সময়টায় এসে হাজির। নিজেদের দেখেই তারা একে অপরের আসার কারণটা বুঝে গেল। চোখে চোখে ইশারায় একটা সমঝোতা হয়ে গেলে ঘরের ভিতর ঢুকল। একটা মাদুর মেঝের উপর পাতা, একটা লণ্ঠন আর একটা কুঁজো। ব্যস আর কিছুই নেই ঘরে। দুজনেই হতাশ হয়ে ভাবছে কি করবে। এদিকে সাধুর স্নান থেকে ফেরার সময় হয়ে আসছে। তো দু'জনেই ঠিক করল আজ যেহেতু অমাবস্যা আজ কিছু একটা হতে পারে, কেন না তারা গাছের উপর ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে? রাতে কি হয় নিজেদের চোখেই দেখে নেওয়া যাবে।
        তাই হল। তারা দু'জনে গাছের উপর উঠে ঘাপটি মেরে বসল। রাত হল। সাধুর কুটির থেকে কিছু একটা মন্ত্র উচ্চারণের আওয়াজ আসছে। মন্ত্রটার কেমন একটা যাদুশক্তি আছে যেন। গোপাল আর বিজনের একটা ঘোর লাগতে শুরু করেছে। তারা কিছু একটা আঁচ করে নিজেরা কাছাকাছি এসে নিজেদের শক্ত করে গাছের ডালের সাথে বেঁধে নিল। হঠাৎ তাদের চারদিকে কেমন একটা লাল-নীল মেশানো জ্যোতির্ময় কুয়াশা ঘিরে ধরতে লাগল। বিজন ভয়ে গোপালের হাতটা ছুঁতে গিয়ে দেখে সেটা হিম ঠাণ্ডা বরফ। গোপাল গামছায় আটকে ঝুলে রয়েছে। মারা গেল? বিজন দেখল ধীরে ধীরে সাধুর কুটিরের উপরের দিকটা স্বচ্ছ হয়ে মিলিয়ে গেল কুয়াশায়। তার দিকে মাথা তুলে সাধু তাকিয়ে। তার আর সাধুর মাঝখানে একটা কুয়াশা ঘেরা সুড়ঙ্গ যেন। সাধু বলল, মৌ'কে নামিয়ে নিয়ে আয়... ও এজন্মে পুরুষ হয়ে এসেছে... তোরা নিজেদের পরিবারের উপর প্রতিশোধ নিবি... আমি তোর গুরুদেব ছিলাম সেই জন্মে... তোদের প্রস্তুত করতে হবে... নইলে এবারের আসা ব্যর্থ হবে... তোদের গুপ্তমন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে...
        বিজন গোপালকে খুঁজতে গিয়ে দেখে এক যুবতী তার দিকে তাকিয়ে বসে। বিজন তার দিকে তাকাতেই সে কাকুতি-মিনতি করে বলে, তুমি এ কাজ কোরো না গো... তোমার টানেই আমার আবার সংসারে ফেরা... কিন্তু যাদের তুমি মারবে তারা আমারই সন্তানের বংশধরেরা... আমাদের মিলন না হোক... তুমি এই অন্যায়টা কোরো না...
        নীচ থেকে সন্ন্যাসী বলল, তুই ওর কথা শুনলে এজন্মেও অসিদ্ধ রইবি পাষন্ড... ওকে নামিয়ে নিয়ে আয়... তুই ছুঁলেই ও অবশ হবে... তোকে সিদ্ধ না করে আমারও মুক্তি নেই রে...
        ওদিক থেকে সেই যুবতী চীৎকার করে বলে, না...না ...না...
 
 
        পরেরদিন সাধুর কাটা মাথা আমগাছের গোড়ায় পাওয়া যায়। গোপালের গলায় গামছার ফাঁস দেওয়া নিথর দেহ আমডালে ঝুলছে। আর বিজনকে পাওয়া যায় দু'দিন পর, উলটপুর গ্রামের ঘাটে তার ফোলা, পচা দেহ ভেসে ওঠে। দুই গ্রামের লোকই বলে তারা নাকি অনেকেই মধ্যরাতে একটা চীৎকার শুনেছিল। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না।